জুন ০৩, ২০২৩ ১২:৫০ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। সপ্তাহ ঘুরে রংধনুর আসর সাজিয়ে তোমাদের মাঝে হাজির হয়েছি যথারীতি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আক্তার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই হিজরী সপ্তম শতাব্দীর বিখ্যাত ইরানি কবি ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর নাম শুনেছো। তাঁর একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে  মসনবী। মাওলানা দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে মসনবী রচনা করেন। মসনবী হলো সমুদ্রের মতো সীমাহীন বিস্তৃত একটি গ্রন্থ। সমুদ্রের সম্পদের যেমন শেষ নেই তেমনি মসনবীর  রয়েছে নতুন নতুন মুক্তা। 

মসনবী এমন এক অনন্য সাধারণ গ্রন্থ যা আজও তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য এবং আধুনিকতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। আটশ বছর আগের এই গ্রন্থে কল্পনাভিত্তিক গল্প, রূপকধর্মী গল্প, রহস্যময় গল্প, আধ্যাত্মিক গল্প, শিক্ষণীয় গল্প, নৈতিক বা চারিত্রিক গল্প রয়েছে। আজকের আসরে আমরা মাওলানা রুমীর মসনবী থেকে একটি গল্প শোনাব। আর আগে থাকবে মাওলানার জীবন থেকে নেওয়ার কিছু সত্য ঘটনা। এরপর মাওলানা রুমির কয়েকটি মূল্যবান বাণী। আর সবশেষে থাকবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার এক ছোট্ট বন্ধুর সাক্ষাৎকার। অনুষ্ঠানটি তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।

রুমির জীবনের গল্প

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, মাওলানা রুমি ছিলেন একজন জ্ঞান সাধক। জ্ঞানের পথে তার শ্রম-সাধনা ও প্রচেষ্টা ছিল অতুলনীয়। মানুষ তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত। লোকজন তাকে বলতো জ্ঞানের জাহাজ। নিজের আরাম আয়েশ নিয়ে রুমি কখনও ভাবেন নি। এমনকি তিনি বিছানা, বালিশ পর্যন্ত ব্যবহার করতেন না। স্বেচ্ছায় কখনও শয়ন করতেন না। নিদ্রা ভর করলে বসে বসে ঘুমিয়ে নিতেন অল্প কিছু সময়।

রুমি কখনও নামাজ মিস করতেন না। তিনি বলতেন নামাজ হলো ধ্যান। এই ধ্যানে প্রভুকে পাওয়া যায়। প্রভুকে অনুভব করা যায়। নামাযের সময় হলে তিনি যে অবস্থায় থাকতেন, তৎক্ষণাৎ কেবলার দিকে ঘুরে যেতেন। তখন তার চেহারার রং পরিবর্তিত হয়ে যেত। নামাযে তিনি একেবারে তন্ময় হয়ে যেতেন। অনেক সময় দেখা গেছে, এশার নামায শেষ করতে ভোর হয়ে গেছে।

একবার কনকনে শীতের মৌসুমে খোলা জায়গায় মাওলানা নামাযে দাঁড়ালেন। নামাজ শেষ করে মোনাজাতের সময় দুই হাত তুলে খুব কান্না করলেন। চোখের জলে তার দাড়ি চুইয়ে চুইয়ে পানি গড়িয়ে পড়েছে। এমনকি, অত্যাধিক শীতের প্রকোপে দাড়িতে অশ্রু জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না, যথারীতি নামাজে মশগুল ছিলেন তিনি। তিনি বলতেন নামাজে দাঁড়ালে প্রশান্তি অনুভূত হয়। নামাজ আর জ্ঞানের চেয়ে শান্তি দুনিয়াতে আর কিছুতেই নেই।

মাওলানা রুমি ছিলেন অল্পে খুশি থাকা মানুষ। বিভিন্ন দেশের সুলতান ও বাদশাহগণ নগদ টাকা-পয়সা এবং বিভিন্ন রকমের খাদ্য ও ব্যবহার্য বস্তু তার খেদমতে হাদিয়াস্বরূপ পাঠাতেন। কিন্তু তিনি সেগুলোর কিছুই নিজের জন্য না রেখে গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। বলতেন, 'এইসব জিনিস আমি সংগ্রহে রাখতে চাই না। আমি শুধু জ্ঞান সংগ্রহ করতে চাই। জ্ঞানের চেয়ে বড় সম্পদ দুনিয়াতে আর কিছুই নেই।'

নিজ সম্পদ গরীব-দুঃখীদের মাঝে বিলি করে দেওয়ায় কোনো কোনো সময় মাওলানার গৃহে খাওয়ার জন্য কিছুই থাকত না। যেদিন ঘরে খাবার কিছুই থাকত না, সেদিন মাওলানা খুব বেশী খুশি হয়ে বলতেন, আমার ঘর হতে দরবেশীর ঘ্রাণ আসছে।

