জুলাই ০৩, ২০২১ ১২:৫৫ Asia/Dhaka

ইরানের নয়া প্রেসিডেন্ট ড.সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি’র ভূমিধস বিজয়ের কারণ নিয়ে ইরান প্রবাসী গবেষক আবুল কাসিম মুহাম্মাদআনওয়ারুল কবির রেডিও তেহরানকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, রায়িসি’র স্বচ্ছতা,ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য,স্বনির্ভর নীতিমালাই জনগণকে তার প্রতি সমর্থনে আকৃষ্ট করেছে। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর সেটিই জনগণের কাছে রায়িসির প্রতি একটা বিশেষ ইমেজ তৈরি করেছে।

সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা সব সময় ইরানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আন্তর্জাতিক সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইরানের উপর অর্থনৈতিকসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।ফলে ইরানের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে যে-আমেরিকার সাথে আলোচনা করে লাভ নেই। যদি আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা তুলে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারে তবেই ইরান আলোচনায় যাবে।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব আনোয়ার কবির, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভ করেছেন স্বতন্ত্র  প্রার্থী সৈয়দ ইব্রাহিম রায়িসি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পরে এই বিপুল বিজয় কিভাবে সম্ভব হলো?

Image Caption

আনওয়ারুল কবির: ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমরা সাধারণত ধারণা করে থাকি যে, এখানে দলভিত্তিক রাজনীতি হয়। কিন্তু আসলে দলভিত্তিক রাজনীতির বিষয়টি এখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করে নি। বাস্তবতা হচ্ছে আসলে ইরানে দলভিত্তিক রাজনীতির প্রচলন নেই। এখানে এমন কোনো দল নেই যাদেরকে আমরা বলতে পারি যে তাদের নিজস্ব মেনুফেস্ট রয়েছে। কিংবা জনগণের সামনে তারা নির্বাচনী ইশতেহার দেয় এবং জনগণ এর ভিত্তিতে ভোট দেয়। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে দুটো চিন্তাধারা রয়েছে- একটি রক্ষণশীল ও অন্য একটি উদারনৈতিক। গত চল্লিশ বছর ধরে এখানে নির্বাচনে কেউ দাবি করছেন আমরা উদারনৈতিক ধারার এবং অপর দলটি বলছে তারা রক্ষণশীল ধারার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দুটো দলের কোনোটাই আপামোর জনসাধারণের স্বার্থের পরিবর্তে তারা নিজেদের ক্ষমতা ও স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এ কারণে দুই ধারার প্রতি সবসময় দেখেছি যে জনগণের একটা অনীহা কাজ করে। আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতি দুই ধারারই ঝোঁক রয়েছে। সে কারণে যখনই ভিন্ন চিন্তাধারার কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছেন তখনই জনগণ তাকে সমর্থন জানিয়েছে। 

২০০৫ ও ২০০৯ এ দেখেছি ড.আহমাদি নেজাদ বিজয় লাভ করেছেন। তিনিও কিন্তু দুই ধারার কোনো ধারারই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তিনি স্বাতন্ত্র্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। আর জনগণ সে কারণে তাঁকে রায় দিয়েছিলেন। রায়িসির ক্ষেত্রেও আমরা সেকথা বলতে পারি। ইরানের জনগণের তাঁর প্রতি সমর্থনের কারণ হিসেবে আমরা বলতে বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণের অনীহা। এখানে রায়িসি’র যে নীতিমালা সেটাই মূখ্য ছিল। এক্ষেত্রে দলীয় চিন্তাধারা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে সেকথা আমরা বলতে পারি না।

রেডিও তেহরান: আমরা জানি যে গত নির্বাচনে তিনি রক্ষণশীল জোটের প্রার্থী ছিলেন। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন। এখানে আসলে মূল রাজনীতি বা কৌশলটা কি?

ড.রায়িসি

আনওয়ারুল কবির: আপনি ঠিকই বলেছেন, এখানে কৌশলের বিষয় রয়েছে। গত নির্বাচনে তাঁকে বলা হয়েছিল রক্ষণশীল দলের প্রার্থী ছিলেন। আসলে তিনি কিন্তু রক্ষণশীল ধারার প্রার্থী ছিলেন না। রক্ষণশীলদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন। যেমন ধরুন লারিজানি,মোহসেন রেজায়ি-এসব ব্যক্তি নিজেদের রক্ষণশীল বলে দাবি করতেন কিন্তু তারা সবসময় উদারপন্থিদের সাথে সমঝোতা করে তাদের নিজস্ব স্বার্থরক্ষা করতেন। এ কারণেই প্রচলিত রক্ষণশীল ধারার প্রতি জনগণের আগে থেকেই সমর্থন ছিল না। রায়িসি আনুষ্ঠানিকভাবে উদারনৈতিক কিংবা রক্ষণশীল কোনো ধারার সাথে কিন্তু কখনও যোগ দেন নি। তিনি সব সময় তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলেছেন। 

