আগস্ট ০১, ২০২৩ ১৫:১৩ Asia/Dhaka
  • হরিয়ানায় সহিংসতায় ইমামসহ নিহত ৫, কারফিউ জারি, সতর্কতা রাজস্থানেও

ভারতে বিজেপিশাসিত হরিয়ানার নূহতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্রজ মণ্ডল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জেরে একটি মসজিদের ইমামসহ ৫ জন নিহত হয়েছে।

হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল বলেছেন, ‘নূহের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। রাজ্যে শান্তি বজায় রাখার জন্য আমি সকলের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। দোষীরা রেহাই পাবে না। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’  

প্রশাসনের পক্ষ থেকে নূহ শহরে দু’দিনের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গোটা এলাকায় আধাসামরিক বাহিনীর ২০টি কোম্পানি মোতায়েন করা হয়েছে। অন্যদিকে, নূহ সংলগ্ন রাজস্থানের ভরতপুরেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এখানে ৪টি এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে। জানা গেছে, নূহ (মেওয়াত)-এর পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে গুরুগ্রামেও। যার ফলে এই দুটি জেলা ছাড়াও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রেওয়াড়ি, পালওয়াল, ফরিদাবাদসহ ৫ জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নূহ, ফরিদাবাদ এবং পালওয়ালে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ রয়েছে। 

গতকাল (সোমবার) নূহতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্রজ মণ্ডল শোভাযাত্রায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময়ে উভয়পক্ষের মধ্যে পাথর নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ হয়। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত গুরগাঁওয়ের হোম গার্ড নীরজ এবং গুরসেবক সহ ৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মী ও অন্যরা। দুর্বৃত্তরা তিন কিলোমিটারের মধ্যে রাস্তায় সমস্ত যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়। পোড়ানো হয় ‘ডায়াল ১১২’ গাড়ি। লুটপাটের পর কয়েকটি দোকানে আগুন দেওয়া হয়। একটি মোটর বাইকের শোরুম থেকে কমপক্ষে ২০০টি বাইক লুট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ। ভাঙচুর হয় শোরুমে। মারধর করা হয় কর্মীদের।  

আজ (মঙ্গলবার) সকালে সাংবাদিকরা গোলযোগপূর্ণ এলাকা পরিদর্শনকালে দেখতে পান, বর্তমানে সোহনার সড়কে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। রাস্তার দু’পাশে থাকা  যত ঠেলা গাড়ি ছিল এবং মুসলমানদের যেসব দোকান ছিল তা পোড়া অবস্থায় দেখা গেছে। আরবান গ্রোসার নামে একটি দোকান পুড়ে গেছে এবং তা থেকে এখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে। সড়কের দু’পাশে পোড়া যানবাহন ও দোকানপাট দেখা গেছে। আজ সকাল পর্যন্ত কিছু দোকান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল।

আজ সোহনার বাসিন্দা জামশেদ বলেন, ‘সোমবার বিকেলের পর থেকে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের লোকজন দোকানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। আমার চাচার মাথায় ১৫টির বেশি সেলাই পড়েছে। ঘটনার পর তিনি সোহনা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন।’জামশেদ বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় সোহনায় গুলিবর্ষণ হয় যাতে তার পরিচয়ের অনেক লোক আহত হয়েছে।

সোহনা থেকে নূহের দিকে এগোতেই রাস্তাগুলো একেবারে ফাঁকা অবস্থায় রয়েছে।  সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রত্যেক দুই কিলোমিটার পর পর রয়েছে পুলিশের ব্যারিকেড। সড়কে নিরাপত্তা বাহিনীর মালামাল বহনকারী ট্রাক দেখা যায়। নূহ এলাকায় আধাসামরিক বাহিনী সিআরপিএফ জওয়ান মোতায়েন রয়েছে।

নূহের কংগ্রেস বিধায়ক আফতাব আলম একটি বেসরকারি চ্যানেলকে বলেন- ‘মানুষ এখানে বহু বছর ধরে একসাথে বাস করছে। ষড়যন্ত্রে উসকানি দিয়ে এসব করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানি দেওয়া হয়েছে। মনু মানেসারসহ অনেকেই ছিল যারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। প্রশাসন সব জানত। গোটা সমাজকে টার্গেট করা হয়েছে।’