তার দানশীলতা ও পরার্থপরতার অবস্থা এরূপ ছিল যে, কোনো ভিক্ষুক এসে কিছু চাইলে আংটি, পাগড়ী, কোর্তা, পরিধানে যা কিছু থাকত, দেহ হতে খুলে ভিক্ষুককে দিয়ে দিতেন। তার সহজ সরল জীবনের জন্যই মানুষ তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন।

রুমি আকাশ দেখতে খুব ভালোবাসতেন। প্রতিদিন সময় করে তিনি আকাশের দিকে অনেক সময় ধরে তাকিয়ে থাকতেন। তখন তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তো। যদি তাকে প্রশ্ন করা হতো- আপনি কেন কাঁদছেন? তার উত্তরে তিনি কিছু বলতেন না।

একবার তিনি বাজারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ছেলেরা তার হাত চুম্বন করার জন্য দৌড়ে আসতে লাগল। তা দেখে তিনি দুই হাত প্রসারিত করে দিলেন। মাওলানাও ছোট ছোট শিশুদের হাতে চুমো খেতেন। অদূরে একটি ছেলে কোনো কাজে মশগুল ছিল। সে বলল, মাওলানা! একটু অপেক্ষা করুন, আমি আমার হাতের কাজ শেষ করে আপনার হাত চুম্বন করব। ছেলেটি তার কাজ হতে অবসর না হওয়া পর্যন্ত মাওলানা ঐ স্থানে দাড়িয়ে ছিলেন। ছেলেটি কাজ শেষ করে এসে মাওলানার হাত চুম্বন করার পর তিনি নিজের গন্তব্য স্থানে চলে গেলেন।

রুমির বাণী

বন্ধুরা, মাওলানা রুমির জীবন থেকে নেওয়া কিছু গল্প শুনলে। এবার আমরা তার লেখা কয়েকটি মূল্যবান বাণী শোনাব। বাণীগুলোও মাওলানা রুমির জীবনের গল্প সম্পর্কে। তিনি বলেছেন, "অন্যের জীবনের গল্প শুনে সন্তুষ্ট হয়ো না, নিজের পথ তৈরি করো, নিজের জীবন সাজাও।"

বন্ধুরা, নিজের জীবন সাজাতে হলে কী করতে হবে- তাও বলে দিয়েছেন মাওলানা রুমি। দিনি বলেছেন, "নতুন কিছু তৈরি করো, নতুন কিছু বলো। তাহলে পৃথিবীটাও হবে নতুন।"

বন্ধুরা, নতুন কিছু করতে কোথায় খোঁজ করবে? সে সম্পর্কে মাওলানা রুমি বলেছেন,“তুমি এ মহাবিশ্বে গুপ্তধনের খোঁজ করছো, কিন্তু প্রকৃত গুপ্তধনতো তুমি নিজেই।"

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই সুন্দর দিনের প্রত্যাশা করো! কিন্তু তা কি আমাদের কাছে এসে ধরা দেবে? মাওলানা রুমি বলেছেন, "সুন্দর ও উত্তম দিন তোমার কাছে আসবেনা, বরং তোমারই এমন দিনের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত।"

তবে, সুন্দরের সন্ধানে বের হলে দুঃখ, কষ্ট আসবেই। মাওলানা বলেছেন, "ঘষা খেতে যদি ভয় পাও, তাহলে চকচক করবে কীভাবে?"

বন্ধুরা, ঘষা খাবে, আঘাত পাবে, বাধা আসবে, কিন্তু তখন তোমাদেরর করণীয় কী- তাও বলে দিয়েছেন মাওলানা রুমি। বলেছেন, "শব্দ দিয়ে প্রতিবাদ করো, কণ্ঠ উঁচু করে নয়। মনে রাখবে- ফুল ফোটে যত্নে, বজ্রপাতে নয়।"

বন্ধুরা, জীবনে বড় হতে হলে আমাদেরকে কত কিছুই না হারাতে হবে। আর তাই রুমি আমাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন এভাবে- "যা কিছু হারিয়েছো তার জন্য দুঃখ করো না। তুমি তা আবার ফিরে পাবে, আরেকভাবে, আরেক রূপে।"

মসনবীর গল্প 'জাদুকর বুড়ি ও রাজপুত্র'

বন্ধুরা, মাওলানা রুমির কিছু মূল্যবান বাণী শুনলে। এবার রয়েছে মাওলানা রুমির বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবী থেকে নেওয়া গল্প 'জাদুকর বুড়ি ও রাজপুত্র'।

অনেক দিন আগের কথা। যখন পৃথিবীজুড়ে ছোট ছোট রাজ্য ছিল। নিদৃষ্টভাবে কোনো দেশের নামও তখন ছিল না। এমনই ছোট এক রাজ্যের রাজার একটি ছেলে সন্তান ছিল। রাজপুত্র দেখতে খুবই সুন্দর। রাজা সারা দিন রাজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, ভবিষ্যত উত্তরাধিকারের কথা ভাবার সময়ই পেতো না।

একদিন হঠাৎ রাজা ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখলেন তিনি মারা গেছেন। ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে রাজা জেগে উঠলেন। তিনি ভাবতে থাকলেন এমন স্বপ্ন কেন দেখলেন! রাজার মাথায় নানা চিন্তা ভর করতে লাগল। অনেক ভেবে রাজা বুঝতে পারলেন যে, তার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। বয়স হয়ে যাচ্ছে অনেক। তাকে এখন ভাবতে হবে ভবিষ্যতের জন্য।

রাজা রানিকে ডেকে তার স্বপ্নের কথা বললেন। এরপর রাজা এবং রানি দু'জনেই সিদ্ধান্ত নিলেন পুত্রকে অচিরেই বিয়ে দেবেন। সংসারে নাতি-নাতনি আসবে। রাজার শেষ বয়সে যেন নতুন প্রজন্মের মুখও দেখে যেতে পারেন।

যেমন কথা তেমন কাজ। রাজা পাত্রী খুঁজতে লাগলেন। পাত্রী ধনী হোক বা গরিব তাতে কিছু যায় আসে না। তবে পাত্রীকে গুণবর্তী ও বুদ্ধিমতী হতে হবে। কিছুদিন খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল অপরূপা সুন্দরী এক তরুণী। মেয়েটি ছিল জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও গুণে ঐ শহরের সবচেয়ে অতুলনীয়া।

রাজার বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব যাওয়ার পর পাত্রীপক্ষের সবাই সম্মতি প্রকাশ করল। এরপর ভালো একটা দিন দেখে শহরের সকল গণ্যমান্য লোকদের আমন্ত্রণ করে বিয়ের আয়োজন করা হলো। বর ও কনেকে নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত তখন অনুষ্ঠানের মাঝে ঘটে গেলো এক দুর্ঘটনা।

ওই শহরে বাস করতো এক জাদুকর বুড়ি। সে রাজপুত্রকে দূর থেকে দেখে ভালোবাসতো। রাজপুত্র তো জানতো না যে তাকে জাদুকর বুড়িটা ভালোবাসে। সকলের অগোচরে জাদুকর বুড়ি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলো। সে রাজপুত্রের খাবারের সাথে জাদুর ঔষধ মিশিয়ে দিল।

সবাই যখন খেতে গেল, রাজপুত্রও তখন খেতে লাগল ঔষধ মেশানো খাদ্য। সেই খাদ্য রাজপুত্রের পেটে যেতেই সে অন্যরকম হয়ে গেল। নতুন বউকে সে মেনে নিতে পারল না। সে কুৎসিত জাদুকর বুড়ির প্রেমে পড়ে গেল। রাজ্যে হাহাকার শুরু হয়ে গেল। রাজা-রানি, আত্মীয়-স্বজন সবাই চিন্তায় অস্থির, একি হলো! রাজার শরীরও দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। সুদর্শন রাজপুত্রও দেখতে দেখতে কুৎসিত হয়ে গেল। রাজ্যের সকল ডাক্তার কবিরাজও তার রোগ ধরতে পারল না। রাজপুত্রের অসুস্থতায় রাজ্যের সবাই মনোকষ্ট নিয়ে দিন পাড় করতে লাগল।

হঠাৎ একদিন ওই রাজ্যে একজন দক্ষ চিকিৎসক বেড়াতে এলেন। তিনি জানতে পারলেন যে, এ রাজ্যের রাজপুত্র অসুস্থ। রাজার কাছে তিনি আবেদন করলেন রাজপুত্রের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে। তিনি রাজপুত্রকে দেখেই বুঝতে পারলেন যে, তার উপর জাদুর প্রভাব আছে।

চিকিৎসক রাজাকে ডেকে পরামর্শ দিলেন: আপনার ছেলেকে ধর্ম কর্মে মনোযোগী করুন। সে যদি নিয়মিত আল্লাহর প্রার্থনা করে তবেই জাদুর প্রভাব কেটে যাবে, সে সুস্থ হয়ে উঠবে।

তখন থেকে রাজপুত্র আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে তার ইবাদত শুরু করল। ধীরে ধীরে রাজপুত্র সুস্থ হয়ে উঠল। রাজপুত্র ভেবেই পাচ্ছিল না যে, তার উপর কিভাবে জাদু করা হয়েছিল? রাজপুত্র পূর্বাবস্থা ফিরে পেল। রাজ্যে আবার আনন্দ ফিরে এলো। রাজা রাজ্যের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে মেহমানদারি করলেন এবং সকলে মিলে রাজপুত্র ও নববধুর জন্য কল্যাণ কামনা করলেন।

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে এক বাংলাদেশি বন্ধুর সাক্ষাৎকার।

 

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী আসরে।#

 

 

 

ট্যাগ