একা মানবতাই যথেষ্ট
(last modified Tue, 30 Apr 2024 06:25:17 GMT )
এপ্রিল ৩০, ২০২৪ ১২:২৫ Asia/Dhaka
  • ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীরা নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করছেন
    ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীরা নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করছেন

একজন বিশ্লেষকের মতে, পশ্চিমা নীতি গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতাকে নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করেছে এবং এই ধারা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে শুধু রঙ্গিন ত্বকের মানুষরাই জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তা নয়, একইসঙ্গে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং এমনকি অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের সন্তানরাও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকশ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তারের পর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিক্ষোভের ঢেউ ব্যাপক মাত্রায় প্রসারিত হয়েছে এবং তা এখন অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।

১২ দিন আগে (১৭ এপ্রিল) নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা দাবি করছে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন অবশ্যই গাজা যুদ্ধে জড়িত ইসরাইলি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে; একই ধরনের দাবি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভকারীরা করছে। অন্যদিকে, মার্কিন সরকার এসব প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দমনে সামরিক পন্থা নিয়েছে।

অভিবাসী নন এমন স্থানীয় মার্কিন নাগরিকদের (নন-ইমিগ্র্যান্ট) ব্যাপক উপস্থিতি 

ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ ওয়ার্ল্ড স্টাডিজের অধ্যাপক ফোয়াদ ইজাদির মতে এ জাতীয় প্রতিবাদে অংশ নেয়ার জন্য মুসলমান বা বামপন্থী হওয়ার দরকার হয় না ইসরাইলের পৈশাচিক ও বর্বর হামলার চিত্রগুলো দেখার পর মানবিক অনুভূতিই প্রতিবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। 

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এইসব চিত্রকে বিকৃত করার চেষ্টা করলেও এসব কাজের প্রকৃতি বদলে যায় না। 

কথিত উদার গণতন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্য চ্যালেঞ্জ

ইরানের পায়াম-ই নূর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফ্যাকাল্টি সদস্য সাইদ আবদোল মালেকি মনে করেন গাজায় যে গণহত্যা চলছে তার কোনো যৌক্তিকতা কি দেখাতে পারবে কথিত উদার গণতন্ত্র? বিশ্ব জনমত ও মার্কিন শিক্ষিত শ্রেণীকে শান্ত করার মত কোনো যুক্তি কি দেখাতে পারবে গাজায় গণহত্যামূলক যুদ্ধের পক্ষগুলো?  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালিয়েছিল পরমাণু বোমা থাকার অজুহাত দেখিয়ে। কিন্তু তা ছিল পুরোপুরি মিথ্যাচার। গাজায় এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে ইসরাইল যাদের বেশিরভাগই শিশু ও নারী! 

মালেকি মনে করেন, মার্কিন ছাত্র ও অধ্যাপকরা জেগে উঠেছেন কারণ তারা মনে করেন যে এই ব্যবস্থা তাদের পরিচয়, গর্ব ও মানবতার চেতনা লুণ্ঠন করেছে এবং তারা কার্যত একটি সামরিকবাদী ও দখলদার শাসনের শিকার যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা এই যুদ্ধযন্ত্রের চাকার একটি চলক হিসাবে কাজ করছে, এবং ছাত্রদের দায়িত্ব এই চাকায় তেল দেওয়া।

পশ্চিমা নীতি গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতাকে নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করেছে এবং এই ধারা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে শুধু রঙ্গিন ত্বকের মানুষরাই জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তা নয়, একইসঙ্গে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং এমনকি অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের সন্তানরাও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।

এটা দূরের কথা নয় যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যুত্থান একটি ব্যাপক সামাজিক অভ্যুত্থানে পরিণত হবে, কারণ ইহুদিবাদী শাসনের জন্য মার্কিন সরকারের সর্বাত্মক প্রতিরক্ষা ও সমর্থন এবং এই শাসকগোষ্ঠীর হাতে সংঘটিত শিশু-হত্যা ও গণহত্যার প্রতি সমর্থন- এসবই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুঁজিগুলোর জন্য কোনো মর্যাদা অবশিষ্ট রাখেনি। আমেরিকার রাজধানীগুলির জন্য, অর্থাৎ, আমেরিকান মূল্যবোধগুলো মর্যাদা ধুলায় মিশে গেছে। 

