জুলাই ২০, ২০২১ ১৯:৩৬ Asia/Dhaka
  • মার্কিন সেনাদের ইরাক জবর দখল: যেসব মারাত্মক ক্ষতি তারা করেছে

২০০৩ সালের মার্চে মার্কিন সেনারা ইরাকে হামলা চালায়। এরপর প্রায় ১৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ব্যাপক গণবিধ্বংসি অস্ত্র থাকার অজুহাতে এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার কথা বলে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু ইরাক দখলের পর সেদেশে কোনো মারণাস্ত্র পাওয়া যায়নি। এমনকি সন্ত্রাস দমনের কথা বলে তারা ইরাকে সেনা সমাবেশ ঘটালেও সন্ত্রাস দমন তো হয়নি বরং একটি পর্যায়ে ইরাক সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়।

গত প্রায় দুই দশকে মার্কিন সেনারা ইরাকে এমন কোনো অমানবিক কর্মকাণ্ড নেই যা তারা করেনি। ইরাকের বিরুদ্ধে  মার্কিন আগ্রাসনে নিহতের সঠিক তথ্য যদিও পাওয়া যায় না কিন্তু কিছু পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ইরাক যুদ্ধ শুরুর পর এ পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আবার কোনো কোনো সূত্র মতে মৃতের সংখ্যা কয়েক লাখ। ২০০৫ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ যদিও দাবি করেছিলেন মাত্র ৩০ হাজারের বেশি ইরাকি নিহত হয়েছে কিন্তু 'ইরাক বডি কাউন্ট' নামে একটি তদন্ত দল জানিয়েছে ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দেড় লাখের বেশি ইরাকি নিহত হয়েছে।

এদিকে 'ইরাক বডি কাউন্ট'সহ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয় ইরাক যুদ্ধ শুরুর পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৮৭ হাজার ৬৬৫ জন নিহত হয়েছে তবে নিহতের এ সংখ্যা ৯৫ হাজার ৬৮৭ জন বলেও মনে করা হয়। তবে সে যাইহোক এসব পরিসংখ্যান বা  তথ্য উপাত্ত ইরাক যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম পাঁচ বছরের। যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিহত হওয়া ছাড়াও আরো লাখ লাখ মানুষ আহত হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৫ সালের মধ্যে যুদ্ধ ও সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৪৪ লাখ ইরাকি শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে।

২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে সাবেক শাসক সাদ্দামের পতন হয় এবং এরপর এক লাখ ৭৩ হাজারের বেশি বিদেশি সেনা ইরাকে প্রবেশ করে যাদের মধ্যে দেড় লাখই ছিল মার্কিন সেনা। গত ১৮ বছরে মার্কিন সরকার ইরাকে ১৪টি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মার্গারেট কাম্বারলি ইরাক সম্পর্কে বলেছেন, সেদেশে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি মানবতার ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।

প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন উপস্থিতি ইরাকিদের জন্য কেবল মৃত্যু ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনেনি। মার্কিন সেনারা প্রকাশ্যে ইরাকিদেরকে হত্যা ও তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। ১৯৪৫ সালে জাপানে আমেরিকার পরমাণু বোমা হামলায় যে হারে বহু বছর ধরে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগে মৃত্যুবরণ করেছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ মারা গেছে ইরাকে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনে। যুক্তরাষ্ট্র জাপানের মতোই আরেকটি বিপর্যয় ঘটিয়েছে ইরাকে। ইরাক যুদ্ধের ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের দক্ষ জনশক্তি দেশ ছেড়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ফলে ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দেশটির অর্ধেক চিকিৎসক দেশ ছেড়েছে।

শিশুদের ওপরও যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। এমনকি আগামী প্রজন্মও ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পায়নি। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল ইউরেনিয়াম যুক্ত বোমা এবং ফসফরাস বোমার আঘাতে ইরাকে ফালুজায় জন্ম নেয়া বহু শিশু প্রতিবন্ধী এবং তারা দুরারোগ্য ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছে।

