জুন ১৫, ২০২১ ১৯:০৪ Asia/Dhaka

গত কয়েকটি আসরে আমরা বলেছি অনেকের ধারণা পাশ্চাত্যের দেশগুলোর নাগরিকরা সব ধরণের সমস্যা থেকে মুক্ত। খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়েছে। আসলে বাস্তবতা এমনটি নয়। গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে গৃহহীনতা নিয়ে আলোচনা করেছি।

সেখানে আমরা বলেছি ফ্রান্সে রাস্তায় ঘুমান এমন গৃহহীনদের মধ্যে প্রতিদিন  গড়ে একজন করে মারা যান। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের জাতীয় স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট জানিয়েছে, সেদেশে ঐ বছর ৫৬০ জন গৃহহীন মারা গেছেন। দেশটির কয়েকটি দাতব্য সংস্থা দাবি করেছে, গৃহহীনতার কারণে ফ্রান্সে প্রাণ হারানো মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের অন্তত ছয় গুণ। ২০১৯ সালে প্যারিসে গৃহহীনদের বিষয়ে পরিচালিত দ্বিতীয় আদমশুমারির ফলাফলে দেখা গেছে, রাস্তায় ঘুমানো মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজও আমরা পাশ্চাত্যে গৃহহীনতা সমস্যা নিয়ে আরো আলোচনা করব।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসেও গৃহহীনতা সমস্যা বাড়ছে। এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বেকারত্বের ক্রমবর্ধমান হার। গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করে এমনটি একটি ফরাসি সংস্থা হচ্ছে লা ক্লোচ। এই সংস্থার প্রধান লুই ক্যাভিয়ার বলেছেন, "বেকার লোকেরা তাদের কোনো চাহিদাই ঠিক মতো পূরণ করতে পারে না। এর মধ্যে আবাসন সমস্যাও একটা বড় বিষয়। ফরাসি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিস্টিকস অ্যান্ড ইকোনমিক স্টাডিজ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্যারিসে  দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে চার লাখ ৬০ হাজার মানুষ। সমস্যাটা হলো পাশ্চাত্যে গৃহহীন মানুষের জন্য চাকরি সহজলভ্য নয়, কিন্তু কেউ যদি আয় না করে তাহলে সে আবাসনের ব্যবস্থা করতে করবে কি করে? এটা একটা দ্বিচারিতা। এ ধরণের নীতি ও আচরণ গৃহহীনতা সংকটকে জিইয়ে রাখছে। গত বছর প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বের যেকোনো ধনী দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বেশি।

আমেরিকার অলাভজনক সংস্থা 'ফ্যামিলি প্রমিজ' জানিয়েছে, বাড়ির চড়া মূল্য, বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য মার্কিন পরিবারগুলোতে গৃহহীনতা সমস্যার বড় কারণ। তারা বলছে, ২০১৮ সালে সাড়ে ২৫ লাখ শিশু গৃহহীনতা সমস্যায় ভুগেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩০ শিশুর মধ্যে একটি শিশু প্রতি বছর আবাসন সমস্যায় পড়ে, ২০১৪-২০১৫ সালে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী আসাবন সমস্যায় মধ্যে ছিল। গৃহহীনতা সংকটে জর্জরিত শিশুদের ৫১ শতাংশের বয়স ৫ বছরের কম। ব্রিটেনে গৃহহীনতার সমস্যা এতটাই প্রকট যে, সেখানে এ বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে গোটা দেশ ও সরকারকে সচেতন করতে ব্রিটেনের রাজধানী শহর লন্ডনের পাশাপাশি এডিনবার্গ, কার্ডিফ, ব্রিসবেন ও ডাবলিনসহ বিভিন্ন শহরে মাঝে মধ্যেই পথ ঘুমের আয়োজন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও এ ধরণের প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অংশ নেয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল মানুষরাও।

বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এ ধরণের মানুষের দুর্দশা তুলে ধরতে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে রাত কাটিয়েও দেখিয়ে দিয়েছে। লন্ডনে সামাজিক আন্দোলনে শামিল একজন কর্মী বলেছেন,  রাস্তায় যারা ঘুমায় অর্থাৎ গৃহহীদনের সব সময়ই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে রাস্তায় ঘুমানো মানুষগুলোকে ‘রাফ স্লিপার’ বলা হয়। এ ধরণের আন্দোলনের একজন আয়োজক বলেছেন, গৃহহীনদের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধির লক্ষে প্রতীকীভাবে সাধারণ মানুষকে নিয়ে রাস্তায় ঘুমানোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। ডেম লুইস নামের আরেক আন্দোলনকারী তাদের আন্দোলন সম্পর্কে বলছেন, আমরা এর আগে মানুষকে সচেতন করার জন্য  রাতে রক্ত হিম করা ঠাণ্ডা সহ্য করে রাস্তায় ঘুমিয়েছি। সে রাতে বৃষ্টিটাও ছিল প্রচণ্ড। কিন্তু তারপরও আমরা এটা করছি। কারণ গৃহহীনতার সমস্যা বড় আকার নিচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে উদ্বাস্তু সমস্যা, আছে শরণার্থী সংকট।

ডেম লুইস আরও বলেন, আজ এখানে যারা রাত কাটিয়েছে তারা গৃহহীন কিংবা শরণার্থীর মতোই কাটিয়েছে। আমরা এখানে যে কষ্ট একটা রাত পার করেছি, লাখ লাখ মানুষ সেই কষ্টটা বছরের পর বছর ধরে করছে। ‘চ্যারিটি শেল্টার’ নামে একটি সংস্থার মতে, ব্রিটেনে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা তিন লাখের মতো। শুধু লন্ডনেই নয়, দেশজুড়েই দেখা যায় গৃহহীন মানুষ। তারা রাস্তায় রাত কাটান। ২০১১ সালের তুলনায় ইংল্যান্ডজুড়ে জরুরি কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া লোকের সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ৬০ ভাগ। আর এ সময়ের মধ্যে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অর্ধেকেরও বেশি। জনগণের জন্য সরকারের দেয়া সমাজকল্যাণ ও গৃহসুবিধা কমিয়ে আনা নীতির কারণেই দেশটিতে গৃহহীনদের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন জন ডিন নামের আরেক আন্দোলনকারী।

সরকারের দেয়া গৃহভর্তুকির তুলনায় দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে বাসা ভাড়া অনেক বেড়েছে। বাসা ভাড়ার এ বাড়তি ব্যয় মেটাতে না পেরে অনেকেই রাস্তায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে মনে করে ‘চ্যারিটি শেল্টার’ নামে সংস্থাটি। লন্ডনের মতো আলো ঝলমল শহরের রয়েছে এমন অন্ধকার বাস্তবতা। রাতে দেখা যায়, রাস্তার পাশে পড়ে আছে গৃহহীন অসংখ্য মানুষ, হোমলেস নামে যাদের পরিচয় সেখানে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে গৃহহীনতার সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। সরকারগুলোর পক্ষ থেকে বড় বড় বুলি আওড়ানো হলেও বাস্তবে সমস্যা সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