আগস্ট ০২, ২০২২ ১৭:০৪ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম উপলক্ষে ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার পঞ্চম পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।

আজ ৫ মহররম। আজ হতে ১৩৮৩ চন্দ্র-বছর আগে ৬১ হিজরির এ দিনে বসরা ও কুফায় নিযুক্ত ইয়াজিদের গভর্নর ইবনে জিয়াদের নির্দেশে হাসিইন বিন নুমাইর চার হাজার অশ্বারোহী সেনা নিয়ে কারবালায় আসে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর সঙ্গীদের ক্ষুদ্র দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। একই দিনে জিয়াদ শাবাশ বিন রবি নামের এক ব্যক্তিকে এক হাজার সেনাসহ কারবালায় পাঠায়।এ ছাড়াও সে 'জাহর বিন কাইস' নামের এক ব্যক্তিকে ৫০০ সেনাসহ কারবালা ময়দান-সংলগ্ন ফোরাত নদীর শাখার একটি সেতুর ওপর এ দায়িত্বে নিয়োজিত করে যে, কেউ যদি ইমাম হুসাইন (আ.)’র পক্ষে যুদ্ধ করতে কারবালায় প্রবেশ করে তাকে সে হত্যা করবে। কিন্তু 'সা'দা' নামের ওই সেতুর ওপর প্রহরা সত্ত্বেও ইমামের অনুরাগী ঘোড়-সওয়ার আমের বিন আবি সালামাহ ৫ মহররম নিজের ঘোড়া নিয়ে একাই জাহরের বাহিনীর ওপর বীর-বিক্রমে হামলা চালান এবং ইয়াজিদ বাহিনীর প্রতিরক্ষা-ব্যূহে ভাঙ্গন ধরিয়ে ইমাম-শিবিরে যোগ দিতে সক্ষম হন। এই মহান বীর আশুরার দিনে শাহাদত বরণ করেন।

ইমাম হুসাইনের (আ.) আন্দোলনে‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকারের’ উপস্থিতি এই আন্দোলনকে যেমন একটা মহান আদর্শে পরিণত করেছে ঠিক তেমনিভাবে এ আন্দোলন,‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’কে বেশি গুরুত্ববহ করে তুলেছে। ইসলামের এই রোকন ইমাম হুসাইনের (আ.) আন্দোলনকে শুধু ইসলামী বিপ্লবের শীর্ষেই আসন দান করেনি ,বরং যুগ যুগ ধরে বিপ্লবী মুসলমানদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শে রূপান্তরিত করেছে। তেমনিভাবে হুসাইনী আন্দোলনও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধকে ইসলামের মূল ভিত্তিগুলোর প্রথম সারিতে স্থান করে দিয়েছে। ইসলামের এই ভিত্তিকে একবারে ভুলেই যাচ্ছিল মুসলমানরা। অথচ নামায কিংবা রোযার মত‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ -এর গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়।

ইমাম হুসাইন (আ.) বিশ্বকে বোঝালেন যে,‘ আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনীল মুনকারের’ জন্যে জীবনও দেয়া যায়,ধন-সম্পদ সবকিছু উৎসর্গ করা যায়। ইসলামের এই ভিত্তিটির জন্যে পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি কি ইমাম হুসাইনের (আ.) ন্যায় আত্মত্যাগ করতে পেরেছে? ইমাম হুসাইনের (আ.) আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অর্থ হল এটা যে,‘আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনীল মুনকারের’ মূল্য এত বেশী যে তার জন্যে এ ধরনের আত্মত্যাগও করা যায়।

যেদিন ইমাম মক্কা ছেড়ে আসেন সেদিন মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার কাছে লেখা অসিয়তনামায় তিনি লিখেন :

‘‘ আমি কোনো ধন-সম্পদ বা ক্ষমতার লোভে কিংবা কোনো গোলযোগ সৃষ্টির জন্যে বিদ্রোহ করছি না,আমি শুধু আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই,আমি‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ করতে চাই এবং আমার নানা যে পথে চলেছেন আমিও সেই পথে চলতে চাই।’’ ( দ্রঃ মাকতালু খারাযমীঃ ১ / ১৮৮ )

ইমাম হুসাইন (আ.) দীর্ঘ পথ চলার সময় একাধিকবার তার এই লক্ষ্যকে পুনঃ পুনঃ উল্লেখ করেন। বিশেষ করে এ সময়গুলোতে তিনি বাইয়াত প্রসঙ্গেরও যেমন কোনো উল্লেখ করেননি তেমনি দাওয়াত প্রসঙ্গেরও কোনো উল্লেখ করেননি। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল পথিমধ্যে তিনি যতই কুফা সম্পর্কে ভয়ানক ও হতাশাব্যঞ্জক খবর শুনছিলেন ততই তার বক্তব্য জ্বালাময়ী হয়ে উঠছিল। তিনি বলেছিলেন,

‘‘ তোমরা কি দেখতে পাচ্ছনা যে সত্য অনুসারে আমল করা হচ্ছে না,তোমরা কি দেখতে পাও না যে আল্লাহর বিধানসমূহকে পদদলিত করা হচ্ছে ? দেখতে পাওনা যে চারদিকে ফেতনা-ফ্যাসাদে ছেয়ে গেছে অথচ কেউ এর প্রতিবাদ করছে না?’’

‘‘ এ অবস্থায় একজন মুমিনের উচিত নিজের জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা। যদি জীবন উৎসর্গ করতেই হয় তাহলে এটাই তার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।’’ (দ্রঃ তুহফাল উকুলঃ ২৪৫ )

অর্থাৎ‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ এতই মূল্যবান। পথিমধ্যে উচ্চারিত অন্য আরেকটি খোতবায় ইমাম সার্বিক অবস্থার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ

‘‘ হে লোকসকল! আমি এই পরিস্থিতিতে মৃত্যুবরণকে কল্যাণ ও মর্যাদাকর ছাড়া আর কিছুই মনে করি না।’’ অর্থাৎ একে আমি সত্যের জন্যে শহীদ হওয়া মনে করি। এ থেকে বোঝা যায় যে‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ করতে গিয়ে নিহত হলে সে শহীদের মর্যাদার অধিকারী হবে। .

‘‘ আর জালেমদের সাথে বেঁচে থাকাকে আমি নিন্দাকর অপমান মনে করি। আমার আত্মা এমন আত্মা নয় যে,জালেমদের সাথে আপোষ করে বেঁচে থাকতে পারবে।’’

ইমাম আরো বড় কথা বলেন যখন অবস্থা শতভাগ প্রতিকূল হয়ে ওঠে। কাফেলা যখন ইরাকের সীমানায় পৌঁছায় তখন হুর ইবনে ইয়াযিদ আর-রিয়াহীর এক বিশাল বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হন। হুর এক হাজার সৈন্যযোগে ইমামের কাফেলাকে বন্দী করে কুফায় নিয়ে যাবার দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল। ইমাম সে সময় রাসূলুল্লাহর (সা.) উদ্ধৃতি দিয়ে‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন :

হে লোকসকল! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘ যদি কেউ কোনো অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী সরকারকে দেখে যে হালালকে হারাম করে,হারামকে হালাল করে,বায়তুলমালকে নিজের ব্যক্তিগত খাতে খরচ করে,আল্লাহর বিধি-বিধানকে পদদলিত করে,মুসলমানের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করে না,এরপরও যদি সে নিশ্চুপ বসে থাকে তাহলে আল্লাহ তাকে ঐ জালেমদের সাথে একই শাস্তি প্রদান করবেন।

আজকে যারা (বনি উমাইয়ারা) হুকুমত করছে তারা কি ঐসব জালেম ও স্বৈরাচারীদের মতন নয়? দেখতে পাও না যে তারা হালালকে হারাম করেছে আর হারামকে হালাল? তারা কি আল্লাহর বিধানকে পদদলিত করেনি? বায়তুলমালের অর্থকে তারা কি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেনি? আত্মসাৎ করেনি? তাই এরপরও যারা নীরবতা অবলম্বন করবে তারাও ইয়াযিদদের মতোই দোষী বলে সাব্যস্ত হবে।’’ এবার তিনি নিজের প্রসঙ্গে বলেন : আর আমার নানার এই আদেশ পালন করতে অন্যদের চেয়ে আমিই বেশী যোগ্য,আমারই দায়িত্ব অধিক ।’’ ( দ্রঃ তারিখে তাবারীঃ ৪ / ৩০৪ )

কোনো মানুষ যখন ইমাম হুসাইনের (আ.) এসব বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচিত হয় তখন বলে যে,এ ধরনের ব্যক্তিই তো চির ভাস্বর হয়ে থাকার অধিকার রাখেন। তিনিই তো চিরঞ্জীব থাকার যোগ্য । কেননা হুসাইন নিজের জন্যে ছিলেন না। তিনি নিজেকে মানুষ ও মানবতার জন্যে উৎসর্গ করেছেন। একত্ববাদ,ন্যায়পরায়ণতা এবং মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। আর এ কারণেই সব মানুষই তাঁকে ভালবাসে,তাঁকে শ্রদ্ধা করে। যখন কোনো মানুষ এমন একজনকে দেখে যার নিজের জন্যে কিছুই নেই,মান-সম্মান,মর্যাদা,মানবতা যা আছে তা সবই অন্যের জন্যে -তখন সে নিজেকে ঐ ব্যক্তির সাথে একাত্ম করে নেয়।#

 

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