সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৭ ১৯:০৭ Asia/Dhaka
  • নূরনবী মোস্তফা (সা.) : পর্ব ২৫

রাসূলে খোদার অবয়ব গঠন ছিল খুবই সুন্দর৷ এমনিতেই তাঁর চেহারা দেখার সাথে সাথে আনন্দে ছল ছল করে উঠতো সবার চোখ ৷ চাঁদের মতো তাঁর পবিত্র মুখখানি সবার কাছেই ছিল প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ৷

তিনি না খুব হালকা-পাতলা ছিলেন, না ছিলেন খুব মোটা ৷ চোখ ছিল কালো এবং বড়ো বড়ো, ভ্রুগুলো ছিল চিকন চিকন এবং পরস্পরে যুক্ত ৷ দুই কাঁধ বরাবর চুলের মাঝখানে নবুয়্যতির সিল দেখা যেত ৷ আনন্দ বা তুষ্টিতে তাঁর চেহারা জ্বলজ্বল করতো ৷ পথ চলার সময় তাঁর গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টি থাকতো সামনের দিকে৷ হাঁসলে তাঁর দাঁতগুলো শিলাবৃষ্টির শিলার মতো দেখা যেত তবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শ্বেতশুভ্র দাঁতগুলো ঠোঁটের নিচে হারিয়ে যেত ৷ তিনি যখন বাসায় যেতেন,তাঁর সময়গুলোকে তিন ভাগে ভাগ করতেন ৷

একাংশ আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে,একাংশ নিজের এবং জনসাধারণের কাজের জন্যে এবং বাকি অংশ পরিবারের লোকজনের সাথে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করার জন্যে বরাদ্ধ করতেন৷ হযরত আয়েশা বলেন,'নবীজী তাঁর পরিবারের মাঝে সবচে কোমল, সবচেয়ে মহানুভব এবং সবচেয়ে হাঁসিখুশি ছিলেন ৷'

বিয়ে হলো একটা পবিত্র বন্ধন এবং উন্নতি ও অগ্রগতির উপায় ৷ইসলাম তাই বিয়ে করার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে ৷ নবী করীম (সা) 'র দৃষ্টিতে আল্লাহর কাছে বিয়ের চেয়ে প্রিয়তর আর কোনো বন্ধন পছন্দনীয় নেই৷ তিনি চাইতেন বিয়ে করার মাধ্যমে জনগণ একটা নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলুক, পবিত্র বংশ পরম্পরার একটা স্থায়ী ধারার প্রবর্তন করুক৷এভাবে নবীজী পারিবারিক একটা নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন৷ রাসূলে খোদা চাইতেন স্বামী-স্ত্রী তাদের দাম্পত্য জীবন আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে কাটাক৷ কারণ একটা পরিবার হলো শিশুর সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে ওঠার প্রথম পাঠশালা৷

নবীজীর দৃষ্টিতে দয়া, শান্ত-নম্রতা ও মার্জিত স্বভাব হলো চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের লক্ষণ৷ ঘরের ভেতর এইসব গুণাবলীর উপস্থিতি থাকলে ঐ ঘরের পরিবেশটাই অন্যরকম সুন্দর হয়ে যায় ৷ তাই নবীজী বলেছেন : 'মুসলমানদের মধ্যে তিনিই উত্তম যিনি তাঁর পরিবারের জন্যে সর্বোত্তম ৷' পরিবারের অভ্যন্তরে রাসূল (সা) কে সর্বপ্রথম যিনি এই সুস্থতা ও নিরাপত্তা উপহার দিলেন এবং ইসলামের দাওয়াতি কাজে নবীজীর দিকে সহযোগিতার হাত সমপ্রসারিত করলেন, তিনি হলেন হযরত খাদিজা ( সা ) ৷ মহিয়সী এই রমনী খুবই সম্পদশালী ছিলেন৷ তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন ৷ মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনে যখন তিনি প্রবেশ করেন, তখন তিনি যেন মধুময় এক নতুন জীবন উপভোগ করতে শুরু করেন ৷ তিনি তৌহিদের কালেমার সৌজন্যে তাঁর সকল সম্পদ নবীজীর খেদমতে উত্‍সর্গ করেন ৷ নবীজীও সবসময় খাদিজা ( সা ) কে যথাযোগ্য সম্মান দেখাতেন ৷ খাদিজা ( সা ) এর মৃত্যুর পর রাসূল তাঁকে স্মরণ করে বলতেন-তিনি আমাকে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছেন ৷ যে সময় লোকজন আমাকে অপমান করেছিল এবং আমাকে জনবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল, তখন খাদিজা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল ৷

