আগস্ট ০২, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা দুখান নিয়ে আলোচনা করব। এই সূরায় ৫৯টি আয়াত রয়েছে। এবার এই সূরার ৯ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৯-১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

بَلْ هُمْ فِی شَکٍّ یَلْعَبُونَ ﴿٩﴾ فَارْتَقِبْ یَوْمَ تَأْتِی السَّمَاءُ بِدُخَانٍ مُبِینٍ ﴿١٠﴾ یَغْشَى النَّاسَ هَذَا عَذَابٌ أَلِیمٌ ﴿١١﴾

“তারা বরং সন্দেহের বশবর্তী হয়ে খেলতামাশা করছে।”(৪৪:৯)

“অতএব আপনি অপেক্ষা করুন সে দিনের যেদিন স্পষ্ট ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হবে আকাশ।” (৪৪:১০)

“[যে ধোঁয়া] সকল মানুষকে আবৃত করে ফেলবে। এটা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”(৪৪:১১)

গত আসরে পবিত্র কুরআন নাজিল ও নবী-রাসূলদের নবুওয়্যাত প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, মহান আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়াপরবশ বলেই তাদেরকে হেদায়েত করার জন্য নবী ও কিতাব পাঠিয়েছেন। এরপর আজকের এসব আয়াতে বলা হয়েছে: কিন্তু কিছু মানুষ সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও তা মেনে নিতে রাজি নয় এবং তারা সব সময় নিজেদের পাশাপাশি অন্যদেরকেও সংশয় ও সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে। তারা এই সংশয় দূরে করে সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো সংশয় সৃষ্টিকারী বিষয় নিয়ে মেতে থাকে এবং আসমানি কিতাবের শিক্ষা নিয়ে খেলতামাশা করে।

এরপর এই গোঁয়ার প্রকৃতির ও কঠিন হৃদয়ের কাফেরদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলা হচ্ছে, যখন তোমরা ঐশী শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তোমাদের চোখের সামনে থেকে উদাসীনতার পর্দা সরে যাবে এবং নিজেরা যে মহাভুলে ডুবে ছিলে তা উপলব্ধি করতে পারবে। তখন তোমরা বুঝতে পারবে, নবী-রাসূলগণ যা বলেছিলেন সেটাই সত্য ছিল।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- সন্দেহ ও সংশয় যেন আমাদেরকে সত্য সম্পর্কে উদাসীন করে না তোলে। যেকোনো বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়া বা মনে খটকা লাগা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই সংশয়ে ডুবে থাকা অন্যায়। তবে চিন্তা-গবেষণা করে সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য কোনো বিষয়ে মনে সংশয় তৈরি হলে তাতে দোষের কিছু নেই।

২- ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করা যাদের কাজ তাদের কথায় মত্ত হয়ে কুরআনের আয়াত নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করলে আল্লাহর কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

সূরা দুখানের ১২ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

بَّنَا اکْشِفْ عَنَّا الْعَذَابَ إِنَّا مُؤْمِنُونَ ﴿١٢﴾ أَنَّى لَهُمُ الذِّکْرَى وَقَدْ جَاءَهُمْ رَسُولٌ مُبِینٌ ﴿١٣﴾ ثُمَّ تَوَلَّوْا عَنْهُ وَقَالُوا مُعَلَّمٌ مَجْنُونٌ ﴿١٤﴾

“[তখন তারা বলবে]- হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের থেকে এই শাস্তি সরিয়ে দিন, আমরা ঈমান আনব।”(৪৪:১২)

“কিন্তু এই স্বীকারোক্তি ও উপদেশ গ্রহণ তাদের কী কাজে আসবে? অথচ ইতঃপূর্বে তাদের কাছে সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী রাসূল এসেছিল।”(৪৪:১৩)

“তখন তারা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং বলেছিল: এ এক শিক্ষাপ্রাপ্ত পাগল!”(৪৪:১৪)

আল্লাহ তায়ালার শাস্তি দেখার পর ভয় ও আতঙ্ক কাফেরদের গোটা অস্তিত্বকে গ্রাস করে ফেলবে। তখন তারা আল্লাহমুখী হবে এবং বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের কাছ থেকে শাস্তি দূর করে দিন, আমরা ঈমান আনব। অথচ এটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক ভয় থেকে উৎসারিত ঈমান যার কোনো মূল্য নেই। প্রকৃতপক্ষে সেই ঈমান আল্লাহর কাছে মূল্যবান যা মানুষ কোনো চাপ বা ভয়ের মুখে নয় বরং স্বাধীনভাবে গ্রহণ করে।

পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: এখনকার এই উপলব্ধি ও প্রত্যাবর্তন তোমাদের কোনো কাজে আসবে না। কারণ, যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) মুজিযা ও সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছিল তখন তার নির্দেশ মেনে এক আল্লাহতে ঈমান আনার পরিবর্তে তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে। তখন তাঁর বক্তব্যকে আল্লাহর বাণী বলে মেনে নিতে তোমরা অস্বীকার করেছিলে। কখনো তোমরা বলতে: তার সঙ্গে জিনদের সম্পর্ক আছে এবং সে জিনদের শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়ায়। কখনো বলতে: সে অন্যদের কাছ থেকে এসব কথা শিখে এসে কথাগুলো আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছে!

