জুলাই ৩১, ২০২১ ১৮:৪০ Asia/Dhaka

যুদ্ধের পরিণতিকে নিজের অনুকূলে আনার জন্য ইরান ১৯৮৬ সালে কারবালা-৪ নামের যে অভিযান চালায় তা ব্যর্থ হয়। ইরাক স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় উল্লসিত হয় এবং বাগদাদে আতশবাজি ফুটিয়ে ও ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিজয়ের উল্লাস করে সাদ্দাম সরকার।

ইরানের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একথার জানান দেয়া হয় যে, ইরানিরা দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রন্টে বড় ধরনের মার খেয়েছে। সেইসঙ্গে ইরাক একথা ভাবতে শুরু করে যে, তার পক্ষে ইরানের যেকোনো অভিযান প্রতিহত করা সম্ভব। এদিকে ইরান বড় ধরনের চূড়ান্ত অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে পশ্চাদপসরণ করায় অন্য কারো পক্ষে সেকথা উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি। দৈনিক ইন্ডিপেন্টেন্ড এ সম্পর্কে লিখেছে, “এটি বড় ধরনের একটি অভিযান হলেও এটিকে কোনো অবস্থায় চূড়ান্ত হামলা বলে ধরে নেয়া যায় না। ইরান এই এলাকায় বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করলেও তাদের বেশিরভাগই অভিযানে অংশ নেয়নি।”

এদিকে ইরানি কর্মকর্তারা একথা ধরে নেন যে, কারাবালা-৪ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার কারণে বাগদাদ এই ভেবে নিশ্চিন্ত রয়েছে যে, এ বছর আর ইরানের পক্ষ থেকে বড় ধরনের কোনো অভিযান চালানো হবে না।  গোয়েন্দা তথ্যও বলছে, ইরানের পক্ষ থেকে বিপদ কেটে গেছে মনে করে ইরাকের সাদ্দাম সরকার তার বেশিরভাগ সেনা কমান্ডারকে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই তথ্য পাওয়ার পর ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি একই এলাকায় কারবালা-৫ নামের আরেকটি অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেয়। ইরাক-ইরান আট বছরের যুদ্ধের অন্যতম জটিল, কঠিন ও স্মরণীয় অভিযান ছিল কারাবালা-৫। যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় দেড় বছর আগে ইরানের খোররামশাহরের পশ্চিমে দু’দেশের সীমান্তবর্তী শালামচে অঞ্চল দিয়ে ইরাকের বসরা অভিমুখে এ অভিযান চালানো হয়।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি ১৯৮৭ সালের ৯ জানুয়ারি মধ্যরাতে কারবালা-৫ অভিযান শুরু করে। এবারের অভিযান চালানো হয় সীমিত কিছু এলাকায়। ১০ থেকে ১৩ কিলোমিটার চওড়া এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে ইরাকের ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ইরাকিরা এই এলাকায় আবার কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করে মাছচাষের প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বলে ইরানি যোদ্ধাদের পক্ষে অভিযান চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। মাছচাষের প্রকল্পটির দৈর্ঘ্য ছিল এক থেকে দেড় কিলোমিটার। শালামচে নামক এই এলাকার এক কিলোমিটার অভ্যন্তরে ঢুকতে পারার গুরুত্ব ছিল ইরাকের অন্য যেকোনো অঞ্চল দিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করতে পারার সমান। কাজেই কারবালা-৫ অভিযানের সামরিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ইরাকিদের এ বিষয়টি জানা ছিল বলে শালামচে অঞ্চলের প্রতিরক্ষার জন্য তারা যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল।

কারবালা-৫ অভিযানের আগে ইরান শালামচে অঞ্চল দিয়ে প্রায় আটবার ইরাকে প্রবেশ করার চেষ্টা চালায়। যুদ্ধের আট বছরের পুরোটা সময় জুড়ে বসরা দখল করা ছিল ইরানের প্রধান কৌশলগত লক্ষ্য। ইরান যখন নিজের দখল হয়ে যাওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার করে ইরাকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় তখন বসরা দখলের পরিকল্পনা আরো জোরদার হয়। কিন্তু বসরা দখলের জন্য শালামচে’র যে অঞ্চল দিয়ে ইরাকে ঢুকতে হবে সেখানে কঠোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল ইরাকিরা। ফলে সেখানকার কাঁটাতারের বেড়া ও অসংখ্য স্থলমাইন ভেদ করে ইরাকে অনুপ্রবেশ করা ছিল অনেকাংশে অসম্ভব। কিন্তু ইরানের সমরবিদরা গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কারবালা-৪ অভিযানের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরেকটি অভিযান চালানো সম্ভব হলে ইরাকিদেরকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে তাতে সাফল্য পাওয়া সম্ভব। 

এর কারণ হিসেবে তারা মনে করেন, ওই অভিযানের পর কয়েকদিন ইরাকি সেনাদেরকে ফ্রন্টে মোতায়েন রাখা হয় এবং এরমধ্যে ইরান আর অভিযান না চালানোয় তার ধরে নেয় ইরান আপাতত আর এই অঞ্চল দিয়ে অভিযান চালাবে না।  এ কারণে ইরাকি সেনাবাহিনীর প্রায় ৪০ শতাংশ জওয়ানকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদিকে ইরানি সেনা কমান্ডাররা কারবালা-৪ অভিযান চালাতে গিয়ে ইরাকিদের দুর্বল অবস্থানগুলো জেনে গিয়েছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন শালামচে’র কোন অঞ্চলে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ দুর্বল।

আগেই বলেছি, কারবালা-৫ অভিযানের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বসরার যতটা সম্ভব কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া। ইরাকি সেনাবাহিনীর বড় রকমের ক্ষতি করে সাদ্দাম সরকারের ওপর বিশাল রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা ছিল এই অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য।

ইরাকের সর্বদক্ষিণের ফাও উপত্যকা আগে থেকে ইরানের দখলে থাকায় কারবালা-৫ অভিযান সফল হলে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলকে সেদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করে ফেলা সম্ভব হতো। আর তা করা গেলে আট বছরব্যাপী এই যুদ্ধের আগ্রাসী শক্তি হিসেবে ইরাককে চিহ্নিত করে তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার পথ পরিষ্কার হয়ে যেত। ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারকরা এ বিষয়টি মাথায় নিয়েই আইআরজিসিকে কারবালা-৫ অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। তারা ভাবেন, বসরার নিকটবর্তী শালামচে দখল করে ইরাকের বৃহত্তম তেলসমৃদ্ধ শহর বসরাকে হুমকিগ্রস্ত করতে পারলেই ইরানের ওই রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ৩১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