সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭ ২১:২১ Asia/Dhaka
  • নূরনবী মোস্তফা (সা.) : পর্ব ২৮

জাফর ইবনে আবি তালিবের স্ত্রী আসমা বিনতে আমিস রাসূলের ওপর ঈমান আনার পর থেকে উন্নত জ্ঞান চর্চা করার কথা ভাবতে থাকেন৷ একজন জ্ঞানী মহিলা এবং হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন৷ আসমা তাঁর স্বামীসহ মোট আশিজন নারী-পুরুষের একটি দল নিয়ে ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন৷

যখন তিনি মদীনায় এলেন,নবীজীর পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-‘মহিলাদের ব্যাপারে কোরআনের কোনো আয়াত কি রাসূলে খোদার ওপর নাযিল হয়েছে?' নবীপত্নী নেতিবাচক জবাব দিলেন৷ আসমা চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে নবীজীর কাছে গেলেন৷ নবীজী তাঁর চাওয়াটা জানতে চাইলেন৷ আসমা বললেন,হে রাসূলে খোদা! মহিলারা তো ক্ষতিগ্রস্ত,কেননা কোরআনে পুরুষদের মতো মহিলাদের ব্যাপারে কোনো ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয় নি৷

নবীজী জবাবে বললেন, ‘ আল্লাহর কাছে নারী-পুরুষের স্থান সমান৷'এর কিছুক্ষণ পরই নবীজীর ওপর ওহী নাযিল হলো-মুসলিম নর এবং মুসলিম নারী,ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার নারী, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনকারী পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী,অধ্যবসায়ী পুরুষ ও নারী, বিনয়ী পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, রোযাদার পুরুষ ও নারী, গুনাহ থেকে আত্মরক্ষাকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী পুরুষ ও নারী ! আল্লাহ তাদের সবার জন্যে পরিত্রাণ ও প্রতিদানের ব্যবস্থা করেছেন৷"ইতিহাসের বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্বের মাঝে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছেন,এমনকি তাদেরকে তাদের মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন ৷ রাসূলের সময়ে জাহেলি রীতি-নীতি অনুযায়ী নারীদের ওপর এতো নির্দয় আচরণ করা হতো যে, আরব পুরুষরা মেয়েদেরকে জীবিত রাখার চেয়ে জ্যান্ত কবর দেওয়াকে প্রাধান্য দিত ৷

রাসূলে খোদা ( সা ) এই জাহেলি রীতির বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করলেন এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে পুরোপুরি পাল্টে দিলেন৷ তিনি নারীদের মানবিক মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন৷ তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মালিকানার অধিকারকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছিলেন৷ সর্বোপরি সমাজে নারীদেরকে অসম্ভব সম্মান ও মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন ৷নবী করিম ( সা ) তাঁর আধ্যাত্মিক ও গঠনমূলক শিক্ষার আলো দিয়ে নারীদের জন্যে উন্নয়ন ও অগ্রগতির যে ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন,তার ফলে তারা আত্মপরিচয়হীনতা, তুচছ-তাচিছল্য ও দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি পেল৷ সমাজ থেকে অন্যায় রীতিনীতিগুলো দূর করার জন্যে নবীজী তাঁর ছোট্ট মেয়ে ফাতেমা ( সা ) কে হাঁটুর ওপরে বসাতেন,তাকে আদর করে চুমু খেতেন,স্নেহ করতেন,এমনকি তার সম্মানে তিনি উঠে দাঁড়াতেন৷

