জুন ০১, ২০২৩ ১৪:৫৩ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন।  গত আসরে আমরা সূরা ওয়াকিয়ার ১৯ নম্বর পর্যন্ত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ২০ থেকে ৪০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব।  প্রথমেই সূরা ওয়াকিয়ার ২০ থেকে ২৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

وَفَاكِهَةٍ مِمَّا يَتَخَيَّرُونَ (20) وَلَحْمِ طَيْرٍ مِمَّا يَشْتَهُونَ (21) وَحُورٌ عِينٌ (22) كَأَمْثَالِ اللُّؤْلُؤِ الْمَكْنُونِ (23) جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (24) لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلَا تَأْثِيمًا (25) إِلَّا قِيلًا سَلَامًا سَلَامًا (26)

“আর নানান ফলমূল, ইচ্ছেমত যেটা তারা বেছে নেবে।” (৫৬:২০)

“আর পাখীর গোশত যেটা তাদের মনে চাইবে।”(৫৬:২১)

“আর (সেখানে থাকবে) ডাগর ডাগর উজ্জ্বল সুন্দর চোখওয়ালা সুন্দরী স্ত্রীগণ।”(৫৬:২২)

“যেন তারা সযত্নে লুকিয়ে রাখা মুক্তো।”(৫৬:২৩)

“তারা যে আমল করত তার প্রতিদানস্বরূপ।”(৫৬:২৪)

“সেখানে তারা না শুনবে কোন অনর্থক কথাবার্তা, আর না শুনবে অপরের ঘাড়ে গুনাহ চাপানোর বুলি।” (৫৬:২৫)

“তারা শুধু এই বাণী শুনবে, ‘সালাম, সালাম’।”(৫৬:২৬)

গত আসরে আমরা বলেছি, কিয়ামতের দিন মানুষ আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত, সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগা- এই তিন ভাগে বিভক্ত হবে। সেখানে আরা নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের প্রতি আল্লাহর কিছু অনুগ্রহেরও বর্ণনা দিয়েছি। এরপর আজকের এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে: জান্নাতবাসীদের আনন্দ ও বিনোদনের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকবে না। তারা যা কিছু চাইবে তা অনির্দিষ্ট সংখ্যায় ও পরিমাণে হাতের কাছে পেয়ে যাবে। খাদ্য-খাবার, ফলমূল, নানারকম গোশত বিশেষ করে সুস্বাদু পাখির গোশত তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে। জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্যও জান্নাতবাসীদের জন্য আল্লাহ তায়ালা এমনভাবে সুন্দরী ও পবিত্র স্ত্রীগণকে রেখে দিয়েছেন ঠিক যেভাবে ঝিনুকের মধ্যে মুক্তো সংরক্ষিত রাখা হয়। এসব নারী এতটাই পবিত্র যে, কোনো মানুষ বা জিন তাদেরকে স্পর্শ করা তো দূরে থাক চোখে দেখারও সুযোগ পায়নি। তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পেরে জান্নাতবাসীদের জীবন ধন্য হয়ে যাবে।

পার্থিব জীবনের আমোদ-ফুর্তি ও এ ধরনের পার্টি সাধারণত পাপকাজে ভরপুর থাকে। এসব স্থানে অনর্থক এবং বাজে কথা ও বাক্য বিনিময় হয়। কিন্তু জান্নাতের পবিত্র উদ্যানের সেই মেলামেশায় জান্নাতবাসীরা শুধুমাত্র পবিত্র ও সুন্দর বাক্যালাপে মগ্ন থাকবে। সেখানে স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যকার আলাপচারিতায় আন্তরিকতা ও মাধুর্য থাকবে এবং এসব পবিত্র কথাবার্তায় তাদের মধ্যে সম্পর্ক কেবল ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকবে। 

এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- ঈমানদার ও সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য জান্নাতে সব ধরনের আনন্দ ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। পার্থিব জগতের চেষ্টা, কাজ ও নিয়তের ওপর নির্ভর করে তাদেরকে জান্নাতি নেয়ামতসমূহ প্রতিদান হিসেবে দেওয়া হবে।

২- সেইসব নারী জান্নাতি যারা পরমাসুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সৌন্দর্য পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে হেফাজতে রেখেছেন।

৩- জান্নাত শুধু সালাম আর শান্তির স্থান। সেখানে অপরের কষ্ট হতে পারে এমন কোনো উপাদানের অস্তিত্ব থাকবে না। জান্নাতবাসীরা পরস্পরের সঙ্গে উত্তম বাক্য বিনিময় করবে এবং তারা সবাই সব সময় খোশ মেজাজে থাকবে।

এবারে সূরা ওয়াকিয়ার ২৭ থেকে ৪০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

وَأَصْحَابُ الْيَمِينِ مَا أَصْحَابُ الْيَمِينِ (27) فِي سِدْرٍ مَخْضُودٍ (28) وَطَلْحٍ مَنْضُودٍ (29) وَظِلٍّ مَمْدُودٍ (30) وَمَاءٍ مَسْكُوبٍ (31) وَفَاكِهَةٍ كَثِيرَةٍ (32) لَا مَقْطُوعَةٍ وَلَا مَمْنُوعَةٍ (33) وَفُرُشٍ مَرْفُوعَةٍ (34) إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً (35) فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا (36) عُرُبًا أَتْرَابًا (37) لِأَصْحَابِ الْيَمِينِ (38) ثُلَّةٌ مِنَ الْأَوَّلِينَ (39) وَثُلَّةٌ مِنَ الْآَخِرِينَ (40)

“আর সৌভাগ্যবান দল কতই না ভাগ্যবান [যাদের আমলনামা তাদের ডান হাতে দেওয়া হবে]” (৫৬:২৭)

“তারা থাকবে কাঁটাহীন কুলগাছের নীচে।”(৫৬:২৮)

“কলা গাছের মাঝে যাতে আছে থরে থরে সাজানো কলা।”(৫৬:২৯)

“বিস্তীর্ণ অঞ্চল-জুড়ে ছায়া।”(৫৬:৩০)

“আর [ঝর্না থেকে নেমে আসা] অবিরাম প্রবাহমান পানি।”(৫৬:৩১)

“ও প্রচুর ফলমূল।”(৫৬:৩২)

“যা কখনও শেষ হবে না এবং কখনও নিষিদ্ধও হবে না।”(৫৬:৩৩)

“আর উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন স্ত্রীগণ।”(৫৬:৩৪)

“তাদেরকে (অর্থাৎ ঐ হুরদেরকে) আমি সৃষ্টি করেছি এক অভিনব সৃষ্টিতে।”(৫৬:৩৫)

“অতঃপর তাদেরকে করেছি কুমারী।”(৫৬:৩৬)

“স্বামী ভক্তা, অনুরক্তা [সদালাপী] আর সমবয়স্কা।”(৫৬:৩৭)

“সৌভাগ্যশীলদের জন্য।”(৫৬:৩৮)

“তাদের অনেকে হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে।”(৫৬:৩৯)

“এবং অনেকে হবে শেষ [নবীর] উম্মত।”(৫৬:৪০)

আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারা জান্নাতে থাকবেন সবচেয়ে উন্নত স্থানে। তাদের পরেই সৌভাগ্যবানদের স্থান। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বর্ণিত আয়াত অনুযায়ী তারা হচ্ছেন সেইসব মানুষ কিয়ামতের দিন যাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে। কিয়ামতের দিন ডান হাতে আমলনামা লাভ করা হবে সৌভাগ্যবানদের অন্যতম নিদর্শন। জান্নাতবাসী এই দলটিও জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামত উপভোগ করতে পারবে।  জান্নাতে থাকবে অসংখ্য গাছপালা যার মধ্যে ফলমূলের গাছ থাকবে প্রচুর পরিমাণে। জান্নাতবাসীরা একদিকে এসব গাছের ফল খেতে পারবে এবং অন্যদিকে এসব গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেবে। এসব গাছের কোনো কাঁটা তাদেরকে কোনো কষ্ট দেবে না। এর পাশাপাশি জান্নাতে থাকবে অসংখ্য প্রবাহমান প্রস্রবন, ঝর্না ও ঘন জঙ্গল। যার ফলে জান্নাতবাসীদের জন্য তৈরি হবে এক নান্দনিক ও নৈসর্গিক পরিবেশ।

এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- প্রাকৃতিকভাবেই পার্থিব জীবনের বিভিন্ন ভোগ্যবস্তু ক্ষয়প্রাপ্ত ও ধ্বংসশীল। এগুলোর মধ্যে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। কিন্তু জান্নাতের নেয়ামতসমূহে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। সেখানকার নেয়ামতগুলো চিরস্থায়ী এবং সব সময় মানুষের হাতের নাগালে থাকে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এসব নেয়ামতের জন্য কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়নি।

২- পৃথিবীর জীবনে বিয়ে-শাদির মাধ্যমে যেসব সংসার গঠিত হয় তা অনেক সময় টেকে না। মতের অমিলসহ নানা ধরনের সমস্যার কারণে কখনও কখনও অনেক দম্পতি বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। কিন্তু জান্নাতে আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে স্বামী-স্ত্রী বানাবেন তাদের মধ্যে সব দিক দিয়ে মিল থাকবে। চিন্তা-চেতনায় তারা এক ও অভিন্ন হবেন। ফলে তাদের মধ্যে কখনও মতপার্থক্য বা মতভেদ হবে না বরং তাদের মধ্যে বিরাজ করবে ভালোবাসার এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

এসব আয়াতের আরেকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

৩- পারলৌকিক সৌভাগ্য অর্জন শুধুমাত্র অতীতে নবী-রাসূলদের যুগের মানুষের জন্যই বরাদ্দ ছিল না বরং তা অর্জনের পথ কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ঈমানের পাশাপাশি সৎকর্মশীল হতে পারলে যে কেউ পারলৌকিক সৌভাগ্য বা জান্নাত লাভ করতে পারবে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  

 

 

ট্যাগ