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:

১- আজ যারা ধর্মকে উপহাসের পাত্র বানিয়েছে তারা একদিন সত্য উপলব্ধি করবে ও অনুতপ্ত হবে। সেদিন তারা আবার দুনিয়াতে ফিরে আসার আবেদন জানাবে কিন্তু সেই আবেদন মঞ্জুর হবে না।

২- নবী-রাসূলদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে কাফেররা যুক্তি উপস্থাপন করার পরিবর্তে অপবাদ আরোপ ও মূল্যহীন কথাবার্তা বলে নবীদের ব্যক্তিত্বে আঘাত হানে।

সূরা দুখানের ১৫ও ১৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

إِنَّا کَاشِفُوا الْعَذَابِ قَلِیلا إِنَّکُمْ عَائِدُونَ ﴿١٥﴾ یَوْمَ نَبْطِشُ الْبَطْشَةَ الْکُبْرَى إِنَّا مُنْتَقِمُونَ ﴿١٦﴾

“অবশ্য আমি কিছুকালের জন্য শাস্তি সরিয়ে নেব।  [কিন্তু তখন] তোমরা [আবার] আগে যা করছিলে সেই কাজে ফিরে যাবে।”(৪৪:১৫)

“যেদিন আমি তাদেরকে প্রবলভাবে পাকড়াও করব, নিশ্চয় [সেদিন] আমি হবো প্রতিশোধ গ্রহণকারী।”(৪৪:১৬)

এই আয়াতে বলা হচ্ছে: আমি তাদের কাছ থেকে কিছু সময়ের জন্য শাস্তি দূরে রাখা সত্ত্বেও তারা শিক্ষা গ্রহণ করে না। তারা আবার তাদের কুফরি ও খারাপ কাজে ফিরে যায়। তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা যায় না।

অন্য কথায় তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পর যদি অনুতপ্ত হয় ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে তাহলেও সেটা ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু যখনই ঘুর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দূর হয়ে যায় তখনই তারা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কাজেই ভয় পেয়ে তারা ঈমান আনার যে দাবি করে তা অর্থহীন।  পার্থিব জগতে যদি তাদের শাস্তি কমিয়ে দেয়াও হয় পরকালে তাদের জন্য কঠিন আজাব অপেক্ষা করছে। কারণ জালিমরা আল্লাহকে ক্ষুব্ধ করেছে এবং তাঁর শাস্তি থেকে তারা রেহাই পাবে না।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- আল্লাহ তায়ালা অসংখ্যবার এই দুনিয়াতে আমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও আমরা আমাদের পাপকাজ বন্ধ করিনি।

২- মহান আল্লাহ নবী-রাসূল ও মুমিন বান্দাদের প্রতি দয়াপরবশ হন। পক্ষান্তরে তাঁর প্রিয় বান্দাদের প্রতি জুলুম করার কারণে কাফের ও জালিমদের কাছ থেকে তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ করেন।

সূরা দুখানের ১৭ও ১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 وَلَقَدْ فَتَنَّا قَبْلَهُمْ قَوْمَ فِرْعَوْنَ وَجَاءَهُمْ رَسُولٌ کَرِیمٌ ﴿١٧﴾ أَنْ أَدُّوا إِلَیَّ عِبَادَ اللَّهِ إِنِّی لَکُمْ رَسُولٌ أَمِینٌ ﴿١٨

“আর অবশ্যই আমি এদের আগে ফিরাউন সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছিলাম এবং তাদের কাছেও এসেছিলেন এক সম্মানিত রাসূল।”(৪৪:১৭)

“(তিনি ফিরআউনকে বলেছিলেন) আল্লাহ্‌র বান্দাদেরকে আমার হাতে তুলে দাও। নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল।”(৪৪:১৮)

মক্কার কাফেরদের নিন্দনীয় আচরণের কথা বর্ণনার পর এই দুই আয়াতে ফেরাউন সম্প্রদায় ও হযরত মূসা (আ.)-এর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। ফেরাউন সম্প্রদায়ের যেমন ছিল শক্তিশালী শাসক, তেমনি আল্লাহ তাদেরকে দিয়েছিলেন ধন-সম্পদে প্রাচুর্য। কিন্তু শক্তি, ক্ষমতা ও প্রাচুর্য তাদেরকে অহংকারী করে তোলে এবং তারা নানারকম গোনাহ ও পাপকাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এমন একটি সময়ে হযরত মূসা (আ.) ফেরাউনের কাছে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে আগমন করেন। তিনি অত্যন্ত ভদ্রজনচিত ভাষায় ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গকে বলেন, তারা যেন বনি-ইসরাইল জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেয়। আল্লাহর নবী বলেন, বনি-ইসরাইল জাতিকে হেদায়েতের পথে পরিচালনা করার জন্য তাদের স্বাধীন জীবন প্রয়োজন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- নবী-রাসূলদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে অত্যাচারী ও জালিম শাসকের হাত থেকে মুক্তি দেয়া। কাজেই হযরত মূসা (আ.) তাঁর নিজ জাতি বনি-ইসরাইলের কাছে হেদায়েতের বাণী পৌঁছে দেয়ার আগে তাদের মুক্তির জন্য ফেরাউনের দরবারে গমন করেন।

২- সব যুগে নবী-রাসূলগণ ছিলেন সাধারণ মানুষের আস্থাভাজন ও জনপ্রিয় ব্যক্তি। সদাচরণের কারণে নবুওয়াত প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত তাদেরকে সবাই ভালোবসত। নবুওয়াত প্রাপ্তির পর একদল মানুষ সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র গোয়ার্তুমির কারণে নবীদের সঙ্গে যে শত্রুতা করত সেটা ভিন্ন কথা।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