এভাবেই নবীজীর নীতি আদর্শে নারীদের উচচাসন ও ভূমিকা সুরক্ষিত হলো৷ রাসূলে খোদার সাথীদের একটি দল ছিল পুরুষ৷ আবার নারীদের একটি অংশও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ নবীজী এই নিশ্চয়তা বিধান করেছিলেন যে, নারীরা নবীজীর যথাযথ আনুগত্য করার পরও তাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি দিয়ে নিজেদের সম্মান মর্যাদা তথা আত্মোন্নয়ন ঘটাতে পারে৷ কোরআনে কারীমের সূরা তাহরীমে এ সম্পর্কে ফেরাউনের স্ত্রীর উদাহরণ দেওয়া হয়েছে৷ কুফুরি ও গোমরাহীতে নিমজ্জিত হবার সমূহ পথ খোলা থাকার পরও তিনি সত্য ও হেদায়েতের পথই বেছে নিয়েছিলেন৷ এটা সম্ভব হয়েছিল এজন্যে যে তিনি তাঁর সকল ক্ষমতা এ পথেই ব্যয় করেছিলেন৷ইসলামের মহান শিক্ষাগুলোকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাসূলে খোদা ( সা ) বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সমাজে নারীদের উপযোগী কাজে তাদের নিজেদের উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে৷ বর্তমানে আমরা সামাজিক,রাজনৈতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের যে অংশগ্রহণ ও তৎপরতা লক্ষ্য করি, তা নবীজীর ঐ শিক্ষারই ফলাফল৷ ইসলামের আবির্ভাব ও তার বিস্তারের শুরু থেকেই রাসূলের বাইয়াত,হিজরাত এবং জেহাদে নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়৷ ইসলামের ইতিহাসে তাই লক্ষ্য করা যায় যে, নারী এবং পুরুষ যে যার উপযুক্ত ক্ষেত্রে যথার্থ সৃজনশীল ভূমিকা রেখেছে৷হযরত খাদিজা ( সা ) সর্বপ্রথম নারী যিনি তাঁর ধন-সম্পদ দ্বীনের খেদমতে সঁপে দিয়েছেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাসূলে খোদার খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন,তাঁর সবচে উত্তম বন্ধু ও সহযোগী ছিলেন৷ পরবর্তী পর্যায়ে হযরত ফাতেমা ( সা ) সবসময় নবীজীর খেদমতে উপস্থিত ছিলেন৷

যুদ্ধ-সংগ্রামেও নবীজী এবং অন্যান্য সংগ্রামীদের সাথে উপস্থিত ছিলেন৷ হযরত ফাতেমা ( সা ) এর মর্যাদা এবং তাঁর আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতা এমন এক উচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল যে , বিভিন্ন রেওয়ায়েতে এসেছে ক্বেয়ামতে বেহেশ্‌তবাসীদেরকে খবর দেওয়া হবে যে-‘একজন মহিয়সী রমনী পুলসিরাত পার হবেন৷ তোমরা তখন তোমাদের চোখ ঢেকে রেখো,কেননা;পুলসিরাত পার হবার সময় তাঁর নূরের ঔজ্জ্বল্য এতো বেশি হবে যে হাশরবাসীরা তাঁকে দেখার শক্তি রাখবে না৷' সেই মহিয়সী রমনী হলেন নবীকন্যা হযরত ফাতেমা ( সা ) ৷নবীজীর রেসালাতকালে আকাবায় সর্বপ্রথম বাইয়াত গ্রহণের যে ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে মদীনার পুরুষদের সাথে কয়েকজন রমনীও ছিলেন৷ রমনীদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ‘হাফরা'৷ ইতিহাসবিদদের মতে যে সময় নারীরা তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার থেকে পরিপূর্ণভাবে বঞ্চিত ছিল,সে সময় রাসূলের বাইয়াতে এই নারীদের উপস্থিতি ছিল সমকালীন জাহেলী রীতিনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং বিস্ময়কর৷ এ কারণেই বাইয়াতের এই ঘটনাকে ‘বাইয়াতুন্নেসা' বা নারীদের আনুগত্য নামেও অভিহিত করা হয়েছে৷ এক বছর পর একদল মুসলমানের সাথে ক'জন নারী গোপনে নবীজীর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন মীনায়৷ তারা নবীজীর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন৷

