জানুয়ারি ২৯, ২০২৩ ২০:১৬ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। ইরানের কালজয়ী গল্পের পসরা গল্প ও প্রবাদের গল্পের আজকের আসরে আমরা শুনবো চমৎকার একটি গল্প। গল্পটি এরকম:

এক বৃদ্ধ নিজেকে ভেষজ ডাক্তার মানে আমরা যাদের কবিরাজ বলি, সেরকম কবিরাজ বলে দাবি করতো। আসলে কিন্তু সে কোনো ভালো কবিরাজ ছিল না। মুরব্বিদের কাছ থেকে শোনা চিকিৎসা জ্ঞানের বাইরে সে কিছুই জানতো না। কখনো কখনো মরু-প্রান্তরের দিকে যেত এবং গুণাগুণ সম্পর্কে না জেনেই কিছু কিছু উদ্ভিদ, ঘাস ইত্যাদি তুলে নিয়ে বাড়ি যেত। কেউ অসুস্থ হলে ওইসব উদ্ভিদ জ্বাল দিয়ে রোগীকে সেবন করতে দিতে বলতো।

রোগী তো কালের পরিক্রমায় একটা সময় সুস্থ হয়ে উঠতোই। তখন ওই ভুয়া কবিরাজ তার ভেষজ ওষুধের গুণে ভালো হয়েছে বলে কৃতিত্বের দাবি করতো। গ্রামের মানুষ তো তাকে ছাড়া কবিরাজ হিসেবে অন্য কাউকে চিনতো না। অসুখ বিসুখ হলে তারা নিরুপায় হয়ে তার কাছেই ছুটে আসতো কিংবা রোগীর কাছে কবিরাজকে নিয়ে যেত। রোগী যদি সুস্থ না হতো তাহলে হাজারটা বাহানা তৈরি করতো। যেমন বলতো: রোগী আমার নির্দেশনা ঠিকমতো পালন করে নি। যেভাবে ওষুধ খেতে বলেছিলাম বা যেসব খেতে নিষেধ করেছিলাম সেগুলো ঠিকমতো করে নি। কিন্তু একদিন এই কবিরাজ নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লো এবং শয্যাশায়ী হয়ে গেল। জানতো যে বিশ্রাম নিলে উন্নতি হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো দুই তিনদিন বাসার বাইরে যাবে না। 

বিশ্রামের প্রথম দিনেই গ্রামের এক লোক কবিরাজের ঘরের দরোজার কড়া নাড়লো এবং অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকে বললো: জনাব কবিরাজ! আপনি তো জানেন আমার মা অসুস্থ। আপনি দুইবার কষ্ট করে আমার মাকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং ওষুধ দিয়েছিলেন। কিন্তু দু:খজনকভাবে এখন তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। এখন কী করবো, একটু পরামর্শ দেবেন? বৃদ্ধ কবিরাজ বললেন: দেখতে পাচ্ছো না আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার অবস্থা এমন যে কোনোভাবেই তোমার মাকে দেখতে যেতে পারবো না। তবে, দেখি, তুমি এখন যাও! ঘণ্টাখানেক পরে আবার এসো! আমি আমার ছেলেকে তোমার সঙ্গে পাঠাবো তোমার মায়ের চিকিৎসার জন্য। মজার ব্যাপার হলো কবিরাজের ছেলের কবিরাজের সমান জ্ঞান-প্রজ্ঞাও ছিল না। সে আর কী চিকিৎসা করবে। ছেলে তাই বাবাকে বললো:

বাবা! তুমি এটা কীরকম কথা বললে! আমি তো কবিরাজির ক-ও জানি না। যেখানে তোমার দেওয়া ওষুধ খেয়েই ওর মায়ের কিচ্ছু হলো না সেখানে আমি গিয়ে কী করবো! আমি তো চিকিৎসকই নই! বাবা বললেন: তুমি কি মনে করো আমি সত্যিকারের কবিরাজ? আমি আমার রোগীদের বলি তারা যেন একটু বিশ্রাম নেয় এবং কিছু কিছু জিনিস পরিহার করে চলে। এই যে আমি বিচিত্র ভেষজ দেই তাদেরকে সেটা তাদের মনস্তুষ্টির জন্য। যাতে তারা মনে না করে যে কবিরাজ তো কোনো ওষুধই দিলো না! রোগীদের কাছ থেকে যে টাকা নিই সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য এবং ভেষজ ওষুধ দেওয়ার জন্য নিই। এই কাজটা তো তুমি নিজেও করতে পারবে। সমস্যা তো নেই। তাছাড়া তুমি তো দীর্ঘদিন ধরে আমাকে দেখেছো কীভাবে কী করি। 

