আগস্ট ০২, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা দুখান নিয়ে আলোচনা। এই সূরায় ৫৯টি আয়াত রয়েছে। এবার এই সূরার ৩৭ থেকে ৫০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

أَهُمْ خَیْرٌ أَمْ قَوْمُ تُبَّعٍ وَالَّذِینَ مِنْ قَبْلِهِمْ أَهْلَکْنَاهُمْ إِنَّهُمْ کَانُوا مُجْرِمِینَ ﴿٣٧﴾

 “ওরা কি শ্রেষ্ঠ, না তুব্বা সম্প্রদায় ও তাদের পূর্ববর্তীরা? আমি ওদেরকে ধ্বংস করেছিলাম, কারণ ওরা ছিল অপরাধী।”(৪৪:৩৭)

এই আয়াতে মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: তোমরা বেশি শক্তিশালী নাকি আরব উপত্যকার দক্ষিণে ইয়েমেনে তুব্বা নামের যে জনগোষ্ঠী বাস করত তারা বেশি শক্তিশালী? তাদের ছিল সবুজ-শ্যামল ও উর্বর প্রান্তর এবং শক্তিমত্তায়ও তারা ছিল তোমাদের চেয়ে অগ্রগামী। কিন্তু তারা যখন জুলুম, অনাচার ও সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত হয় তখন ধ্বংস হয়ে যায়। কাজেই তোমরা তাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নাও যাতে তোমাদেরকেও একই পরিণতি ভোগ করতে না হয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মানুষকে সৎপথে আনার জন্য পবিত্র কুরআন যেসব পন্থা অবলম্বন করেছে তার একটি হচ্ছে, অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া যাতে তাদের পরিণতি থেকে মানুষ শিক্ষা নিতে পারে।

২- যেসব কাজের শাস্তি এই পৃথিবীতেই পেতে হয় সেরকম কিছু কাজ হচ্ছে সমাজে অত্যাচার, অপরাধ ও দুর্নীতির প্রচলন ঘটানো

সূরা দুখানের ৩৮ থেকে ৩৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ وَالأرْضَ وَمَا بَیْنَهُمَا لاعِبِینَ ﴿٣٨﴾ مَا خَلَقْنَاهُمَا إِلا بِالْحَقِّ وَلَکِنَّ أَکْثَرَهُمْ لا یَعْلَمُونَ ﴿٣٩﴾

 

“আর আমি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দুয়ের মধ্যকার কোন কিছুই খেলার ছলে সৃষ্টি করিনি।”(৪৪:৩৮)

“আমি এগুলোকে অযথা সৃষ্টি করিনি, কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানেনা।”(৪৪:৩৯)

আগের আয়াতগুলোতে কিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করার পর এই আয়াতে কিয়ামত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হচ্ছে: আসমানসমূহ ও জমিনসহ গোটা বিশ্বজগত কি উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? যদি তাই হতো তাহলে সেটি হতো শিশুদের খেলার মতো। শিশুরা বিভিন্ন জিনিস একত্রিত করে অনেক কষ্ট করে একটি ঘর বানায় এবং এরপর খেলা শেষ হয়ে গেলে এক আঘাতে সেটিকে ভেঙে ফেলে। কারণ, কিছুক্ষণ খেলা ও মজা করাই ছিল তাদের এই ঘর বানানোর একমাত্র উদ্দেশ্য। 

পরকালে অবিশ্বাসী কাফের ও নাস্তিকরা মৃত্যুকে মানুষের জীবনের শেষ বলে মনে করে। তাদের মতে, মানুষকে এত বিশাল প্রতিভা, ক্ষমতা ও শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র পৃথিবীর এই ক’টা দিনের জন্য যা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে। তাদের এই বিশ্বাস সত্যি হয়ে থাকলে মানুষসহ গোটা বিশ্বজগত সৃষ্টিকে নিরর্থক কাজ বলতে হবে।

অথচ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, মৃত্যু হচ্ছে মানুষের আসল আবাস অর্থাৎ পরকালীন জীবনে প্রবেশের দরজা মাত্র। সেই জীবনের তুলনায় পার্থিব জীবন অতি তুচ্ছ। মহা প্রতাপশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তায়ালা এত নিখুঁতভাবে এই বিশাল সৃষ্টিজগতকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করবেন- এটা ভাবাই যায় না। আল্লাহ তায়ালার মহাজ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঙ্গে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি সংক্ষিপ্ত শিক্ষা হচ্ছে:

১- মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই যদি সবকিছু শেষ হয়ে যায় তাহলে এই বিশাল বিশ্বজগত সৃষ্টির কোনো অর্থ থাকে না।

২- আর যদি এসব কিছু সৃষ্টির কোনো লক্ষ্য থেকে থাকে তাহলে আমাদেরকে সেই লক্ষ্যেকে সামনে রেখে নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করতে হবে।

৩- পরকালে অবিশ্বাসের একটি মূল কারণ বিশ্বজগত সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। অজ্ঞতা পরিহার করে সৃষ্টির রহস্য জানার চেষ্টা করতে হবে।

সূরা দুখানের ৪০ থেকে ৪২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

إِنَّ یَوْمَ الْفَصْلِ مِیقَاتُهُمْ أَجْمَعِینَ ﴿٤٠﴾ یَوْمَ لا یُغْنِی مَوْلًى عَنْ مَوْلًى شَیْئًا وَلا هُمْ یُنْصَرُونَ ﴿٤١﴾ إِلّا مَنْ رَحِمَ اللَّهُ إِنَّهُ هُوَ الْعَزِیزُ الرَّحِیمُ ﴿٤٢﴾

 

“নিশ্চয় [বাতিল থেকে হককে] আলাদা করার দিনটি তাদের সবার জন্য নির্ধারিত সময়।”(৪৪:৪০)

“সেদিন এক বন্ধু অপর বন্ধুর কোন কাজে আসবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।”(৪৪:৪১)

“সে ছাড়া, যার প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় তিনিই মহাপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।”(৪৪:৪২)

এই তিন আয়াতে কিয়ামত দিবসের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: সেদিন ফয়াসালা করার ও সত্য থেকে মিথ্যাকে আলাদা করার দিবস। সেদিন মানুষের কৃতকর্ম ছাড়া আর সবকিছু তার থেকে আলাদা হয়ে যাবে। পৃথিবীতে সাধারণত মানুষ বিপদে পড়লে বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে। কিন্তু কিয়ামতের দিন বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তার এ সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। বন্ধু যেমন বন্ধুকে সাহায্য করতে পারবে না তেমনি আত্মীয়-স্বজনও সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। মানুষের কোনো কৌশল সেদিন কাজে আসবে না। সেদিন আল্লাহর একান্ত দয়া ও রহমত ছাড়া কেউ মানুষকে বাঁচাতে পারবে না। তিনি ধার্মিক ও মুত্তাকি ব্যক্তিদেরকে নিজ রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন এবং তাঁর দয়ার সাগরে অবগাহন করার সুযোগ দেবেন।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- কিয়ামতের দিন বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। কাজেই আমরা সেদিন আল্লাহ ছাড়া আর কারো সাহায্য পাওয়ার আশা না করি।

২- কিয়ামত দিবস অবশ্যম্ভাবী। সেদিন সকল মানুষকে একসঙ্গে এক স্থানে একত্রিত করা হবে। কিন্তু এত মানুষের মধ্যেও প্রত্যেকে থাকবে একা ও অসহায়।

৩- কিয়ামত দিবসে মানুষ থাকবে একমাত্র আল্লাহর সাহায্যের মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তায়ালা কাফিরদের সঙ্গে প্রবল পরাক্রম ও শক্তিমত্তা নিয়ে কথা বলবেন এবং ঈমানদার ব্যক্তিদের সঙ্গে দয়াদ্র আচরণ করবেন।

সূরা দুখানের ৪৩ থেকে ৫০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

إِنَّ شَجَرَةَ الزَّقُّومِ ﴿٤٣﴾ طَعَامُ الأثِیمِ ﴿٤٤﴾ کَالْمُهْلِ یَغْلِی فِی الْبُطُونِ ﴿٤٥﴾ کَغَلْیِ الْحَمِیمِ ﴿٤٦﴾ خُذُوهُ فَاعْتِلُوهُ إِلَى سَوَاءِ الْجَحِیمِ ﴿٤٧﴾ ثُمَّ صُبُّوا فَوْقَ رَأْسِهِ مِنْ عَذَابِ الْحَمِیمِ ﴿٤٨﴾ ذُقْ إِنَّکَ أَنْتَ الْعَزِیزُ الْکَرِیمُ ﴿٤٩﴾ إِنَّ هَذَا مَا کُنْتُمْ بِهِ تَمْتَرُونَ ﴿٥٠﴾

 

“নিশ্চয়ই যাক্কুম গাছ [হবে]।”(৪৪:৪৩)

“গোনাহগারের খাদ্য।”(৪৪:৪৪)

“গলিত তামার মতো, পেটের মধ্যে ফুটতে থাকবে।”(৪৪:৪৫)

“ফুটন্ত পানি ফোটার মত।”(৪৪:৪৬)

“[আমি বলব] ওকে ধর এবং টেনে নিয়ে যাও জাহান্নামের [আগুনের] মধ্যস্থলে।”(৪৪:৪৭)

“তারপর তার মাথার উপর ফুটন্ত পানির শাস্তি ঢেলে দাও।”(৪৪:৪৮)

“[বলা হবে] আস্বাদন করো, নিশ্চয় [তোমার ধারণায়] তুমিই সম্মানিত ও অভিজাত!”(৪৪:৪৯)

“এটা তো সেই [শাস্তি] যার সম্পর্কে তোমরা সব সময় সন্দেহ পোষণ করতে।”(৪৪:৫০)

এই আয়াতগুলোতে জাহান্নামে গোনাহগার মানুষের কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা শুনলে যেকোনো মানুষের অন্তরে কম্পন সৃষ্টি হয়। সাধারণ ধারনায় মনে হতে পারে, জাহান্নামের আগুন পৃথিবীর আগুনের মতোই সবকিছুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, ফলে সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু এই আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায়, মানুষ জাহান্নামের আগুনের মধ্যে বেঁচে থাকবে এবং তাদেরকে খাদ্য ও পানীয় দেয়া হবে। কিন্তু সেসব খাদ্য ও পানীয় তাদের ক্ষুধা বা পিপাসা নিবারণের পরিবর্তে তাদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেবে। সেখানে পৃথিবীর আগুনের চেয়ে বহুগুণ বেশী উত্তপ্ত আগুনে জাহান্নামবাসী নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্বলতে থাকবে।

শারীরিক শাস্তির পাশাপাশি সেখানে মনস্তাত্ত্বিক কষ্টও থাকবে। পাপী ও দাম্ভিক ব্যক্তিদের সেখানে ভর্ৎসনা করা হবে এই বলে যে, তুমি নিজেকে অনেক বড় শক্তিশালী ও সম্মানিত লোক মনে করতে। এখন তার স্বাদ আস্বাদন করো। তুমি অসহায় মানুষদেরকে নিজের ক্রীতদাসে পরিণত করেছিলে এবং ভেবেছিলে, তোমার এ শক্তি কোনোদিন শেষ হবে না এবং কেউ তোমাকে পরাস্ত করতে পারবে না।

তবে জাহান্নামে পাপী ব্যক্তিদের প্রত্যেককে শাস্তি দেয়া হবে তার অপরাধের ধরন অনুযায়ী।  পার্থিব জীবনে যারা অনবরত গোনাহ করতে থাকে এবং ভাবে যে, তাদের অবস্থান সমাজের এত উঁচুতে যে, তাদেরকে কেউ শাস্তি দিতে পারবে না- জাহান্নামে তাদের শাস্তি হবে সবচেয়ে গুরুতর। তাদেরকে জাহান্নামে বলা হবে: এখন তোমরা যে শাস্তি ভোগ করছো সে সম্পর্কে তোমরা সারাক্ষণ সন্দেহ পোষণ করতে।

এই আট আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- কিয়ামতের দিন গোনাহ আগুনরূপে আবির্ভূত হবে এবং পাপী ব্যক্তিদের ভিতর ও বাহিরকে দগ্ধ করবে। কাজেই আমাদেরকে গোনাহ পরিত্যাগ করে আল্লাহর কাছে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির জন্য যথাসম্ভব কান্নাকাটি করতে হবে।

২- কিয়ামতের শাস্তি শরীর ও আত্মা উভয়কে ভোগ করতে হবে। জাহান্নামবাসী একদিকে আগুনে জ্বলবে অন্যদিকে মানসিকভাবেও তাদের চরম অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হবে।#

 

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