অক্টোবর ২৭, ২০১৯ ১৮:৪৪ Asia/Dhaka
  • ডক্টর মাসুদ সোলাইমানি
    ডক্টর মাসুদ সোলাইমানি

আমেরিকা সম্প্রতি ইরানের বেশ কিছু বিজ্ঞানী ও গবেষককে গ্রেফতার করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথাকথিত মানবাধিকার বিষয়ক একাধিক প্রতিবেদনে কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ইরানসহ আরো বেশ কিছু দেশের বিচারবিভাগের পক্ষ থেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বা রায়ের সমালোচনা করেছে।

এমনকি জাতিসংঘে নিজের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা এ বিষয়ে বেশ কিছু প্রস্তাবও পাশ করিয়ে নিয়েছে যা কিনা  রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আমেরিকা অন্য দেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বললেও খোদ আমেরিকাতেই বহু নিরপরাধ মানুষ মিথ্যা ও সাজানো মামলায় জেলখানায় জীবন যাপন করছে। বিচারবিভাগের কর্মকাণ্ডের প্রতি রয়েছে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে এ সংক্রান্ত বহু খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে। আমেরিকার মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, সেদেশের সরকার ইরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.মাসুদ সোলাইমানিকে কোনো কারণ ছাড়ই আটক করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমেরিকার এ পদক্ষেপের কারণ কি?

গত বছর ২৫ অক্টোবর ইরানের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের খ্যাতনামা অধ্যাপক, গবেষক ও রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মাসুদ সোলাইমানিকে শিকাগো বিমানবন্দর থেকে মার্কিন ফেডারেল পুলিশ এফবিআই গ্রেফতার করে। অথচ তার বৈধ কাগজপত্র ও ভিসা ছিল। আদালতের নির্দেশ না থাকলেও এবং কোনো অভিযোগ ছাড়াই মার্কিন ফেডারেল পুলিশ ইরানের এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষককে আটলান্টা শহরে আটকে রেখেছে যেখানে ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও বন্দী রয়েছে।

ইরানের কর্মকর্তারা এবং ডক্টর মাসুদ সোলাইমানির আইনজীবী ও তার পরিবারবর্গ আটকের কারণ এবং কতদিন তাকে এভাবে আটকে রাখা হবে কিংবা তাকে আদালতে উত্থাপন করা হবে কিনা জানতে চাইলেও মার্কিন কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত এর কোনো সুস্পষ্ট জবাব দেয়নি। তারা দাবি করেছেন, আমেরিকার হাতে আটক এ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেছেন। বার্তাসংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস এক প্রতিবেদনে ইরানের এ গবেষকের আটকের ব্যাপারে লিখেছে, " আমেরিকার মিনোসোটা অঙ্গরাজ্যের মাইয়ো ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ব্রেইন স্টোকের চিকিৎসার ওপর পড়াশোনার শেষ ধাপ সমাপ্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমেরিকায় পা রাখার সাথে সাথে দেশটির পুলিশ ইরানবিরোধী মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের দায়ে তাকে গ্রেফতার করে। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু উপাদান ও তথ্য ইরানে সরবরাহ করার অভিযোগ তুলেছে পুলিশ।"

ডক্টর মাসুদ সোলাইমানি ইরানের তারবিয়াত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং তিনি স্টেমসেল বা মৌলিক কোষ গবেষক। এমনকি তিনি ইউরোপের মৌলিক কোষ বিষয়ক সংস্থার সদস্য এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একজন গবেষক হিসেবে পরিচিত। তার গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে তারবিয়াত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক ইয়াকুব ফতেহ এলাহি বলেছেন, " ডক্টর মাসুদ সোলাইমানি ইরানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন নামকরা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ এবং তিনি দীর্ঘদিন ধরে মৌলিক কোষের ওপর গবেষণা করছেন। এ বিষয়ের ওপর গবেষণা কাজ অব্যাহত রাখা ও আরো উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য আমেরিকার মিনোসোটা অঙ্গরাজ্যের মাইয়ো ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিমানবন্দর থেকেই তাকে আটক করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংক্রান্ত সমস্ত রীতিনীতি লঙ্ঘন করে ডক্টর মাসুদ সোলাইমানিকে আটক করার পর এক বছর ধরে তিনি কারাগারে অবস্থান করছেন। ইরানের এ বিজ্ঞানীকে কেন এতদিন ধরে আটকে রাখা হয়েছে তা নিয়ে মার্কিন সরকার কিছুই বলছে না। মার্কিন সরকার কেবল তার বিরুদ্ধে ইরানবিরোধী নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলছে।"

