জুলাই ২৩, ২০২১ ২১:১৩ Asia/Dhaka

রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি দুর্ঘটনা নয়; এটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। ভবনের মেশিনগুলো রক্ষা পেল; মারা গেল শুধু মানুষ! রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার যুগ্ম সম্পাদক, নগরপরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব।

তিনি আরও বলেন, যেসব ভবন শ্রমিকের জন্য মৃত্যুকূপ তৈরি করে রাখে সেইসব ভবন পুড়ে খাক হওয়া উচিত। আমাদের নগর জীবনে ঐসব ভবন ধূলিসাৎ হওয়া উচিত।

স্থপতি ইকবাল হাবিব

তিনি আরও বলেন, এর আগেও এ ধরণের হত্যাকাণ্ডের কোনো ধরণের বিচার  না হওয়ার সংস্কৃতি রয়েছে। আমি মনে করি সে কারণেই আমরা মৃত লাশের উপর জাতীয় জীবনের জুস গ্রহণ করার সংকল্প করেছি। তবে এ ধরণের ঘটনার দায় সরকারকেই নিতে হবে। 

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি উপস্থাপনা, গ্রহণ ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব ইকবাল হাবিব, সম্প্রতি নারাগণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের 'হাসেম ফুড' কারাখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন কর্মী পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। মর্মান্তিক ঐ ঘটনা সম্পর্কে কি বলবেন, নিছক দুর্ঘটনা বলবেন?

ইকবাল হাবিব: ঐ ঘটনায় যাঁদের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাঁদের বিদেহী আত্মার প্রতি আমার সহানুভূতি ও তাঁদের মাগফেরাত কামনা করছি। তাঁদের পরিবারের প্রতিও সহানুভূতি জানাচ্ছি। কিন্তু এটিকে আমি দুর্ঘটনা হিসেবে দেখতে রাজি নই।

 

রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি

আমি মনে করি এটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। আপনি মর্মান্তিক বলেছেন-আমিও আপনার সাথে একমত। তবে ভবনটি পুড়ে যাওয়ায় আমি কোনো মর্মান্তিক বিষয় দেখি না-কারণ এরকম ভবন আমাদের নগর জীবনে থাকাই উচিত না। যেসব ভবন তার শ্রমিকের জন্য মৃত্যুকূপ তৈরি করবে সেই ভবনের টিকে থাকা আমরা চাইব না। অবশ্যই তা ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া উচিত। পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া উচিত।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এই ভবনটি গুদাম হিসেবে তৈরি হওয়ার পর গত পাঁচ/ছয় বছর আগে কারখানায় পরিণত হলো কিভাবে? রাজনধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সীমানার মধ্যে থাকার পরও সেটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনুমোদিত হলো! ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি ছাড়া কারাখানা কিংবা গুদাম করার কোনো সুযোগ নেই-তারপরও তা হলো!

শিল্প এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের সার্টিফিকেশন ছাড়া কোনো কারখানা চলার কথা নয়; সেটিও হলো! পরিদর্শকদের পরিদর্শন ছাড়াই এখানে পনের বছরের কিশোর কিশোরীদেরকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার ব্যবস্থা করে দিল!

তারপর যখন আগুন পুড়ে গেল ভবনটি তখন সব দোষ কেষ্ট ব্যাটার অর্থাৎ যারা মারা গেল তাদেরই দায়! এর প্রধান কারণ আমরা ইনডেমনিটির একটা অস্বচ্ছতায় ভুগছি। ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যা করার পর আমরা ভেবেছি ইনডেমনিটির মাধ্যমে হজম করা সম্ভব। যদিও তার বিচার আমরা করেছি। কিন্তু সর্বতো দায়িত্ব কাণ্ডজ্ঞানহীন এবং দায়বদ্ধতাবিহীন কর্মকাণ্ড সর্বজনগৃহীত হচ্ছে। এই ভবনের আগে তাজরীনসহ গত দেড় বছরে আরও তিনটি ভবন পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে কিন্তু ঐসব হত্যাকাণ্ডের কোনো ধরণের বিচার  না হওয়ার সংস্কৃতি রয়েছে। আমি মনে করি সে কারণেই আমরা মৃত লাশের উপর জাতীয় জীবনের জুস গ্রহণ করার সংকল্প করেছি। এই ধরণের কাজকে আমি আবারও বলছি হত্যাকাণ্ড হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, দায় নিতে এবং সংশ্লিষ্ট সকলের বিচার করতে হবে।

রেডিও তেহরান: রূপগঞ্জের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মতো গত ১১ বছরে  খুবই আলোচিত ৫ টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। তারমধ্যে নিমতলী,চকবাজারের চুড়িহাট্টা,আশুলিয়ায় তাজরীন পোশাক শিল্প, নারায়ণগঞ্জের তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণ-একেরপর এক এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটছে-এসব ঘটনার দায় কার?

