জুলাই ১৬, ২০২১ ১৭:২৩ Asia/Dhaka

আজ আমরা পশ্চিমা সমাজের অন্য আরেকটি সমস্যা নিয়ে কথা বলব। পাশ্চাত্যের বেশিরভাগ দেশে মদপান একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

অবশ্য এদের মধ্যেও অনেকেই আছেন ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মদপান করেন না এবং তারা মদকে শয়তানের পানীয় হিসেবে বিবেচনা করে। যেমন আমেরিকার ইউটা অঙ্গরাজ্যের মরমন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষেরা মদকে নিষিদ্ধ পানীয় বলে বিশ্বাস করে। বলা হয়ে থাকে, বর্তমানে বিশ্বে ব্যবহৃত পানীয়গুলোর মধ্যে মদের অবস্থান তৃতীয়। অর্থাৎ কফি এবং চায়ের পরেই মদের অবস্থান। এই সপ্তাহের পর্বে আমরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মদের ব্যাপক ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করব।

অ্যালকোহল এমন একটি পদার্থ যা মানুষের চেতনা, উপলব্ধি ও আচরণের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বিশ্বে ৩০ লাখ লোক মদপানের কারণে মারা যায়।  এটি সড়ক দুর্ঘটনা এবং এইডসে প্রাণ হারানো মানুষের মোট সংখ্যার চেয়েও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের দুইশ ধরণের রোগের কারণ হচ্ছে মদ।  মদপানের কারণে মানুষের নানা ধরণের সমস্যা হতে পারে: এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মানসিক ও আচরণগত সমস্যা, লিভারের জটিল রোগ, কিছু ক্যান্সার ও হৃদরোগ। এছাড়া মাতাল হয়ে দুর্ঘটনাসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি  হতে পারে মদপানের কারণে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে,  বিশ্বের ৫ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী হচ্ছে এ মদ। আর ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে মদের কারণে মৃত্যুর হার প্রায় ১৩ শতাংশ। মদের কারণে প্রতি বছর যে ৩০ লাখ লোক মারা যায় তার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা মহিলাদের তিনগুণ।

এসব মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশই ঘটে মদপানের প্রভাবে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা এবং সংঘর্ষের কারণে। এরপরই রয়েছে মদ্যপায়ীদের মধ্যে পেটের পীড়া ও হৃদরোগের মতো নানা সমস্যা যা তাদের মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। মদ্যপায়ীরা দ্রুত পেট ও হৃদযন্ত্রের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয় এবং এ কারণে মৃত্যুর হারও তাদের মধ্যে বেশি। বর্তমানে বিশ্বে ২৩ কোটি পুরুষ ও পাঁচ কোটি নারী মদপানের কারণে নানা জটিলতায় ভুগছেন। এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলো ইউরোপ মহাদেশে। মজার বিষয় হলো ইউরোপের যেসব দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেশি সেসব দেশে এই সমস্যা তুলনামূলক বেশি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপ মহাদেশের পরিবারগুলোতে মদপানের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই এই মহাদেশে মদপানজনিত কারণে মৃত্যুর হার বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। ইউরোপের মধ্যে বাল্টিক অঞ্চলের যেসব দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য সেখানকার পরিবারগুলোর বড় অংশই তাদের আয়ের বেশিরভাগ মদপানে ব্যয় করে।  ইউরোস্ট্যাট স্ট্যাটিস্টিকস সেন্টার থেকে প্রকাশিত নতুন তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মানুষেরা মদ কিনতে ১৩০ বিলিয়ন ইউরো বেশি ব্যয় করেছে। ব্রিটিশ চিকিৎসকদের মতে, মদের ক্ষতিকারক দিক অনেক ক্ষেত্রে মাদকের চেয়েও বেশি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার ডিজিজের অধ্যাপক রাজিও জালান মনে করেন, ইউরোপে মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশের জন্য মদপান দায়ী। তার মতে, এত বেশি মৃত্যুর পরও ইউরোপ মদপান ঠেকাতে আন্তরিক কোনো নীতি ও কর্মপ্রণালী প্রণয়ন করেনি। 

তিনি বলেছেন, ইউরোপের ১৬ বছর বয়সী যেকোনো নাগরিক নির্দিধায় মদ পান করতে পারে।  এ কারণে ইউরোপের ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী  ৪৪ শতাংশ মানুষ মদ্যপানে আসক্ত এবং কিশোর-কিশোরীরা স্কুলের বিভিন্ন পার্টিতেও মদ পান করে। ব্রিটিশ গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বেআইনিভাবে মদপান ও মাদক ব্যবহারের কারণে  স্কুল থেকে বহিষ্কার হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। স্কাই নিউজ এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, ২০১৬ থেকে  ২০১৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ স্কুল থেকে ৭৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিন গড়ে ২০ জন করে শিক্ষার্থী ব্রিটিশ স্কুল থেকে বহিষ্কার হচ্ছে। উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে পরিচালিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে ব্রিটেনের উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে মদপান এবং মাদক সেবনের কারণে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৭ শতাংশ বেড়েছে।

১৯৯০ এর দশকে অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় সেবনের পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে। তখন বলা হয়েছে, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় শরীরের জন্য ভালো। এই প্রচারের কারণে সে সময় অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় তৈরির কোম্পানিগুলো ব্যাপক মুনাফা করেছে।  ফরাসি ডা. রেনাউদ দাবি করেছিলেন যে,  ফ্রান্সের মানুষের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। কেউ কেউ এটাকে এই বলে প্রচার চালায় যে, মদপানের কারণে এমনটা হচ্ছে।  কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই গবেষণা কেন্দ্রগুলো ব্যাপক গবেষণার পর জানায় যে, মদপানের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি এ তথ্যও বেরিয়ে আসে যে, ফ্রান্সে হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ফরাসিদের হার্ট বা হৃদযন্ত্র বেশি সুস্থ এমন ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন বলে গবেষকরা জানান। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, মদ মানেই ক্ষতি। মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। মদ পান করলে ক্ষতি হবেই।

গবেষকরা ঐবারই প্রথম একসুরে এমন স্বীকারোক্তি দেন। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ নামের বৈশ্বিক উদ্যোগের গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়। আমেরিকার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিকস এই বৈশ্বিক উদ্যোগের প্রধান কার্যালয় হিসেবে কাজ করেছে। গবেষণায় অর্থায়ন করেছে আমেরিকার বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে প্রতি তিনজনে একজন মদ পান করে। অপরিণত বয়সে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার জন্য সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস মদ্যপান। প্রতিবছর ২৮ লাখ মানুষ মারা যায় মদের কারণে।  ব্রিটেন ভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট'র প্রবন্ধেও এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১৯৫টি দেশে মদের ব্যবহার, অসুস্থতা ও মৃত্যুর তথ্য এতে বিশ্লেষণ করা হয়। এতে গবেষকেরা স্পষ্টভাবে একসুরে বলেছেন, মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