পরিবারের অভ্যন্তরে নবীজীর আচরণ এতো ভদ্র ,নম্র ও মার্জিত ছিল যে ,সেই যুগের একটা উগ্র ও নির্দয় সমাজে তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ৷ এমনিতে নবীজীর ওপর ছিল ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব প্রদানের গুরুদায়িত্বভার ৷ তারপরও তিনি নিজ ঘরে এতো নম্র ও ভদ্র আচরণ করতেন ৷ নবীজী সবসময়ই ভালো কাজ করবার জন্যে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্যে সবাইকে অনুপ্রেরণা দিতেন ৷ হযরত আয়েশা ( সা ) বলেনঃ একদিন রাসূলে খোদা আমার ঘরে ছিলেন৷

যা কিছু রান্না-বান্না হয়েছিল সাফিয়া তাঁর জন্যে পাঠিয়ে দিল ৷ চাকরের হাতে যখন খাবার দেখলাম,তার হাত থেকে সহসা খাবারের বাটিটা নিয়ে এক পাশে ছুঁড়ে মারলাম৷ আমার এই কাণ্ড দেখে রাসূলে খোদা (সা) বিস্মিত হলেন ৷ আমার আচরণে তিনি যে বেশ নাখোশ হলেন তা তাঁর চেহারা মুবারকে ফুটে উঠেছিল৷

তাঁকে বললাম-ইয়া রাসূলাল্লাহ! আশা করি আমাকে ভর্ত্‍সনা করবেন না ৷ নবীজী তাঁর স্বাভাবিক প্রশস্ত হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে বললেনঃ 'তাওবা করো!' আমি বললাম, আমি কীভাবে এর ক্ষতিপূরণ দিতে পারি? নবীজী বললেনঃ 'সাফিয়া যেরকম খাবার তৈরি করেছিল এবং তার খাবারের বাটিটা যেরকম ছিল,ঠিক সেরকম খাবার এবং সেরকম বাটির ব্যবস্থা করে তার কাছে পাঠিয়ে দাও ৷' ইসলামের মহান নবী নারীদের সাথে সদ্ব্যবহারকে নবীচরিত্র্যের বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন ৷

তিনি মনে করেন সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তির পরিচয় ফুটে ওঠে নারীদের প্রতি তাদের সম্মান প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ৷ তাঁর ভাষায়ঃ 'সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী মানুষেরা নারীদেরকে সম্মান দেয় আর কদাকার চরিত্রের লোকেরা নারীদেরকে মর্যাদাহীন বা তুচ্ছ জ্ঞান করে ৷' রাসূলের একজন সাহাবী পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ৷

নবীজী তাঁর নামাযে জানাযায় শরীক হলেন এবং একটা বিশেষ উপায়ে নিজ হাতে তাকে কবরে শায়িত করলেন ৷ তার মা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বললো তোমার জন্যে কাঁদবো না বাবা,কেননা নবীজীর হাতে তুমি কবরে শায়িত হয়েছো,নিশ্চয়ই তুমি পরকালীন জীবনে সৌভাগ্য ও মর্যাদার অধিকারী হবে৷ মৃতের মা যখন চলে গেল,তখন নবীজী সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বললেন,'কবর তাকে এমন চাপ দিয়েছে যে,তার পাঁজরের হাড়গুলো গুঁড়িয়ে গেছে৷' সবাই আশ্চর্য হয়ে বললো, কেন তাকে এরকম শাস্তি দেওয়া হলো? অথচ সে তো ভালো মুসলমান ছিল ! নবীজী বললেনঃ 'তা ঠিক ৷ তবে সে তার নিজ ঘরে উগ্র আচরণ করতো, চারিত্র্যিক স্বভাব তার বাজে ছিল ৷'

পরিবার এবং স্ত্রীদের সাথে নবীজী এমন বিনম্র ও সদয় আচরণ করতেন যে, কখনো কখনো দেখা যেত তাঁর সাথে অন্যরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতো ৷ তাদের ধৃষ্টতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে,ঘরের ভেতরকার কথা পর্যন্ত ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল ৷ শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের হুশিয়ার করে দেওয়ার জন্যে সূরা তাহরীমের তিন থেকে পাঁচ নম্বর আয়াত নাযেল করা হয়েছিল ৷

বনী কোরাইযা গোত্রে সাথে যুদ্ধে মুসলমানরা গনীমাতের মালের অধিকারী হয়েছিল৷ এই যুদ্ধের পর হাফসা এবং আয়েশা খানিকটা বিলাসী জীবন চিন্তা করেছিল৷ তারা নবীজীর কাছে কিছু গয়না-গাটি চেয়েছিল৷ কিন্তু নবীজী তাদের দাবী না মেনে বরং বললেন,'আমি ইসলাম এবং মুসলমানদের নেতা৷ আমার জীবন অত্যন্ত সাদামাটা ও অনাড়ম্বর এজন্যে যে যাতে গরবী-দুখিগণ নিজেদের অসহায় বোধ না করে৷' কিন্তু তারা দু'জন নাছোড়বান্দা৷ নবীজী অবশ্য ক্ষিপ্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না৷