পরিচিতি দ্বন্দ্বের গুরুতর ভূমিকা

আমেরিকান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হাদি খসরোশাহিন মনে করেন ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তাঁর সর্বশেষ বই "আইডেন্টিটি"-এর আলোকে প্রায় চূড়ান্ত মিমাংসিত সত্য হিসেবে এটা উল্লেখ করা যায় যে আমেরিকা পরিচিতির দ্বন্দ্বের যুগে প্রবেশ করেছে, বিশেষ করে  ২০১৬ সনের নভেম্বরের পরে। আর এই দ্বন্দ্বের উত্থান ও প্রকাশের একাধিক কারণ রয়েছে। আর এসবের মধ্যে  সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হল পাশ্চাত্যের কথিত উদার গণতন্ত্রের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি।  

অন্যদিকে, মূলধারার আমেরিকার মৌলিকভাবে বিভিন্ন কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা, সম্ভাবনা বা ইচ্ছারও অভাব রয়েছে যাকে পরিচতি বিষয়ক দ্বন্দ্বের কাঠামোর মধ্যে সংজ্ঞায়িত করা যায়। আমেরিকায় সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলি যে তীব্র হয়েছে, অব্যাহত রয়েছে এবং যা একই সাথে দেশীয় রাজনীতিকেও চ্যালেঞ্জ করেছে তার প্রক্রিয়াকে এই কাঠামোর মধ্যেই বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। 

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অন্যান্য ইস্যুর বিপরীতে এইসব বিষয় খুব কমই ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু গাজায় গণহত্যার ইস্যুটি শেষ পর্যন্ত মার্কিন ঘরোয়া রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করতে পেরেছে। এটা আত্মপরিচিতির দ্বন্দ্বের যুগে প্রবেশের অন্যতম প্রকাশ।  এই দ্বন্দ্বের একদিকে রয়েছে শ্বেতাঙ্গদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার দাবি যেখানে থাকবে না জাতিগত বৈচিত্র ও বহু সংস্কৃতির সহাবস্থান ও অন্য দিকে রয়েছে ঘরোয়া ও বৈদেশিক নীতিতে নিজস্ব প্রত্যাশাগুলো পূরণ না হওয়ার ক্ষোভ।

যেহেতু এই দ্বন্দ্ব মৌলিক নীতিমালা ও মূল্যবোধ সংক্রান্ত। তাই এটি স্বাভাবিকভাবেই হিংসাত্মক মাত্রা নিয়েছে। ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে, কিছু জরিপ ইঙ্গিত দিয়েছে যে উভয় পক্ষই, বাইডেন বা ডেমোক্র্যাট সমর্থক, বা ট্রাম্প বা রিপাবলিকান সমর্থকরা, তাদের নির্বাচনী লক্ষ্যগুলি অনুসরণ এবং অর্জনের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্তরের রাজনৈতিক সহিংসতাকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালেস্টাইন স্টাডিজের অধ্যাপক হাদি বোরহানি মনে করেন মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশেষ সুনাম বা প্রভাব রয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি ফিলিস্তিনপন্থী এ ধরনের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে তাহলে তা সাধারণ জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। বিক্ষোভ যখন সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে তখন মার্কিন সরকার তা বন্ধ করতে পারবে না এবং এর ফলে বিষয়টি ইহুদিবাদী ইসরাইলি শাসকগোষ্ঠী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের লবিগুলোর জন্য হুমকিতে পরিণত হবে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র আসলে মেকি বা মিথ্যা গণতন্ত্র। দেশটির বেশিরভাগ জনগণ ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়ার বিরোধী হয়ে পড়লে ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ার মার্কিন নীতি আর স্থায়ী হবে না এবং এ ধরনের সমর্থন হবে বিপদাপন্ন।

সূত্র: মেহর নিউজ এজেন্সি (২০২৪): "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্র বিক্ষোভ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।"

ফাতেমেহ বারিমনি (২০২৪): "৭ই অক্টোবর ছাত্র আন্দোলনের সমাজবিজ্ঞান।" ফরিখতেগান পত্রিকা

তাসনিম নিউজ এজেন্সি (২০২৪): "মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যুত্থান একটি ব্যাপক সামাজিক অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে।" #

পার্সটুডে/এমএএইচ/৩০

·         বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।