আগস্ট ০২, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা দুখানের শেষ পর্ব নিয়ে আলোচনা। এবার এই সূরার ৫১ থেকে ৫৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৫১ থেকে ৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

إِنَّ الْمُتَّقِینَ فِی مَقَامٍ أَمِینٍ ﴿٥١﴾ فِی جَنَّاتٍ وَعُیُونٍ ﴿٥٢﴾ یَلْبَسُونَ مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَقَابِلِینَ ﴿٥٣﴾ کَذَلِکَ وَزَوَّجْنَاهُمْ بِحُورٍ عِینٍ ﴿٥٤﴾ یَدْعُونَ فِیهَا بِکُلِّ فَاکِهَةٍ آمِنِینَ ﴿٥٥﴾

 

“নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে।”(৪৪:৫১)

“উদ্যানসমূহ ও ঝর্ণাধারার মাঝে।”(৪৪:৫২)

“তারা পরিধান করবে মিহি ও পুরু রেশমী বস্ত্র এবং তারা (সিংহাসনে) পরস্পরের মুখোমুখী হয়ে বসবে।” (৪৪:৫৩)

“এভাবে [আমি পুরস্কার দেই]; আর আমি তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দেব ডাগর নয়না হূরদের সাথে।”(৪৪:৫৪)

“সেখানে তারা প্রশান্ত চিত্তে যে ফলমূল [খেতে চায় তা] আনতে বলবে।” (৪৪:৫৫)

গত আসরে আমরা জাহান্নামবাসী কাফের জালেমদের অবস্থা বর্ণনা করেছি। আজকের এই আয়াতগুলোতে জান্নাতবাসী মুত্তাকিদের অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: তারা থাকবে পরিপূর্ণ নিরাপদ স্থানে। যেকোনো দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, বিপদ ও অস্থিরতা থেকে তারা সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। এই প্রশান্ত চিত্ত ও নিরাপত্তা আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বড় নেয়ামত। পার্থিব জীবনেও আল্লাহ মুত্তাকিদেরকে এই নেয়ামত দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং যারা পৃথিবীতে এই নেয়ামত পায় তারা পরম নিরাপত্তা ও শান্তিতে জীবনযাপন করে।

জান্নাতে মুত্তাকিরা এমন উদ্যান ও পাহাড়ি ঝর্ণাধারার পাশে অবস্থান করবে যেখানে থাকবে রকমারি উদ্ভিদ, ফল, ফুল ও লতাগুল্ম। চিত্তবিনোদনের এই স্থান এতটা বৈচিত্রময় থাকবে যে তাতে থাকতে থাকতে জান্নাতবাসী কখনো ক্লান্ত হবে না।

এই পার্থিব জগতে রেশমি কাপড় সুন্দর ও কোমল পোশাক হিসেবে পরিচিত এবং আল্লাহ তায়ালা জান্নাতবাসীকে সেই রেশমি কাপড়ের পোশাকের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জান্নাতে এই পোশাকেও থাকবে নানারকম বাহার যা মুত্তাকিদের চিত্তকে সার্বক্ষণিকভাবে প্রশান্ত রাখবে। এছাড়া, জান্নাতবাসীর পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকবে। ইচ্ছে করলেই তারা একসঙ্গে সিংহাসনে বসে পরস্পরের মুখোমুখী হয়ে গল্পগুজব করবে এবং সেখানে কেউ কারো ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে না।

পরকালেও মানুষের জৈবিক চাহিদা অক্ষুণ্ন থাকবে বলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সেখানে এমন সব সুন্দরী স্ত্রী দান করবেন যাদের সৌন্দর্যের কথা পার্থিব জীবনে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। মুত্তাকি ব্যক্তিরা পৃথিবীতে পরনারী থেকে দৃষ্টি সংযত রেখে এবং অশ্লীল কর্ম থেকে বিরত থেকে নিজেদের শরীর ও চিত্তকে যে কষ্ট দিয়েছেন পরকালে আল্লাহ তায়ালা এভাবে তাদের সে ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন।