যুক্তরাষ্ট্রের 'স্কোপাস'-এর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ইরানের এ বিজ্ঞানী ডক্টর মাসুদ সোলাইমানি তার গবেষণা কর্মের ওপর এ পর্যন্ত ১২টি গ্রন্থ লিখেছেন এবং তার ৫৮০টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে যা কিনা মৌলিক কোষ ও রক্ত সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার। তিনি ২০১৫ সালে স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে শীর্ষ বিজ্ঞানীদের তালিকায় স্থান পেয়েছে। স্টেমসেল বা মৌলিক কোষ, মগজ ও অস্থিমজ্জার ওপর প্রচুর গবেষণা করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে সাহায্যের জন্য তিনি আমেরিকাসহ আরো অনেক দেশ সফর করেছেন।

ইরানের তারবিয়াতে মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মোহাম্মদ তাকি আহমাদি বলেছেন, "আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কেবলমাত্র ওষুধ কেনার কারণে আমেরিকা ইরানের এ বিজ্ঞানীকে আটকে রাখতে পারে না।" তিনি বলেন, "ওই বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং সন্দেহজনক। মার্কিনীরা ইচ্ছা করেই এ বিষয়টিকে আদালতে তুলছে না।"

আমেরিকায় আটক ইরানি বিজ্ঞানী ড.সোলাইমানির আইনজীবী লিওনার্দ ফ্রাঙ্কু বলেছেন, "দৈহিক বিকাশের কাজে ব্যবহারযোগ্য হরমোনআমেরিকা কিংবা ইরান কোথাও নিষিদ্ধ নয়। এই হরমোন শুধুমাত্র চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা কাজের জন্যই ব্যবহৃত হয় এবং এটি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় নেই।"  তিনি আরো বলেছেন, ইরানের এ বিজ্ঞানীকে আটকের পেছনে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য রয়েছে।"

যাইহোক ভিত্তিহীন ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের মিথ্যা অভিযোগে শুধু যে ইরানি বিজ্ঞানী মাসুদ সোলাইমানিকে আটক করা হয়েছে তাই নয় বরং গত কয়েক বছরে  মার্কিন সরকার আরো অনেককে জেলখানায় আটকে রেখেছে। এ প্রসঙ্গে আরেক ইরানি নাগরিক নেগার কুদসি কানির কথা উল্লেখ করা যায়। মার্কিন আদালত ২০১৭ সালের জুনে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার দায়ে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। কিন্তু দুই বছর পর প্রমাণিত হয় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বেআইনি। এরপর আটকাবস্থায় বিচার চলার কারণে আদালত তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়ার কথা ঘোষণা করে ও মুক্তি দেয়।

ইরানের বিজ্ঞানী ও গবেষক মাসুদ সোলাইমানিকে আটক করার পর বাইরে কারো সঙ্গে তার যোগাযোগ করার সুযোগ দেয়া হয়নি এবং কেবলমাত্র নিজ খরচে ইরানে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সোলাইমানিকে আটকের প্রতিবাদ জানিয়ে ইরান সরকার জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি ও ইউরোপের রক্তরোগ গবেষণা সংস্থার কাছে চিঠি দিয়েছে। মাসুদ সোলাইমানির ছাত্ররাও দুই হাজার ৬০০ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি জাতিসংঘে পাঠিয়ে তার মুক্তির আবেদন জানিয়েছে। আটক সোলাইমানির ভাই রাসুল সোলাইমানি বলেছেন, তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভাল নেই। এমনকি মার্কিন সরকার তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহে বাধা দিচ্ছে। ফলে দিন দিন তার শারীরিক অবস্থান অবনতি ঘটছে।

প্রকৃতপক্ষে, আমেরিকা জ্ঞানবিজ্ঞানে ইরানের উন্নতিতে হতাশ হয়ে পড়েছে। এর আগেও তারা বহু বিজ্ঞানী ও গবেষকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আবার অনেককে হত্যা করেছে। যা কিনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।

মার্কিন সরকার সবসময়ই মানবাধিকার রক্ষার দাবি করে থাকে এবং এ অজুহাতে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু তাদের আচরণে প্রমাণিত হয়েছে মানবাধিকার বিষয়টিকে কেবল রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। মার্কিন সরকার কথায় কথায় অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলে অথচ খোদ আমেরিকাতেই অহরহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৭

ট্যাগ