জানা গেছে, গতকাল (সোমবার) দুপুর দুটোর দিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নূহে  ধর্মীয় শোভাযাত্রার আয়োজন করে। সমাবেশের আগে, উগ্রহিন্দুত্ববাদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলের সাথে যুক্ত কিছু ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক কথা বলে ভিডিও শেয়ার করেছিল বলে অভিযোগ। ওই ধর্মীয় শোভাযাত্রায় নাসির ও জুনায়েদ হত্যার প্রধান আসামি মনু মানেসারের শামিল হওয়ার খবর ছিল। এতে নূহের মানুষজন ক্ষুব্ধ হন। অভিযুক্ত মনু মানেসার অবশ্য সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন- বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অনুরোধের পরে আমি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করিনি।

প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারিতে, হরিয়ানার ভিওয়ানিতে একটি পোড়া বোলেরো গাড়ি পাওয়া যায়। তাতে জুনায়েদ এবং নাসির নামে দুই যুবককে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। সেই ঘটনার তদন্তে তদন্তে উগ্রহিন্দুত্ববাদী গোরক্ষক মনু মানেসারের নাম শিরোনামে ছিল। এরপর থেকে প্রশাসনিক নথিতে মনু মানেসার পলাতক রয়েছে।

জানা গেছে, উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ওই মিছিল শুরুর কিছুক্ষণ পরই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। নিয়ন্ত্রণহীন জনতা জনগণের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একটি বেসরকারি চ্যানেলের সঙ্গে আলাপকালে নূহের সাইবার থানার এক পুলিশকর্মী জানান, উত্তেজিত জনতা থানায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে।

এদিকে, নূহের সহিংসতার আগুন গুরুগ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সেক্টর ৫১-এর  মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান ‘বিবিসি’কে বলেছেন- মসজিদে জনতা আগুন দিয়েছে এবং হামলায় ইমাম নিহত হয়েছেন।

গুরুগ্রাম এবং ফরিদাবাদে প্রশাসন স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে। নূহ, গুরুগ্রামসহ অনেক জায়গায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ‘বিবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে হরিয়ানা আঞ্জুমান ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ  আসলাম খান বলেন, ‘মেওয়াতে সহিংসতার পর সোমবার সন্ধ্যায় পুলিশের একটি টিম আমাদের কাছে পৌঁছায় এবং নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়।’

আসলাম খান বলেন, ‘স্থানীয় থানা থেকে পুলিশের একটি দল আমাদের কাছে এসে বলেছিল যে মসজিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুলিশ করবে। আমাদের বলা হয়েছিল, পুলিশের টিম মসজিদেই উপস্থিত থাকবে। আমরা যখন মসজিদের ইমাম এবং এখানে থাকা আরও দুই কর্মীর কথা বলি, তখন পুলিশ বলেছিল উদ্বিগ্ন  হওয়ার কিছু নেই।’

আসলাম খান বলেন, ‘আমরা মাগরিবের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরেছিলাম। পুলিশও উপস্থিত ছিল। এরপর রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে আচমকা  মসজিদে হামলা চালানো হয়। প্রথমে মসজিদের ক্যামেরা ভাঙা হয় এবং তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।’তিনি বলেন, ‘মূলত বিহারের বাসিন্দা এবং মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ সাদকে (২২) হামলাকারীরা হত্যা করেছে। খুরশিদ নামে একজন আহত হয়েছেন যিনি ‘আইসিইউ’তে ভর্তি আছেন। আরও একজন আহত আছেন, যার সামান্য আঘাত রয়েছে।’

গুরুগ্রাম পুলিশের ডিসিপি ইস্ট নীতীশ আগরওয়ালের মতে, ‘যখন মসজিদে হামলা হয়, তখন নিরাপত্তার জন্য সেখানে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন ছিল কিন্তু হামলাকারীরা সংখ্যায় বেশি ছিল এবং তারা আচমকা গুলি চালায়। পুলিশ ঘটনার ভিডিও সংগ্রহ করে হামলাকারীদের শনাক্ত করছে। সন্দেহভাজন হামলাকারীদের কয়েকজনকে হেফাজতেও নেওয়া হয়েছে।’

হরিয়ানার নূহতে সহিংসতার পর হরিয়ানা সরকারকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ‘মিম’ প্রধান ব্যারিস্টার আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এমপি। তিনি বলেন, একজন অপরাধী (মনু মানেসার) ভিডিও প্রকাশ করে মানুষকে সহিংসতায় উসকানি দিয়েছেন।   

ওয়াইসি বলেন, তিনি (মনু মানেসার) অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু হরিয়ানা বা রাজস্থান পুলিশ তাকে ধরছে না। এই সহিংসতায় একটি মসজিদও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে একজন ইমাম ও দুই হোমগার্ড সদস্য নিহত হন।এর পরেও, হরিয়ানা সরকার শিথিল কারণ রাজ্যে নির্বাচন রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ওয়াইসি। #

 

পার্সটুডে/এমএএইচ/এমবিএ/১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