মানুষের আরেকটি শারিরীক চাহিদা হচ্ছে খাওয়া ও পান করা। জান্নাতে মুত্তাকি ব্যক্তিদের মন যা কিছু খেতে ও পান করতে চাইবে তা-ই তাদের সামনে উপস্থিত করা হবে। গাছে গাছে অসংখ্য ফলমূল শোভা পাবে এবং জান্নাতবাসী চাইলেই তা খেতে পারবে। গাছ থেকে ফল ছিঁড়ে খেতে তাদের বিন্দুমাত্র পরিশ্রম হবে না।

এই পাঁচ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- জান্নাতবাসীর সবচেয়ে বড় পাওয়া হবে নিরাপত্তা ও প্রশান্তি। এ কারণে অন্য সব প্রতিদানের আগে এই পুরস্কারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

২- মানুষকে যে কাজের প্রতিবাদ হিসেবে জান্নাত দান করা হবে তা হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন এবং হারাম ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকা।

৩- পার্থিব জীবনে মুত্তাকিরা আল্লাহর আদেশ মানতে গিয়ে মনের কামনা বাসনাকে দমন করে যে কষ্ট পাবে পরকালে শ্রেষ্ঠতম উপায়ে সে ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া হবে।

৪- জান্নাতবাসীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে এবং তারা পরস্পর গল্পগুজব করে আনন্দ পাবে।

সূরা দুখানের ৫৬ থেকে ৫৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

لا یَذُوقُونَ فِیهَا الْمَوْتَ إِلّا الْمَوْتَةَ الأولَى وَوَقَاهُمْ عَذَابَ الْجَحِیمِ ﴿٥٦﴾ فَضْلا مِنْ رَبِّکَ ذَلِکَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِیمُ ﴿٥٧﴾

“[পার্থিব জীবনে] প্রথম মৃত্যুর পর জান্নাতে তারা আর মৃত্যুর আস্বাদন করবে না। আর আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করেছেন।”(৪৪:৫৬)

“[এসব প্রতিদান] তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহস্বরূপ। এটাই সেই মহাসাফল্য।”(৪৪:৫৭)

পার্থিব জগতে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মৃত্যুকে। মৃত্যু মানুষকে তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এই দুই আয়াতে বলছেন, জান্নাতবাসী আর কখনো মারা যাবে না এবং সেখানে চিরঞ্জীব থাকবে। জান্নাতের এই অমরত্বের কথা কুরআনে কারিমের বহু জায়গায় ‘খালিদিনা ফিহা’ পরিভাষার মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে।

মুত্তাকিরা যে শুধু অমরত্ব লাভ করবে তা-ই নয় তাদেরকে কোনোদিন জান্নাত থেকে বের হয়ে জাহান্নামেও যেতে হবে না। কোনো কোনো ঈমানদার মানুষ তাদের গোনাহের কারণে হয়তো প্রথমে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে এবং সেখানকার শাস্তির মাধ্যমে গোনাহের কালিমা-মুক্ত হয়ে গেলে জান্নাতে যাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবে। কিন্তু এর বিপরীত ঘটনা কখনোই ঘটবে না। আল্লাহ তায়াল তাঁর অসীম দয়া দিয়ে জান্নাতবাসীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন বলেই তারা এই বিশাল নেয়ামতের অধিকারী হয়েছে যা তাদের কাছ থেকে আর কখনোই কেড়ে নেয়া হবে না।

পরের আয়াতে আল্লাহ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলছেন: এসব নেয়ামত জান্নাতবাসীআল্লাহর অনুগ্রহেই পেয়েছে। কারণ, স্বাভাবিক নিয়মে মুত্তাকিরা পার্থিব জীবনের সংক্ষিপ্ত সময়ে যত ভালো কাজই করুক না কেন তার পুরস্কার হিসেবে এত বিশাল প্রতিদান কোনোভাবেই তাদের প্রাপ্য হয় না। কিন্তু মহান আল্লাহ তার অসীম দয়ার বদৌলতে পার্থিব জীবনে পবিত্র জীবনের অধিকারী মানুষদেরকে এই বিশাল প্রতিদান প্রদান করবেন। আর জান্নাতবাসীর এই প্রতিদানকে এখানে মহা সাফল্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- যে কেউ একবার জান্নাতে প্রবেশ করবে তাকে আর কোনোদিন সেখান থেকে বের হতে হবে না।

