আগস্ট ০২, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা দুখান নিয়ে আলোচনা। এই সূরায় ৫৯টি আয়াত রয়েছে। এবার এই সূরার ২৮ থেকে ৩৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৮-২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

کَذَلِکَ وَأَوْرَثْنَاهَا قَوْمًا آخَرِینَ ﴿٢٨﴾ فَمَا بَکَتْ عَلَیْهِمُ السَّمَاءُ وَالأرْضُ وَمَا کَانُوا مُنْظَرِینَ ﴿٢٩﴾

 “এরূপ [ঘটনা]ই ঘটেছিল এবং আমি তাদের [সকল সম্পদের] উত্তরাধিকারী করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে।”(৪৪:২৮)

“অতঃপর আকাশ ও পৃথিবী ওদের জন্যে অশ্রুপাত করেনি এবং ওদেরকে অবকাশও দেওয়া হয়নি।”(৪৪:২৯)

ফেরাউনের ঘটনার শেষাংশে এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: ফেরাউন ও তার সঙ্গীরা নীলনদে ডুবে মারা গেলে তাদের রেখে যাওয়া ক্ষমতার মসনদ, সম্পদ ও রাষ্ট্র বনি ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বনি ইসরাইল জাতি বিনাশ্রমে একটি বিশাল দেশ ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়। সূরা শুয়ারায় যেমনটি বলা হয়েছে: ফেরাউনের পতন হওয়ার পর বনি ইসরাইল জাতির একাংশ মিশরে ফিরে যায় এবং সেখানকার রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে। এর পরের আয়াতে বলা হচ্ছে, নিজ দেশের জনগণ ও বনি ইসরাইল জাতির উপর ফেরাউনের অত্যাচার এত বেশি ছিল যে, যখন সে পৃথিবীর বুক থেকে সমূলে উৎপাটিত হয়ে যায় তখন তার জন্য কারো মন কাঁদেনি এবং তার জন্য এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলার মতো কোনো মানুষ পৃথিবীতে ছিল না। তার মৃত্যুতে আসমান ও জমিন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে এবং বিন্দুমাত্র ব্যথিত হয়নি।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- অত্যাচারী শাসকদের পতন আল্লাহ তায়ালার একটি চিরায়ত রীতি যাতে সব যুগের মানুষের জন্য রয়েছে শিক্ষা।

২- সৃষ্টিজগতের সবকিছুর মধ্যে অনুভূতি ও চেতনা রয়েছে। শুধু মানুষ নয় বরং জড়ো পদার্থগুলির মধ্যেও অত্যাচারী ও জালিম মানুষদের মৃত্যুতে সুখানাভূতি সৃষ্টি হয়।

সূরা দুখানের ৩০ থেকে ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَلَقَدْ نَجَّیْنَا بَنِی إِسْرَائِیلَ مِنَ الْعَذَابِ الْمُهِینِ ﴿٣٠﴾ مِنْ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ کَانَ عَالِیًا مِنَ الْمُسْرِفِینَ ﴿٣١﴾ وَلَقَدِ اخْتَرْنَاهُمْ عَلَى عِلْمٍ عَلَى الْعَالَمِینَ ﴿٣٢﴾ وَآتَیْنَاهُمْ مِنَ الآیَاتِ مَا فِیهِ بَلاءٌ مُبِینٌ ﴿٣٣﴾

“আর অবশ্যই আমি বনী ইসরাইলকে লাঞ্ছনাদায়ক আযাব থেকে উদ্ধার করেছিলাম।”(৪৪:৩০)

“[উদ্ধার করেছিলাম] ফেরাউনের [আজাব] হতে; নিশ্চয় সে ছিল উদ্ধত [দাম্ভিক] ও সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।”(৪৪:৩১)

“আমি [আমার] জ্ঞাতসারেই বিশ্ববাসীর ওপর ওদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম।”(৪৪:৩২)

“আর আমি তাদেরকে [আমার ক্ষমতার] এমন নিদর্শনাবলী দিয়েছিলাম যাতে ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা।”(৪৪:৩৩)

আল্লাহর নবী হযরত মূসা (আ.) দাম্ভিক রাজা ফেরাউনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ফেরাউন ছিল একজন জালিম ও রক্তপিপাসু শাসক। সে নিজেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষ মনে করত এবং অপচয় ও সীমালঙ্ঘনে ছিল সিদ্ধহস্ত। সে বনি ইসরাইল জাতির ওপর চরম নির্যাতন চালাত এবং এই জাতির সব সদস্যকে ক্রীতদাস করে রেখেছিল। ফেরাউন বনি ইসরাইলের নবজাতক পুত্রসন্তানদের হত্যা করত এবং দাসী বানিয়ে রাখার জন্য কন্যাসন্তানদের জীবিত রাখত। মিশরে ক্ষমতায় থাকা ফেরাউন ও তার কিবতি বংশের লোকেরা বনি ইসরাইলকে দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের কাজ করাত এবং এজন্য তাদেরকে কোনো পারিশ্রমিক দিত না।

কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অবশেষে হযরত মূসা (আ.)-এর হাত ধরে এই নির্যাতিত বনি ইসরাইল জাতিকে নিষ্ঠুর ও রক্তপিপাসু ফেরাউনের হাত থেকে উদ্ধার করেন। বনি ইসরাইল শুধু ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তিই পায়নি সেইসঙ্গে ফেরাউনের সাজানো গোছান্য রাজ্য ও শাসনভারও তাদের হস্তগত হয়। ফলে তারা বিশাল এক সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে যায়। পার্থিব এসব সম্পদ ও ক্ষমতার পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা এই জাতিকে এমন আরো কিছু দান করেন যা তাদের পরীক্ষার কারণ হয়ে যায়। আসমান থেকে তাদের জন্য মান্না ও সালওয়া’র মতো ঐশী খাদ্য আসতে থাকে যার কথা সূরা বাকারায় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, কঠিন পাথর ফেটে বনি ইসরাইলের বারো গোত্রের জন্য বারোটি পানির ঝরনা প্রবাহিত হওয়ার ঘটনাও ছিল তাদের জন্য ঐশী পরীক্ষা।

এটি আল্লাহ তায়ালার অমোঘ নিয়ম যে, তিনি কাউকে নেয়ামতরাজি দান করে এবং কাউকে বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বিপদ ও কষ্ট দিয়ে যেমন মানুষকে পরীক্ষা করেন তেমনি ধন-সম্পদ, শক্তি ও ক্ষমতা দিয়েও পরীক্ষা করেন। কাজেই বনি ইসরাইল জাতি যখন ফেরাউনের অত্যাচারে নিষ্পেষিত হচ্ছিল তখনও তারা ঐশী পরীক্ষার সম্মুখীন ছিল এবং এরপর যখন তারা মিশরের ক্ষমতাধর জাতিতে পরিণত হয় তখনও বিষয়টি ছিল তাদের জন্য পরীক্ষা। কিন্তু তারা আল্লাহর নেয়ামতের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- যে জাতি আল্লাহর রাসূলকে সহযোগিতা এবং তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা অনুসরণ করবে তারা অত্যাচারী শাসকের কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে।

২- জুলুম, অত্যাচার ও সীমালঙ্ঘন ফেরাউনি চরিত্রের কাজ।

৩- যেকোনো জাতি খোদাদ্রোহিতা ও মারাত্মক পাপকাজে নিমজ্জিত হয়ে গেলে তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে যায়।

৪- কাউকে আল্লাহ অনেক নিয়ামত দান করলে সেগুলো তার জন্য পরীক্ষা। এই নিয়ামত আল্লাহর কাছে তার প্রিয় হওয়ার নিদর্শন নয়।

সূরা দুখানের ৩৪ থেকে ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 إِنَّ هَؤُلاءِ لَیَقُولُونَ ﴿٣٤﴾ إِنْ هِیَ إِلا مَوْتَتُنَا الأولَى وَمَا نَحْنُ بِمُنْشَرِینَ ﴿٣٥﴾ فَأْتُوا بِآبَائِنَا إِنْ کُنْتُمْ صَادِقِینَ ﴿٣٦﴾

“নিশ্চয় ওরা [অর্থাৎ মুশরিকরা] বলে:”(৪৪:৩৪)

“আমাদের প্রথম মৃত্যু ছাড়া [আর কিছুই] নেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হবো না।”(৪৪:৩৫)

“অতএব তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমাদের পিতৃপুরুষদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।”(৪৪:৩৬)

ফেরাউন ও বনি ইসরাইল জাতির ঘটনা শেষ হওয়ার পর এই তিন আয়াতে আবার মক্কার মুশরিকদের প্রসঙ্গে ফিরে আসা হয়েছে। এখানে পরকালে অবিশ্বাসী কাফেরদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। মক্কার কাফেররা বলত: আমাদের চোখের সামনে মানুষের যে মৃত্যু হয় এটিই শেষ কথা। মৃত্যু পরবর্তী জীবন বলে আর কিছু নেই। আর আবার জীবিত হওয়া বা সেই জীবনের হিসাব-নিকাশ সত্য হওয়া তো প্রশ্নই আসে না।  তারা তাদের এই বিশ্বাসে এতটা অটল ছিল যে, তারা মহানবী (সা.)কে বলত: মৃত ব্যক্তিরা আবার জীবিত হবে বলে তুমি যে কথা বলছো তা যদি সত্য হয় তাহলে বহু বছর পূর্বে মরে যাওয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের আবার জীবিত করে দেখাও।

কিন্তু তাদের এ বক্তব্য ভ্রান্ত; কারণ, আল্লাহ তায়ালা পরকালে শাস্তি ও পুরস্কার দেয়ার জন্য মানুষকে জীবিত করবেন। এই দুনিয়ায় আরেকবার জীবিত করা আল্লাহর বিধান নয়। তারপরও যদি ধরে নেই যে, আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূলুল্লাহ (সা.) কাফেরদের পিতৃপুরুষদেরকে এই দুনিয়াতেই জীবিত করে দেখাতেন তখন তারা বিষয়টিকে যাদু বলে উড়িয়ে দিত এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনত না।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- ইসলাম বিরোধীদের দৃষ্টিভঙ্গি হুবহু তুলে ধরে তার যুক্তিপূর্ণ উত্তর দেয়া পবিত্র কুরআনের শিক্ষাপদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়।

২- কারো পক্ষে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন সাপেক্ষে পরকালীন জীবনকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু কাফেররা যুগে যুগে তাদের এই দাবিতে অটল রয়েছে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