বাবার কথা শুনে ছেলে এবার বললো: কিন্তু বাবা! লোকটা তো বললো তার মা'র অবস্থা দিনের পর দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। তুমি যেসব ওষুধ দিয়েছো তাতেও কোনো কাজ হয় নি। তো তোমার চিকিৎসায় যেখানে কোনো উন্নতি হয় নি সেখানে আমি কীভাবে কী করবো। আমি তো কিছুই জানি না। তাকে এখন কী বলবো? বাবা বললেন: টেনশানের কিছু নেই। রোগীর বাড়িতে যখন যাবে তখন তার চারপাশে দৃষ্টি মেলে দেখবে। কী দেখতে পাচ্ছো সেটা খেয়াল করবে। উদাহরণস্বরূপ যদি দেখো খরবুজার চামড়া, আখরোটের চামড়া কিংবা কোনো খাবারের উচ্ছিষ্ট, সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে বলবে: রোগ ভালো হবে কী করে! এই রোগী তো কবিরাজের নির্দেশনা অনুসরণ করে নি! যেসব খাবার খেতে নিষেধ করা হয়েছিল যেমন খরবুজা, আখরোট কিংবা যে খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখেছো-সেই খাবার-এগুলো খেতে নিষেধ করা হয়েছিল। এসব যেহেতু খেয়েছে সুতরাং কেরামুল কাতেবিনের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমাদের তো আর করার কিছু নেই।

বাবা-ছেলের কথোপকথনের মাঝে ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। এরইমাঝে রোগীর ছেলে ফিরে এলো। কবিরাজের ছেলে তার সাথে গেল এবং রোগীর ঘরে গিয়ে পৌঁছলো। ঘরে প্রবেশের মুহূর্ত থেকেই ছেলে চারদিকে তাকাতে শুরু করলো যাতে এমন কিছু জিনিস খুঁজে পায় যার বাহানা দিয়ে রোগ ভালো না হবার কারণ দাঁড় করানো যায়। কিন্তু দরোজা থেকে রোগীর শয্যা পর্যন্ত এমন কিছুই তার চোখে পড়লো না যা দিয়ে বাহানা তৈরি করা যায়। কেবল প্যাসেজে দেখতে পেলো গাধার পিঠে বোঝা বহনের একটা জিন। ওই জিনটি সবার নজরেই পড়তো। যাই হোক কবিরাজের ছেলে ধীরে ধীরে রোগী মহিলার শয্যার পাশে গেল। 
কবিরাজের ছেলে রোগীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলো, শিরা দেখলো, রোগীকে বাবার মতো বললো: জিহ্বাটা বের করুন… ইত্যাদি। পরীক্ষা করার ফাঁকেও ছেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল যাতে নির্দেশ না মেনে চলার মতো কোনো অজুহাত দাঁড় করানো যায়। কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলো না। মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় ছিল রোগীর আশপাশের লোকজনকে কিছু বলার। সে তার দুই হাত মুনাজাতের মতো কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত টেনে নিয়ে বললো: অস্বাস্থ্যকর মানুষ যে-কিনা পরিহার করে চলে না তার কাছ থেকে কী আশা করা যায়? তার অবস্থার যে অবনতি ঘটবে সেটা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। রোগী মহিলার ছেলে বললো: কিন্তু মা তো কিচ্ছু খায় নি, পরামর্শ সবই মেনে চলেছে। কবিরাজের ছেলে বললো: না, হতেই পারে না, অবশ্যই কিছু না কিছু খেয়েছে।

একথা বলতে বলতে তার মনে পড়ে গেল প্যাসেজে দেখা গাধার জিনের কথা। সে শুধু জিন দেখেছে গাধা দেখে নি। তাই বললো: রুগ্ন গাধা খেয়েছে। রোগীর ছেলে বললো: কীসব আজগুবি কথা বলছো! গাধা খেয়েছে? মানুষ কি গাধা খায় নাকি? এই বলেই এক লাত্থি দিয়ে কবিরাজের ছেলেকে ঘর থেকে বের করে দিলো। এই ঘটনার পর থেকেই কেউ যখন আগডুম বাগডুম যুক্তি দেখিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে তখনই তাকে উদ্দেশ করে বলা হয়: রুগ্ন গাধা খেয়েছে।#

পার্সটুডে/এনএম/২৯

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ


 

ট্যাগ