রূপগঞ্জ

ইকবাল হাবিব: দেখুন, একেবারে পরিষ্কার করে বলি, আমাদের সংবিধানে বলা আছে- জানমালের নিরাপত্তার জন্য সরকারকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। যদি সেটি হয় তাহলে এসব ঘটনার দায় সরকারকেই নিতে হবে। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু সরকার মানে কোনো ব্যক্তি কিংবা বিশেষগোষ্ঠী না। সংশ্লিষ্ট যেকোনো সংস্থা, অধিদপ্তর অথবা কর্তৃপক্ষ আগুনে পুড়ে যাওয়ার কার্যক্রম বিনা বাধায় যেতে দিলেন,বৈধতা দিলেন অথবা দেখেও না দেখার ভান করছে-তাদেরকে এর দায় নিতে হবে। আর সে দায় শুধুমাত্র দায়িত্বহীন আচরণের দায় হিসেবে মানতেও রাজী নই। আমি মনে করি এই দায় হত্যাকাণ্ডের দায় হিসেবে দেখতে হবে।

জানমালের নিরাপত্তার কথা বলে সরকার কিন্তু অজস্র মানুষকে জেলে ভরতে পারে, যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে, যে কাউকে গুলি করে হত্যাও করতে পারে। সরকারের কাছে এতটা ক্ষমতা দেয়ার পরও তাদের ব্যর্থতা-যদি অপারগতা হয় তবে তো আমাদের সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন করতে হয়। সে কারণে এককভাবে কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে দায়ী না করে সরকারকেই দায়মোচনের দায়িত্ব নিতে হবে।

রেডিও তেহরান: রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি পুড়ে অঙ্গার হওয়া ৫২ জনের মধ্যে  অর্ধেক শিশু। দেশে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। শিশু অধিকারের কথা বলা হচ্ছে,মানবাধিকারের কথা বলা হচ্ছে অথচ শিশুরা মারা যাচ্ছে কারখানার আগুনে পুড়ে..এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?

ইকবাল হাবিব: দেখুন, শিশুদের জন্যই সরকার শিশু মন্ত্রণালয় তৈরি করেছেন। এইসব আইনবহির্ভূত কার্যক্রম রদ করার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় তৈরি করেছেন এবং কারখানাগুলোতে যাতে এসব ঘটনা না ঘটে সেজন্য শ্রম মন্ত্রাণায়ের পাশাপাশি শিল্প মন্ত্রণালয় এসব কারখানা পরিদর্শনের জন্য আলাদা অধিদপ্তর তৈরি করেছে। দেখুন তিন তিনটি অধিদপ্তর থাকা সত্ত্বেও  এই সেক্টরে শিশু শ্রম বন্ধ হচ্ছে না। যাদের অবহেলায়; যাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন কার্যক্রমের জন্য এসব হচ্ছে তাদের প্রত্যেককে জেলে ভরা দরকার। তাদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনা দরকার। 

রেডিও তেহরান: জনাব ইকবাল হাবিব, সবশেষে যে বিষয়টি জানতে চাইব- এই রূপগঞ্জের মর্মান্তিকভাবে আগুনে পুড়ে ৫২ জন মারা গেল। গত ১১ বছরে ৫ টি আলোচিত অগ্নিকাণ্ডে শত শত মানুষ মারা গেছে। সেজন্য ৯ রিট হয়েছিল। এবারও মামলা হয়েছে। কিন্তু আগের সেসব রিটের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আজও হয়নি। তো এই যে প্রান্তিক মানুষগুলো মারা গেলেন , আপনি বিচারহীনতার বিষয়টিও বলছিলেন..তো তারা আসলে কি বিচার পাবে?

ইকবাল হাবিব: দেখুন, আমি এই সেক্টরে অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে বিচার করা সম্ভব। তবে করার জন্য আমাদেরকে ঐ ধরণের ট্রাইবুনাল গঠন করা দরকার। প্রয়োজনে বিচারবিভাগীয় কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে বিচারহীন সংস্কৃতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাটাও সমান্তরালভাবে করা প্রয়োজন। তবে আমরা যেহেতু কোনো না কোনো জায়গায় পেরেছি ফলে এখানে না পারার কোনো অজুহাত আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। আর পঞ্চাশ হাজার এক লাখ টাকা জরিমানার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে পঞ্চাশ লাখ এক কোটি টাকার জরিমানার সংস্কৃতিতে যাওয়া উচিত। কারণ শিল্পপতিদের কারখানার মেশিন পত্রের সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে-কেবল মারা গেল মানুষ। এটা যে কতবড় অন্যায়! এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

রেডিও তেহরান: তো জনাব, ইকবাল হাবিব-রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি-৫২ জনের মৃত্যু,অনিয়ম, দায়হীনতার সংস্কৃতি, বিচারহীনতাসহ সামগ্রিক প্রেক্ষাপট নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ইকবাল হাবিব:  আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।

আর শ্রোতাবন্ধুরা! সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি রূপগঞ্জ ট্রাজেডিতে মারা যাওয়া মানুষগুলোর জন্য।তারা ন্যায় বিচার পাক সেই প্রত্যাশা থাকছে।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৩

ট্যাগ