ইরাকি শিশু

গত বছর নভেম্বরে ফালুজা শহরের একটি হাসপাতালের পরিচালক আহমাদ মুখালেফ হামাদ বলেছেন, ইরাক যুদ্ধের পর ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও মার্কিন বিষাক্ত বোমার আঘাতে এখনো প্রতি বছর প্রতিবন্ধী বা অপূর্ণাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে। জন্ম নেয়া এসব শিশুদের হয় কোনো চোখ নেই অথবা মাত্র একটি চোখ রয়েছে। অথবা কোনো না কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাড়াই অর্থাৎ হয় হাত নেই  অথবা পা নেই অথবা দুই মাথাওয়ালা শিশুর জন্ম হচ্ছে।

এ ছাড়া সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের আমলে বন্দীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ও সরকার বিরোধী বিশেষ করে শিয়া মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও ফাঁসির জন্য  আবু গ্বারিব কারাগার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে মার্কিন হামলায় সাদ্দামের পতন ঘটে এবং তারা ইরাক দখল করে নেয়। এরপর মার্কিন নিয়ন্ত্রিত আবু গ্বারিব জেলখানাসহ বিভিন্ন জেলখানায় আটক বন্দীদের ওপর দখলদার মার্কিন সেনারা নজিরবিহীন হত্যা নির্যাতন চালায়। মার্কিন টিভি চ্যানেল সিবিএস ইরাকি বন্দীদের ওপর মার্কিন সেনাদের অত্যাচার নির্যাতনের বহু লোমহর্ষক ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছিল।

ইরাক দখলের পর মার্কিন সেনারা সবচেয়ে বড় যে জঘন্য কাজটি তারা করেছে তা হচ্ছে ইরাকের হাজার হাজার বছরের পুরানো বহু মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হয় ধ্বংস করেছে অথবা লুটপাট করে নিয়ে গেছে। বাগদাদের পতনের পরপরই জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত খুবই মূল্যবান অসংখ্য ঐতিহাসিক দলিল, বিভিন্ন লেখা সমৃদ্ধ কাগজ লুট হয়ে গেছে যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। প্রথমে মনে করা হচ্ছিল এক লাখ ৭০ হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দ্রুত চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু পরে দেখা গেল পরিকল্পিতভাবে এবং সময় নিয়ে এসব নিদর্শন প্যাকেট করা হয় এবং নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়।

ইরাকের জাদুঘর থেকে চুরি  হয়ে যাওয়া নিদর্শন

গত বছর নভেম্বরে ইরাকের প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ বিভাগের পরিচালক আবাদ হামজা বলেছেন, ইরাকের বিভিন্ন স্থানে বহু ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে যাদের  বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০৩ সালে মার্কিন সেনারা ইরাকে প্রবেশ করার পর এসব নিদর্শনের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এমনকি মার্কিন সেনারা ঐতিহাসিক বহু স্থানকে তাদের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করায় ওইসব নিদর্শনেরও ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ৮০ শতাংশ ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়েছে মার্কিন সেনা ও দায়েশের হাতে। 

ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসনের আরেকটি কুফল হচ্ছে সেদেশে উগ্র তাফকিরি  সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস জঙ্গির উত্থান। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও স্বীকার করেছেন তাদের হাতেই আইএস জঙ্গির উদ্ভব ঘটেছে। বাস্তবতা হচ্ছে ২০০৩ সালে মার্কিন সেনারা ইরাকে প্রবেশ করার পর এই দেশটি জঙ্গিদের  অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। মার্কিনীরা জঙ্গি দমনের কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে তারাই ইরাক ও সিরিয়ায় উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর বিস্তার ঘটিয়েছে এবং যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যা ও সম্পদের ক্ষতি করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদও লুট করেছে এবং এখনো লুটতরাজ করছে।

এ ছাড়া ইরাকে মোতায়েন মার্কিন সেনারা ইরানের কুদস ব্রিগেডের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছে যিনি কিনা দায়েশ বা আইএস জঙ্গি দমনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

ট্যাগ