বললেন,নিজেদের পরিবার-পরিজন,সন্তান-সন্ততিদের যেভাবে তারা সুরক্ষা করেন,সেভাবেই তারা তাঁকেও হেফাজত করবেন৷ কা'বের মেয়ে নাসীবাহও ছিলেন নারীদের এই দলে৷ ইসলামী হুকুমাতের জন্যে নবীজীর সামনে যখন বিচিত্র সমস্যা এসেছিল , তখন নবীজীর প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে নাসিবা তার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন৷ অহুদের যুদ্ধে নাসীবা মুজাহিদদের পানি পরিবেশন করার গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন৷ অহুদের যুদ্ধে শত্রুরা যখন যুদ্ধ শেষে চোরাপথে অতর্কিত আক্রমণ করে বসলো ,তখন মাত্র দশজন ছাড়া বাকি সবাই পালিয়ে গেলো৷

এই দশজনের মধ্যে নাসিবাহ ছিলেন৷ তিনি নবীজীর প্রাণ রক্ষার্থে অস্ত্রহাতে শত্রুদের মোকাবেলা করতে বীরাঙ্গনার মতো এগিয়ে গিয়েছিলেন৷ নারী এবং পুরুষ আল্লাহর দুই সৃষ্টি৷ মানুষ হিসেবে উভয়ই সমান৷ তবে তাদের নিজ নিজ কর্মের ওপর নিজ নিজ সম্মান ও মর্যাদা এমনকি পুরস্কারের বিষয়টি নির্ভর করে৷ ইসলামের নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে নারীদের জন্যে সুসংবাদ দিয়ে বলেন,‘তোমাদের মধ্যে কোনো আমলকারীর আমলই আমি ধবংস বা বিফল করবো না,চাই সে নারীই হোক কিংবা পুরুষ৷' রাসূলে খোদার দৃষ্টিতে নারীপুরুষকে আল্লাহ রাববুল আলামীন এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা তাদের পারস্পরিক প্রয়োজনীয়তাগুলো মেটাতে সক্ষম হয়৷ অর্থাৎ তারা পরস্পরের পরিপূরক৷ এদিক থেকে একজন নারী পুরুষের মতোই সমান মানুষ৷ তবে তাদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য এবং দক্ষতা আলাদা এবং স্বতন্ত্র৷ সেজন্যে তাদের কাজগুলোও তাদের বৈশিষ্ট্য এবং মানসিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী বিন্যস্ত৷ মনস্তত্ত্বও প্রমাণ করেছে যে, নারীকে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং যথার্থ যত্নের সাথে৷ তাই যেখানেই নারী তার এই সূক্ষ্মতা এবং স্পর্শকাতরতার সীমা লঙঘন করবে,সেখানেই তার ব্যক্তিত্ব ও সম্মান-মর্যাদা হ্রাস পাবে৷

নারী-পুরুষের মনস্তত্ত্বের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিয়েই নবীজী তাদের জ্ঞানগত উন্নতির চেষ্টা চালিয়েছেন৷ তিনি তাঁর স্ত্রী হাফসাকে বলেছেন লেখাপড়া শিখতে৷ অপরদিকে তিনি নারীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন যে, তারা যেন একজন দায়িত্বশীল হিসেবে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে পরিবারের সদস্যদের সম্মান ও যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে শেখে এবং যার যার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি নজর রেখে উপযোগী কাজ ভাগ করে দেয়৷ তবে সন্তানদের প্রতিপালন ও তাদের যথার্থ প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টিকে যেন অগ্রাধিকার দেয়৷ রাসূলে খোদার দৃষ্টিতে ঘরকন্নার কাজ এতোটাই পূণ্যের কাজ যে,তাকে আল্লাহর পথে জিহাদ করার সমতূল্য বলে মূল্যায়ন করা হয়েছে ৷ রাসূলে খোদার সময়কালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের সাহসী ও দক্ষতাপূর্ণ উপস্থিতি ইসলামের সমৃদ্ধ ইতিহাসে বৃহৎ একটি অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটিয়েছে৷ আজো ইসলামের সেই সুমহান শিক্ষাগুলো বিশ্বের নারীদেরকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে যাচেছ ৷#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/১৭

ট্যাগ