তিনি যখন প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন- তখন উভয়পক্ষের যারা দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিচারের বিষয়ে কাউকে ছাড় দেন নি। রায়িসি’র বিজয়ী হওয়ার পেছনে আমার কাছে যেটি মনে হয় সেটি হচ্ছে,তিনি গত দুই বছরে একটা বিশেষ রেকর্ড গড়েছেন। তারঁ গত ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের রাজনৈতিক জীবন এবং সরকারের বিভিন্ন পদে যে দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানে তিনি স্বচ্ছতা রক্ষা করেছেন। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর সেটিই জনগণের কাছে রায়িসির প্রতি একটা বিশেষ ইমেজ তৈরি করেছে।

রেডিও তেহরান: নির্বাচনে বিজয় লাভ করার পর সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি প্রথম সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন যে, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না। আমেরিকার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক নেই, ফলে সাক্ষাৎ বা বৈঠকের প্রশ্নও নেই। সেই জায়গায় এই নতুন ঘোষণার তাৎপর্য কি?

আনওয়ারুল কবির: দেখুন, আমেরিকার সাথে সরাসরি সম্পর্ক নেই এটি আমরা সরাসরি বলতে পারি না। গত আট বছর ধরে যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা আমেরিকার সাথে আলাপ আলোচনা করে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের একটা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সে কারণেই আসলে জনগণ রায়িসি’র প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। পাশাপাশি রায়িসি যেহেতু স্বনির্ভর নীতিমালায় বিশ্বাসী। তেল রপ্তানীভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সরিয়ে আনার পলিসি গ্রহণ করেছেন। তিনি অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তির উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিদেশ  নির্ভরতা কমিয়ে আনার স্লোগান তিনি দিয়েছেন। তার এসব স্লোগান ও নীতিমালা জনগণকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছে। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

তাছাড়া রায়িসি এটা বিশ্বাস করেন- আমেরিকার মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশের সাথে আলোচনা কখনও সম্ভব হতে পারে না কারণ তারা তাদের নীতিমালার প্রতি অটল থাকে না। গত আট বছর ধরে ইরানের শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু শক্তির ব্যবহার নিয়ে ৭ জাতিভিত্তিক যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল তেহরান তা মেনে চলেছে। অথচ আমেরিকা সেই আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে নিজের মতো করেই বের হয়ে গেছে। চুক্তির কোনো শর্ত তারা মেনে চলেনি। আন্তর্জাতিক নীতিমালার প্রতি আমেরিকার অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়টি এতে স্পষ্ট হয়েছে। 

রায়িসি মনে করেন, আমেরিকার সাথে যদি আমাদের বসতেই হয় তাহলে আমেরিকাকে প্রথমে আমাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। ইরানের উপর যেসব অর্থনৈতিকসহ নানা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেগুলো যদি উঠিয়ে নেয় এবং সমঝোতা চুক্তির ক্ষেত্রে সততার প্রমাণ দেয় তখন ইরান তাদের সাথে আলোচনা ও সহযোগিতার ক্ষেত্র এগিয়ে নেবে।

তবে ইরান তার দীর্ঘদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করতে চায় না। এর আগের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে ইরান দেখেছে আমেরিকা সবসময় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ফলে আমেরিকার প্রতি আস্থা অর্জন করার দ্বার তারাই রুদ্ধ করে দিয়েছে।

রেডিও তেহরান: প্রেসিডেন্ট রায়িসির বিজয়ের পর মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে ইরানের ভূমিকায় বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

আনওয়ারুল কবির: দেখুন, এ প্রশ্নের দুটো বিষয়কে আমি একটু আলাদা করে বলতে চাই। গণতান্ত্রিক সরকার যেসব দেশে আছে তাদের সাথে ইরানের নীতি একরকম আর যারা রাজনৈতিক আগ্রাসী কিংবা হস্তক্ষেপমূলক নীতির সরকার তাদের সাথে নীতি ভিন্ন। আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- ইরাক, লেবানন, তুরস্ক, কাতার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা আজারবাইজানের সঙ্গে ইরানের পূর্ব থেকেই সুসম্পর্ক রয়েছে। আর এসব মুসলিম দেশের সাথে ভ্রাতৃত্বমূলক এবং সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের নীতি ইরান সবসময় মেনে চলেছে। আর এখন রায়িসি প্রেসিডেন্ট হওয়ার ফলে সেই সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। রায়িসি কখনই সাংঘর্ষিক নীতি গ্রহণ করবেন না। মুসলিম বিশ্বের সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য নিয়ে বারবার তিনি তার আলোচনায় গুরুত্বারোপ করেছেন। মুসলিম দেশের সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিকসহ অন্যান্য সম্পর্ক সুদৃঢ় করার বিষয়ে তিনি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। সুতরাং এটি ইতিবাচক লক্ষণ বলে আমি মনে করি।

রেডিও তেহরান: তো জনাব আবুল কাশেম মো. আনোয়ার কবির, ইরানে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সৈয়দ ইব্রাহিম রায়িসি’র ভূমিধস বিজয়, আমেরিকার সাথে ইরানের সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রভাব নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। #

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৩  

ট্যাগ