নভেম্বর ০৫, ২০২৩ ১৬:০০ Asia/Dhaka
  • ইসলামের দৃষ্টিতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

যেকোনো আগ্রাসন, জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মানুষের ন্যায্য অধিকার। কিন্তু আগ্রাসী ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে পাশ্চাত্যের মিডিয়াগুলো অবৈধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। অনেকেরই প্রশ্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি?

গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের উপর দখলদার ইসরাইলের নির্বিচার বোমাবর্ষণ, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের  বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও ঘৃণা এখন তুঙ্গে। প্রশ্ন উঠেছে, ফিলিস্তিনিরা আর কতদিন ইসরাইলের দখলে থাকবে এবং এর জনগণ হতাহত হবে এবং অবরুদ্ধ ও বন্দী অবস্থায় দিনাতিপাত করবে? কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি অত্যাচার নির্যাতনের বিষয়টি উপেক্ষা করে চলেছে? আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, কোনো দেশ দখল নিন্দনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য এবং সেই দেশের জনগণের অধিকার আছে দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার যতক্ষণ না তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। তাই ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাস যোদ্ধাদের পরিচালিত 'আল-আকসা তুফান' সামরিক অভিযান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ বৈধ। এবারে আমরা জুলুম, আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের মোকাবিলায় আত্মরক্ষার ব্যাপারে ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা  করবো।

ইসলাম আমাদেরকে শান্তি, বন্ধুত্ব ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা দেয়। কিন্তু সবসময়ই এমন কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সরকার রয়েছে যারা অন্যের জীবন, সম্পত্তি ও জমি দখলের পথ অবলম্বন করেছে এবং শান্তি ধ্বংস করেছে। এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে ইসলাম আগ্রাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে  দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয় যাতে মানুষ আবার শান্তিতে বসবাস করতে পারে। ইসলাম শুধু যে নিপীড়ন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলে তাই নয় আগ্রাসীদের কাছে আত্মসমর্পণেরও নিন্দা করে। সূরা আল-বাকারার ২৭৯ নম্বর আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেছেন যে, 'তোমরা জুলুম করো না, অত্যাচার করো না।' তাই ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম ও প্রতিরোধ আল্লাহর নির্দেশের যথাযথ বাস্তবায়ন। সূরা হজ্জের ৩৯ ও ৪০ নম্বর আয়াতে এই বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, 'যারা অন্যায়ভাবে আক্রান্ত ও নিহত হয়েছে তাদের আত্মরক্ষা ও জিহাদের লড়াইয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং অবশ্যই আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন।' কোরআনে নিপীড়িতদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে যারা তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে, যার সাথে ফিলিস্তিনি জনগণের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খুবই মিল রয়েছে।

অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের সর্বোত্তম উদাহরণ ছিল উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার অত্যাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আল্লাহর রসূলের প্রিয় নাতি হুসাইন বিন আলী (আ.)-এর সংগ্রাম।  ইমাম হোসেন (আ.) ইয়াজিদকে খেলাফত ও মুসলমানদের উপর শাসন কর্তৃত্বের যোগ্য মনে করতেন না, আর এ কারণে তিনি ইয়াজিদের কাছে আনুগত্যের শপথ করেননি। অবশেষে তিনি এবং তার সঙ্গীরা ইসলামের অধিকার ও আদর্শ রক্ষায় প্রাণপণে লড়াই করে শহীদ হন। ইমাম হোসাইন (আ.) বলেছিলেন, অপমানের কাছে আত্মসমর্পণ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব এবং আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা। হয় শহীদ হতে হবে অথবা ইয়াযিদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এভাবেই তিনি দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে বিশ্বের মুক্তিকামী ও স্বাধীনতাকামীদের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছেন। হামাস এবং অন্যান্য ইসলামী প্রতিরোধ সংগঠন এখন ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে  লড়াই করছে তা ইমাম হোসানের ওই নীতিরই অনুসরণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা ইসরাইলের নির্মমতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল পশ্চিমা সরকার বিশেষ করে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সহায়তায় ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিন দখল করে রেখেছে এবং এমন কোনো অপরাধযজ্ঞ নেই যা তারা করেনি।  ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষায় ছিল তারা আন্তর্জাতিক সমাজ ও আরবদের সমর্থন পাবে। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো যে কেউ এগিয়ে আসবে না তখন ফিলিস্তিনের একদল মোমিন মুসলমান কেবলমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং জনগণের সমর্থন নিয়ে সামরিক শক্তি সঞ্চয় করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেঁছে নেয়। কারণ সূরা 'সাফ'-এর চার নম্বর আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহ মুসলমানদেরকে শত্রুদের বিরুদ্ধে যথাসম্ভব প্রস্তুত ও সজ্জিত থাকতে বলেছেন। ইমাম আলী (আ.)ও এই বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন, "জেনে রাখো, দুর্বল ও অক্ষম মানুষ কখনোই জুলুম ও নিপীড়নকে দূর করতে পারবে না, যদিনা তারা কোনো চেষ্টা চালায়।" তাই ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা বিশেষ করে হামাস ইসরাইলের মাধ্যমে অবরুদ্ধ থাকার পরও সামরিক সক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং সম্প্রতি ইসরাইলি আগ্রাসনের নজিরবিহীন জবাব দিয়েছে।

আগ্রাসীকে প্রতিহত করা এবং সমাজে স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহর পথে জিহাদের গুরুত্বের বিষয়ে কুরআন ও হাদিসে বহু নির্দেশনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আস-সাফের চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: 'বস্তুত আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে এভাবে সারিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে, যেন তারা শিশাঢালা প্রাচীর।' ইমাম সাদিক (আ.) জিহাদ সম্পর্কে বলেছেন, 'শত্রুর বিরুদ্ধে যেকোনো যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকুন এবং আল্লাহর পথে লড়াই করুন যাতে পরবর্তীতে আপনার সন্তানরা আপনাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।'

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ফিলিস্তিন সম্পর্কে বলেছেন, 'ফিলিস্তিন সমস্যার একমাত্র সমাধান হল অব্যাহত প্রতিরোধ ও সংগ্রাম।'

প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানে ফিলিস্তিনি মুজাহিদরা সেই ভূখণ্ড উদ্ধারের জন্য লড়াই করছে যা তাদের পূর্বপুরুষদের ছিল এবং ইসরাইল দখল করে রেখেছে। তাই এ ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করার অধিকার ফিলিস্তিনিদের রয়েছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সূরা নিসার ৭৫ নম্বর আয়াত অনুযায়ী অন্যান্য মুসলমানদেরও দায়িত্ব রয়েছে ইসরাইলের আগ্রাসন থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় এগিয়ে আসা। এই আয়াতে, আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, 'কেন তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর না এবং (অত্যাচারীদের দ্বারা) দুর্বল হয়ে পড়া সেইসব নারী-পুরুষ ও শিশুদের জন্য?'

এ কারণে লেবানন, ইরাক, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিতভাবে গাজায় তাদের ভাইদের সাহায্য করছে। আর ইরান ওই দেশগুলোর প্রতিরোধ শক্তিগুলোকে সহযোগিতা করছে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (রহ.) ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের টিউমার হিসাবে উল্লেখ করে বলেছেন, 'আমরা নিপীড়িতদের পক্ষে। যে যেখানেই নির্যাতিত হোক না কেন, আমরা তাকে সমর্থন করি এবং ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত। ইসরাইল তাদের উপর অত্যাচার করেছে, তাই আমরা তাদের সমর্থন করি।'#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