জুলাই ২৮, ২০২১ ১৭:৪৩ Asia/Dhaka
  • চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' পরিকল্পনা মোকাবেলায় পাশ্চাত্যের দৌঁড়ঝাপ

সম্প্রতি ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পোন্নত সাতজাতি গ্রুপের শীর্ষ বৈঠক। এ বৈঠকে চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' পরিকল্পনা মোকাবেলার জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। চীনের ওই পরিকল্পনা মোকাবেলার জন্য ৩৫ লাখ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পাশ্চাত্য কি সত্যিই চীনের ওই পরিকল্পনা মোকাবেলা করতে যাচ্ছে?

চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' এমন একটি পরিকল্পনা যেটি বিশ্বের ৬০টি দেশের সঙ্গে চীনের মূল ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করবে। এ পরিকল্পনার আওতায় মূলত দুটি সড়ক পথে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত হবে চীন। এই সড়ক পথের সঙ্গে রেলপথ ও তেলের পাইপলাইনও রয়েছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রপথেও, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হবে চীন। বলা হয়ে থাকে প্রাচীন সিল্ক রুটের আধুনিক সংস্করণ এটি।

এই পরিকল্পনা অনুযায়ী চীন দুটি 'ইকোনমিক করিডর' তৈরি করছে। একটি কুনমিং থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ। আর দ্বিতীয়টি- চীনের জিনজিয়াং থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওদার পর্যন্ত রেল ও সড়কপথ। তবে এই করিডরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ২০১৩ সালে 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' নামে একটি উন্নয়ন কৌশল ও কাঠামো উপস্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর প্রাচ্যের দিকে তিনি বিশেষভাবে নজর দিয়েছেন এবং ওয়াশিংটনের প্রাচ্য নীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন। তবে প্রথম থেকেই বিশেষজ্ঞরা যে প্রশ্নটি তুলেছেন তা হচ্ছে পাশ্চাত্য চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' পরিকল্পনাকে কিভাবে মোকাবেলা করবে? কিংবা আদৌ কি তারা এ ক্ষেত্রে সফল হবে? কেননা কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে এরই মধ্যে চীন সরকার তাদের ওই বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। মার্কিন নেতৃত্বে পাশ্চাত্য বিশ্ব চীনা পরিকল্পনা মোকাবেলার যে কথা বলছে তাতে জার্মানি ছাড়া ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় চীনের ওই পরিকল্পনা মোকাবেলা এতো সহজ নয় বলে অনেকে মনে করছেন।

চীন অনেক বছর ধরে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' পরিকল্পনা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীন হস্তক্ষেপ না করলেও পাশ্চাত্যের দেশগুলো ওই পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়ার জন্য অর্থনৈতিক সহায়তার বিষয়ে প্যাকেজ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ধারণা করা হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনসন চীনকে বাধা দিতে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়নের ব্যাপারে ব্যাপক আশাবাদী এবং তারা দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চান ব্রিটেন বিশ্বজুড়ে ডলার ও চীনা মুদ্রা ইউয়ান এক্সচেঞ্জের মাধ্যম হিসাবে থাকবে যাতে আর্থিক লেনদেনের উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় থাকে। এভাবে এ পরিকল্পনার মাধ্যমে সারা বিশ্বে সুষ্ঠুভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পাদন, উন্নত ও মানসম্পন্ন অবকাঠামো তৈর, দুর্নীতি রোধ, লিঙ্গ সমতা,  আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করবে বলে পাশ্চাত্যের ধারণা।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পাশ্চাত্যের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী যদি উন্নতির ছক কষা হয় তাহলে তা একটি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ এনে দেবে। কিন্তু চীন সরকার কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা ছাড়াই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে এবং সেইসঙ্গে প্রতিটি দেশ তাদের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী চীনের সঙ্গে সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে।

বাস্তবতা হচ্ছে, চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড'এর মতো বৃহৎ পরিকল্পনা মোকাবেলার জন্য একদিকে পাশ্চাত্যের যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ অন্যদিকে একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে জাপান ও ভারত। ২০১৬ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে  এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনের মতোই বিকল্প বাণিজ্যিক করিডরের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন।

মজার বিষয়টি হচ্ছে, জাপানিরা এর আগেও এ ধরনের প্রস্তাব তুলে ধরেছিল। উদাহরণ স্বরূপ আশির দশকে জাপানিরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবেলায় তারা অর্থনৈতিক বিষয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে সে সময় আশেপাশের দেশগুলো জাপানের ওই প্রকল্পের প্রতি সমর্থন দেয়নি। কিন্তু এবার পরিবেশটা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং চীনের প্রতি বহু দেশের সমর্থন রয়েছে ।

২০১৬ সালে মার্কিন সরকার চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড'  পরিকল্পনার সরাসরি বিরোধিতা করেছিল। ২০১৭ সালে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগ এক প্রতিবেদনে জানায় 'চীন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি এবং সেই হুমকি মোকাবেলার জন্য মার্কিন সরকারও একই ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোবে।'

যাইহোক ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া চীনের ওই পরিকল্পনা মোকাবেলার জন্য ত্রিদেশীয় যৌথ পরিকল্পনার আওতায় বিকল্প করিডর তৈরির কথা ঘোষণা করেছিল। তবে এখন পর্যন্ত তা  বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। কারণ কোনো দেশই ওইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তারা এ বিষয়টি সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত শিল্পোন্নত সাত জাতি গ্রুপের শীর্ষ বৈঠকে উত্থাপন করে যাতে অন্য দেশের সমর্থন পাওয়া যায়।

এদিকে ফ্রান্সও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোকে নিয়ে বৃহৎ অর্থনৈতিক করিডর গঠনের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে জার্মানিও তাদের গাড়ি ব্যবসা সম্প্রসারণ ও রপ্তানির জন্য অন্য আরো বহু দেশকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে, গত বছর চীনের গাড়ি রপ্তানির পরিমাণ জার্মানিকে ছাড়িয়ে গেছে যা কিনা জার্মানিরা তাদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। শুধু তাই নয় চীনের কাছে বিপুল অংকের ঋণভারে জর্জরিত যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে পাশ্চাত্য আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।

চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' পরিকল্পনার ব্যাপারে ইরানের অবস্থান কি তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। একদিকে চীন ও অন্যদিকে চীনের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের বিকল্প করিডর নির্মাণের পরিকল্পনার বিষয়ে ইরানের অবস্থান কি হবে তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছে। তেহরান মনে করে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইরানকে বাদ দিয়ে কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ইরান তার জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। যেহেতু ইরানের সঙ্গে পাশ্চাত্যের আচরণ বৈরি সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই ইরান চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' পরিকল্পনাকেই অগ্রাধিকার দেবে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৮

ট্যাগ