তবে হাফসার পিতা ওমর এবং আয়েশার পিতা আবু বক্বর তাদের নিজ নিজ কন্যাদেরকে তিরষ্কার করলেন৷ কিন্তু নবীজী তাঁর শ্বশুরদের আচরণে অসন্তুষ্ট হলেন এবং মজলিস ত্যাগ করলেন৷ অল্প পরেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আহযাবের ২৮ এবং ২৯ নম্বর আয়াত নাযিল করলেন৷ সেখানে রাসূলে খোদার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছেঃ 'হে প্রিয় নবী ! আপনার স্ত্রীদের বলুন-'তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার শোভা-সৌন্দর্য কামনা করো,তাহলে এসো,আমি তোমাদের ভোগ্যবস্তুর ব্যবস্থা করে দেবো এবং তোমাদের বিদায় দেবো সৌজন্যময় বিদায়দানে ৷

আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে এবং আখেরাতের আবাস কামনা করে থাকো,তাহলে আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যকার সত্‍কর্মশীলদের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছেন বিশাল প্রতিদান ৷'

হযরত আলী ( আ ) বলেন,রাসূলে খোদা একদিন ঘরে প্রবেশ করলেন ৷ এ সময় হযরত ফাতেমা ( সা ) রান্না করছিলেন আর আমি ডাল পরিষ্কার করছিলাম৷ রাসূলে কারীম ( সা ) আমাকে যখন এ অবস্থায় দেখলেন,তখন বললেন,'হে আলী! শোনো ! আল্লাহ যা আদেশ করেছেন,আমি তার বাইরে অন্যকিছু বলবো না৷ যে ব্যক্তি ঘরে তার স্ত্রীকে সহযোগিতা করে এবং বদমেজাজি বা খারাপ আচরণ না করে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নামকে শহীদদের তালিকাভুক্ত করেন এবং তাকে শাহাদাতের পুরস্কার দেবেন৷ স্ত্রীকে সহযোগিতা করার সময় যে ব্যক্তি কোনোরকম অহমিকা বা বাজে আচরণ না করে,সে বিনা হিসাবে বেহেশ্তে প্রবেশ করবে ৷' স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হবে নবীজী নিজেই ছিলেন তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ৷ নবীজী ঘরের ভেতর নিজের জামা-কাপড় এবং জুতা নিজেই সেলাই করতেন ৷

নিজেই দুম্বা এবং উটের দুধ দোহন করতেন ৷ গম ভানতো যে, তাকে সঙ্গ দিতেন এবং সে ক্লান্ত হয়ে গেলে নিজেই ঐকাজে সহযোগিতা করতেন৷ আল্লাহর দেওয়া হালাল রুযি পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং যারা কাজ করতো তাদের সবাইকে নিয়ে একসাথে খেতেন৷ বহু লোকজন নিয়ে একসাথে খাওয়া খেতে তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন৷ তিনি যেহেতু প্রাজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী ছিলেন, সেহেতু স্বামী-স্ত্রীর প্রতি তিনি আহ্বান জানাতেন, তারা যেন পরস্পরের প্রতি তাদের ভালোবাসা নিবেদন করেন৷ দম্পতিরা যেন একে অপরকে তাদের ভালোবাসা নিবেদন করে তার ওপর তিনি ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন ৷ কোনো পুরুষ যদি এই কাজ করে,তাহলে তার স্ত্রীর মন থেকে তার প্রতি ভালোবাসা কোনোদিন যাবে না ৷

নিজের সন্তানদের ওপর নবীজীর ব্যাপক ভালোবাসা ও মায়া-মমতা ছিল৷ এমনিতেও তিনি শিশুদের প্রতি ছিলেন সদয়৷ শিশুদের বিনোদিত করতে অর্থাৎ তাদের মনে আনন্দ দেওয়ার জন্যে তাদের সাথে খেলতেন৷ জাবের বলেন, একদিন দেখলাম হাসান এবং হোসাইন নবীজীর পিঠে চড়ে বসেছে৷ নবীজী হাত-পা চালিয়ে এগুচ্ছেন আর বলছেন,ভালো বাহন পেয়েছো,তোমরাও খুব ভালো চালক৷ কিন্তু যখন এ আয়াত নাযিল হলো ' নিজেদেরকে যেভাবে তোমরা ডাকো ,নবীজীকে সেভাবে ডেকো না অর্থাৎ সম্বোধন করো না৷' নবীজীর আগমন ঘটায় ফাতেমা (সা) সামনে এসে বললেন 'হে আল্লাহর রাসূল ! তোমার প্রতি সালাম! রাসূল (সা) তাঁর প্রিয়কন্যা ফাতেমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং বললেন, ' না মেয়ে ! তুমি আমাকে বাবা বলো ৷ এই ডাক আমার খুবই প্রিয় ৷'

হ্যাঁ ! আল্লাহর সর্বশেষ দূত রাসূলে খোদা ( সা ) সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরকমই অনন্য ব্যক্তিত্ব ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন ৷#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/৭

ট্যাগ