২- পার্থিব জীবনে যারা মনের কামনা-বাসনাকে দমন করে নিজেকে গুনাহমুক্ত রাখবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ রাখবেন।

৩- পার্থিব জীবনে আমরা যত ভালো কাজই করি না কেন পরকালের প্রতিদানের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ। কাজেই মানুষ তার কাজের প্রতিদান হিসেবে নয় বরং আল্লাহর পরম দয়ার কারণে জান্নাতের অধিকারী হবে। 

সূরা দুখানের ৫৮ থেকে ৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

فَإِنَّمَا یَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِکَ لَعَلَّهُمْ یَتَذَکَّرُونَ ﴿٥٨﴾ فَارْتَقِبْ إِنَّهُمْ مُرْتَقِبُونَ ﴿٥٩﴾ 

“অতঃপর নিশ্চয় আমি আপনার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।”(৪৪:৫৮)

“কাজেই আপনি প্রতীক্ষা করুন, নিশ্চয় তারাও প্রতীক্ষমাণ।”(৪৪:৫৯)

সূরা দুখানের এই শেষ দুই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলছেন: এই কুরআন নাজিল করার উদ্দেশ্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ ও তাদেরকে সতর্ক করা যাতে তারা উদাসীনতার ঘুম থেকে জেগে উঠে সতর্ক হয়ে যায়।  পার্থিব জীবনের বিজ্ঞানভিত্তিক বইগুলো পড়ে বেশিরভাগ মানুষই কিছু উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু কুরআনে কারিমের বিষয়বস্তু অতি সূক্ষ্ম ও গভীর অর্থবোধক হওয়া সত্ত্বেও তা এত সহজ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, সমাজের যেকোনো শ্রেণির মানুষের পক্ষে তা উপলব্ধি করা সহজ।  কাজেই এই মহাগ্রন্থের আয়াতগুলো সহজে মানুষের অন্তরে রেখাপাত করে এবং মানুষকে উদাসীনতার ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়।

কিন্তু যারা আত্মম্ভরী, একগুঁয়ে ও অহংকারী তাদের সামনে কুরআনের আয়াত যত বেশি তেলাওয়াত করা হোক না কেন তারা সতর্ক হয় না। কারণ, তারা আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে যে, তারা ঈমান আনবে না। যে ব্যক্তি ঘুমের ভান করে পড়ে আছে তাকে যতই ডাকাডাকি করা হোক সে কিছুতেই সাড়া দেবে না। আল্লাহ তায়ালা এখানে তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলছেন: কাফের ও খোদাদ্রোহীরা আপনি ও আপনার দ্বীনের পরাজয় কামনা করে। কিন্তু একগুঁয়ে কাফেরদের বিরুদ্ধে আপনাকে আল্লাহ বিজয়ের যে প্রতিশ্রতি দিয়েছেন এবং খোদাদ্রোহীদেরকে ধ্বংস করার যে আশ্বাস দিয়েছেন আপনি সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকুন।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- কুরআনের শিক্ষা মানুষের সামনে অত্যন্ত সাদামাটা ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে। কারণ, কুরআন এসেছে সর্বসাধারণের জন্য, বিশেষ কোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জন্য নয়।

২- মহান আল্লাহ আসমানি কিতাব ও নবী পাঠিয়ে মানুষের প্রতি নিজের দায়িত্ব শেষ করেছেন। কেউ যদি সবকিছু জেনে শুনে সত্য প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তাকে আল্লাহর চরম ক্রোধের সম্মুখীন হতে হবে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