ইমাম মাহদী (আ.)'র দাদা হাদী (আ.)'র কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা
আজ তেসরা রজব ইরানসহ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্বনবী (সা.)’র মহান আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম নাকী বা হাদী (আ.)’র শাহাদত-বার্ষিকী।
এ উপলক্ষে রেডিও তেহরানের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা এবং এই মহান ইমামের শানে পেশ করছি অশেষ সালাম ও দরুদ। মহত্ত্ব, অতুল জ্ঞান, আর সর্বোত্তম মানবীয় সব গুণ ছিল তাঁর ভূষণ। তাঁর জন্ম হয়েছিল ২১২ হিজরির ১৫ ই জিলহজ বা খৃষ্টীয় ৮২৮ সালে পবিত্র মদীনার উপকণ্ঠে।
বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের ধারায় তিনি ছিলেন দশম ইমাম।
ইমাম আলী আন নাকী বা হাদী (আ.) ২২০ হিজরিতে পিতা ইমাম জাওয়াদ (আ.)’র শাহাদতের পর মাত্র ৮ বছর বয়সে ইমামতের গুরু দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তাঁর পুত্র ইমাম হাসান আসকারি (আ.) ছিলেন মানব জাতির শেষ ত্রাণকর্তা ও বর্তমান ইমাম তথা ইমাম মাহদী (আ.)'র পিতা। (ইমাম মাহদী-আ. আদৃশ্য অবস্থায় হযরত ঈসা-আ.'র মতই জীবিত রয়েছেন বলে ইসলামী বর্ণনায় বলা হয়ে থাকে।)
ইমাম হাদী (আ.)'র ওপর নানা ধরনের নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি জালিম ও শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত আব্বাসীয় সরকার তাঁকে বিষ-প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করে। ২৫৪ হিজরির তেসরা রজব আব্বাসীয় খলিফা মুতাজ ৪১ বা ৪২ বছর বয়সের ইমাম হাদী (আ.)কে বিষ প্রয়োগে শহীদ করলে বিশ্ববাসী তাঁর উজ্জ্বল আলো থেকে বঞ্চিত হয়।
ইমাম হাদী (আ.)’র মাধ্যমে অনেক মো'জেজা বা অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
যেমন, আব্বাসীয় রাজার কয়েকজন জল্লাদ ও ভৃত্য রাজার নির্দেশে ইমাম (আ.)-কে আকস্মিকভাবে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়ে দেখতে পায় যে ইমামের চারদিকে রয়েছে একশ জনেরও বেশী সশস্ত্র দেহরক্ষী।
আর একবার রাজা মুতাওয়াক্কিল ইমামকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার জন্য তাঁর সামনে ৯০ হাজার সেনার সশস্ত্র মহড়ার উদ্যোগ নিলে ইমাম হাদী (আ.) মুতাওয়াক্কিলকে আকাশ ও জমিনের দিকে তাকিয়ে দেখতে বললে সে দেখতে পায় যে, আকাশ আর জমিন ভরে গেছে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত অসংখ্য সশস্ত্র ফেরেশতায় এবং রাজা তা দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
একই রাজা ইমামকে অপমান করার জন্য তাঁকে খাবারের দাওয়াত দেয়। ইমাম খাবারে হাত দেয়া মাত্রই রাজার নিয়োজিত এক ভারতীয় জাদুকরের জাদুর মাধ্যমে ওই খাবার উধাও হয়ে যায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই হাসতে থাকলে ইমাম জাদুকরের পাশে থাকা বালিশে অঙ্কিত সিংহের ছবিকে জীবন্ত হতে বলেন। সিংহটি জীবন্ত হয়ে ওই জাদুকরকে টুকরো টুকরো করে ফেলে। মুতাওয়াক্কিল তাকে আবার জীবিত করার জন্য ইমামকে অনুরোধ করেন, কিন্তু ইমাম বললেন: আল্লাহর শপথ তুমি তাকে আর দেখবে না! তুমি কি আল্লাহর ওলির ওপর আল্লাহর শত্রুকে কর্তৃত্বশীল করতে চেয়েছিলে?
মুতাওয়াক্কিল কখন কিভাবে মারা যাবে তাও ইমাম আগেই বলেছিলেন। ইমামের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ঠিক সেভাবে ও সেই সময়ই মারা গিয়েছিল এই আব্বাসীয় রাজা।
মুহাম্মাদ বিন শরাফ থেকে বর্ণিত হয়েছে: ইমাম হাদী (আ.)'র সঙ্গে মদীনার একটি রাস্তায় হাঁটছিলাম। ইমামের কাছে একটি প্রশ্ন করব বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশ্ন করার আগেই ইমাম হাদী (আ.) বললেন: 'আমরা এখন ভিড়ের মধ্যে রয়েছে এবং জনগণ চলাফেরা করছে। এখন প্রশ্ন করার জন্য ভালো সময় নয়।' (বিহারুল আনোয়ার)
মুহাম্মাদ বিন ফারাজ থেকে বর্ণিত হয়েছে: ইমাম হাদী (আ.) আমাকে বলেছেন, যখনই কোনো বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে চাও তা লিখে তোমার জায়নামাজের নিচে রাখবে এবং এক ঘণ্টা পর তা তুলে দেখবে। এরপর থেকে আমি এই পদ্ধতিতে ইমামের কাছ থেকে লিখিত জবাব দেখতে পেতাম। (বিহারুল আনোয়ার)
আবু হাশিম জা'ফরি থেকে বর্ণিত আছে, তিনি একদিন ইমামের সঙ্গে সামেরার বাইরে যান ও এক স্থানে দু'জনেই মুখোমুখি হয়ে মাটিতে বসেন। এ সময় আবু হাশিম তার তীব্র অভাবের কথা জানালে ইমাম ওই স্থানের ভূমি থেকে এক মুঠো বালি হাতে নিয়ে তা আবু হাশিমকে দেন এবং বলেন যে এগুলো তার অভাব দূর করবে ও যা দেখবেন তা যেন কাউকে না বলেন। আবু হাশিম শহরে ফিরে দেখেন যে সেই বালুগুলো লাল আগুনের মত চকচকে স্বর্ণ হয়ে গেছে। স্বর্ণকারকে তা দিয়ে বড় স্বর্ণের টুকরো করে দিতে বললে সে বিস্মিত হয়ে বলে: এমন ভালো ও বালু আকৃতির স্বর্ণ তো কখনও দেখিনি! কোথা থেকে এনেছ!? (বিহারুল আনোয়ার)
দাউদ বিন কাসিম জাফরিকে হজের সফর উপলক্ষে বিদায় দিতে গিয়ে ইমাম সামেরার বাইরে নিজের বাহন থেকে নেমে হাত দিয়ে মাটিতে একটি বৃত্ত আঁকেন। এরপর ইমাম হাদী (আ.) বলেন: হে চাচা! এই বৃত্তের ভেতরে যা আছে তা থেকে আপনার সফরের খরচ উঠিয়ে নেন। জাফরি তাতে হাত দিতেই একটি স্বর্ণ-পিণ্ড পেলেন যার ওজন ছিল দুইশত মিসক্বাল। (বিহারুল আনোয়ার)
আব্বাসিয় শাসক মোতাওয়াক্কিল ইমামের সাহচর্য পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে এবং তাঁর প্রতি ভালবাসা, সম্মান প্রদর্শন ও আনুগত্যের কথা বলে এই মহান ইমামকে ইরাকের সামেরা শহরে আসতে বাধ্য করেন। ইমাম মোতাওয়াক্কিলের চালাকি বোঝা সত্ত্বেও সামেরায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। সামেরা সফরে ইমাম হাদী (আ.)'র সঙ্গী ছিলেন ইয়াহিয়া ইবনে হারসামা। ইমাম সামেরার উপকণ্ঠে পৌঁছলে মোতাওয়াক্কিল ইমামকে অপমান করার জন্য শহরে ঢোকার অনুমতি না দিয়ে 'খানুস সায়ালিক' নামের এক অনুপযুক্ত স্থানে তাