মে ১৯, ২০২২ ২২:৩৩ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। প্রত্যেক আসরের মতো আজও তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)-এর নাম শুনেছো! ৮৩ হিজরির ১৭ রবিউল আউয়াল পবিত্র মদীনায় জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর পিতা ইমাম মুহাম্মাদ বাকের ছিলেন মহানবীর আহলে বাইতের সদস্য। আর মা ছিলেন উম্মে ফারওয়াহ ফাতিমা। অনন্য চরিত্র ও নৈতিকতার অধিকারী ইমাম সাদিক (আ.) ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও মহাজ্ঞানী। পিতার পাশাপাশি দাদা ইমাম জাইনুল আবেদীন (আ.)-এর কাছেও শিক্ষালাভ করেন তিনি।

বন্ধুরা, আজকের আসরে এই মহান মনীষীর জীবন থেকে নেওয়া কয়েকটি ঘটনা শোনাব। আর সবশেষে থাকবে একটি নাতে রাসূল। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটি গ্রন্থনা ও প্রযোজনা করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে সত্য ঘটনাগুলো শোনা যাক।

পরিবারে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর খরচাদি অনেক বেড়ে গেল। তাই তিনি সাংসারিক খরচাদি মেটাবার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোন উপায়ে আয়ের উৎস বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলেন। একবার তিনি এক হাজার দিনার যোগাড় করে তার গোলাম মুসাদিফকে দিয়ে বললেন, এই দিনারগুলো নিয়ে মিশরে গিয়ে ব্যবসা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করো।

মুসাদিফ এক হাজার দিনার দিয়ে এমনসব মালামাল কিনল মিশরের বাজারে যেগুলোর চাহিদা বেশী। এরপর মিশরগামী একটা ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে শামিল হয়ে মিশরের দিকে চলল।

মিশরের কাছে পৌঁছালে মিশর থেকে ফেরা অপর একটি ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে তাদের সাক্ষাৎ হলো। উভয় কাফেলার লোকেরা পরস্পরের হালঅবস্থা জিজ্ঞাসা করল। আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে তারা জানতে পারলো যে, মুসাদিফ ও তার সফর-সাথীদের সাথে যে মালামাল রয়েছে, মিশরের বাজারে তার খুব চাহিদা আছে। ব্যবসায়ীরা এ খুশির সংবাদ পেয়ে সকলে মিলে এ সিদ্ধান্ত নিল যে, শতকরা একশ ভাগ লাভ না করে তারা মালামাল বিক্রি করবে না।

মিশরে পৌঁছেই তারা বুঝতে পারল যে, রাস্তায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া খবর সম্পূর্ণ সত্য। এসময় আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা প্রথমে কালোবাজারির পরিবেশ সৃষ্টি করল। কেউ তাদের মাল দ্বিগুণ দামের কমে বিক্রি করল না। যেহেতু বাজারে সেসব মালের সরবরাহ কম এবং চাহিদা বেশি ছিল তাই অল্প দিনের মধ্যেই তাদের সমস্ত মালামাল দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়ে গেল।

অন্যান্য ব্যবসায়ীর ন্যায় মুসাদিফও এক হাজার দিনার মুনাফা নিয়ে মদীনায় ফিরে আসল। সে খুব আনন্দিত মনে ইমাম সাদিক (আ.)-এর খেদমতে উপস্থিত হলো। এক হাজার দিনার করে দুটি থলি ইমামের সামনে রেখে দিল।

ইমাম জিজ্ঞাসা করলেন: এগুলো কী? জবাবে মুসাদিফ বলল: এর মধ্যে একটি থলিতে সে টাকা যা আপনি আমাকে পুঁজি হিসেবে দিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় থলিতে ব্যবসায়ের মুনাফার টাকা যা পুঁজির সমান।

ইমাম (আ.) বললেন, মুসাদিফ! অনেক বেশি মুনাফা দেখা যাচ্ছে। বলো তো, কিভাবে তোমরা এতো বেশী লাভবান হয়েছো?

মুসাদিফ বলল: ঘটনা হল, আমরা যখন মিশরের কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন সংবাদ পেলাম যে, আমরা যেসব মালামাল নিয়ে যাচ্ছিলাম সেগুলোর মিশরে খুবই চাহিদা। তারপর আমরা ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, শতকরা একশ ভাগ মনাফা না করে আমরা কেউ মাল বিক্রি করব না। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কাজ করলাম।

ইমাম (আ.) বললেন, তোমরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছো যে, মুসলমানদের মধ্যে কালোবাজারির পরিবেশ সৃষ্টি করবে। তোমরা কসম করেছো যে, পুঁজির সমান মুনাফা না করে মাল কেউ বিক্রি করবে না। আমি এ ধরনের ব্যবসা ও লাভ কোনদিন কখনও পছন্দ করি না।

এরপর হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) একটি থলে তুলে নিলেন এবং বললেন, এটা আমার পুঁজি। দ্বিতীয় থলেটি সেখানে পড়ে থাকলো। ইমাম বললেন, ও টাকার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

এরপর ইমাম (আ.) বললেন, হে মুসাদিফ। হালাল রুজির মোকাবিলায় তলোয়ার চালনা সহজতর। ইমাম জা ফর সাদিক (আ.) নিজের কাজ নিজেই করতেন। একবার তিনি  শ্রমিকের পোশাক পরে হাতে বেলচা নিয়ে নিজের জমিতে কাজ করছিলেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাজ করার কারণে তার সমগ্র শরীরটা ঘামে ভিজে চুপ চুপ হয়ে গেল।

এমন সময় আবু আমর শাইবানি নামের এক ব্যক্তি সেখানে এসে উপস্থিত হলো। সে দেখতে পেল, ইমামের দেহ থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে। সে ভাবল- হয়তো শ্রমিক পাওয়া না যাওয়াতে ইমাম নিজেই নিজের ক্ষেতে কাজ করা শুরু করেছেন। তাই সে এগিয়ে গিয়ে বলল, হে ইমাম! বেলচাটি আমাকে দিন। বাকী কাজটুকু আমি করব।

ইমাম (আ.) বললেন, না! আসলে আমি খুব পছন্দ করি যে, মানুষ রোজগারের জন্য নিজে পরিশ্রম করবে এবং রুটি-রুজি অর্জন করার জন্য রোদের প্রখরতা সহ্য করবে।

এক ব্যক্তি খুবই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সাথে ইমাম জা ফর সাদিক (আ.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বলল, 'আমি খুব দরিদ্র ও অভাবী মানুষ। আপনি আমার জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ আমার রিজিক বাড়িয়ে দেন। আর আমি যেন সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি।'

ইমাম সাদিক (আ.) বললেন : আমি তোমার জন্য কখনো এমন দোয়া করব না।

লোকটি একটা চাপা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল: হে ইমাম! কি কারণে আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন না?

জবাবে ইমাম (আ.) বললেন : 'তুমি খুব ভালভাবেই জানো যে, মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে একটা পন্থা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। তিনি হুকুম দিয়েছেন যে, জীবিকা অর্জনের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ো এবং পরিশ্রম করো। কিন্তু তুমি চাচ্ছো যে, ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে জীবিকা অর্জনের পরিবর্তে দোয়ার দ্বারা রিজিক ঘরে ডেকে আনবে।'

লোকটি তার ভুল বুঝতে পেরে রিজিকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। 

বন্ধুরা, এবার এমন এক লোকের কথা বলব যিনি হযরত ইমাম জা ফর সাদিক (আ.)-এর বন্ধু হিসাবে খ্যাত ও পরিচিত ছিলেন। কিন্তু একদিন সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।

তাদের কেউ কোনদিন চিন্তাও করতে পারেননি যে, এ বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ ঘটবে। একে অপর থেকে আলাদা হয়ে যাবেন।  

একদিন লোকটি ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর সাথে একটি বাজারের দিকে রওনা হলেন। লোকটির সাথে তার সাথে তার কৃষাঙ্গ গোলামও ছিল। গোলাম তার মালিকের পিছে পিছে চলছিল।

কিছু দূর চলার পর পেছনে ফিরে সে তাকিয়ে দেখে তার গোলাম নেই। আরও একটু সামনে চলার পর পিছনে ফিরে দেখল গোলামকে দেখা যায় না। কিছুক্ষণ পর আবার মুখ ঘুরিয়ে দেখল কিন্তু গোলামের কোনো খোজ নেই। মনে হচ্ছিল সে বাজারের খেল-তামাশা দেখার মধ্যে লিপ্ত হয়ে গেছে। আর তার মালিক ও মালিকের সাথীরা অনেক আগে চলে গেছে। চতুর্থবার পিছনে ফিরে দেখে যে তার গোলাম হাজির। গোলামকে দেখেই সে ক্রোধে আক্রোশে বলে উঠল:

হারামজাদা! এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

বন্ধুর মুখ থেকে এমন অশ্রাব্য কথাটি শুনে ইমাম জা ফর সাদিক (আ.) আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, তুমি তার মাকে গালি দিলে? তুমি তার মাকে অবৈধ কর্মের সাথে সম্পৃক্ত করলে? আমি তো এতদিন ভেবেছিলাম যে, তুমি একজন মোত্তাকী- পরহেজগার লোক। কিন্তু আজ তোমার প্রকৃত রূপ সামনে এসে গেছে। দেখা যাচ্ছে তোমার মধ্যে তাকওয়া পরহেজগারীর নাম-নিশানাও নেই।

লোকটি বললো, হে রাসূলের সন্তান! এ গোলামটি আসলে সিন্ধী। তার মাতাও সিন্ধী। আপনি তো জানেন যে, তারা মুসলমান নয়। আর গোলামের মা কোন মুসলমান নারী নয় যে, আমি তার উপর অবৈধ কাজের অপবাদ লাগিয়ে দিয়েছি।

ইমাম (আ.) বললেন, তার মাতা কাফের ছিল, একশবার থাকুক। প্রত্যেক জাতির মধ্যেই বিয়েশাদীর একটা নিয়ম-কানুন ও বিশেষ প্রথা বর্তমান থাকে। যদি কোনো জাতির লোক তার জাতীয় নিয়ম-নীত ও পন্থা অনুসরণ করে বিয়ে-শাদী করে, তাহলে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কোনোদিন অবৈধ সম্পর্ক হবে না। আর তাদের সন্তানদেরকে হারামজাদা বা অবৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য করা যাবে না।

ইমাম তাকে আরো বললেন, তুমি এ মুহূর্তে আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাও। আর কোনোদিন আমার কাছেও আসবে না।

সেদিন থেকে কেউ হযরত ইমাম জা ফর সাদিক (আ.)-কে আর কোনোদিন ঐ লোকটির সাথে চলতে দেখেনি। আজীবন তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ বহাল ছিল।

বন্ধুরা, বিশ্বনবী হযরত মুহম্মাদ (সা.)-এর বংশধর ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর জীবন থেকে নেওয়া কয়েকটি ঘটনা শুনলাম। অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি নাতে রাসূল। 'তুমি জাগরনে থেকো শয়নে'  শিরোনামের নাতটির কথা ও সুর লিটন হাফিজ চৌধুরীর। আর গেয়েছে শিশুশিল্পী জাহিন ইকবাল।

(গানের অডিও)

জাহিন ইকবালের দরদমাখা কণ্ঠে চমৎকার কথামালার গানটি শুনলে। বন্ধুরা, তোমরা সবাই বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের ইমামদের আদর্শ অনুযায়ী নিজেদের জীবনকে গড়ার চেষ্টা করবে- এ কামনায় গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী আসরে।

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/মো.আবুসাঈদ/১৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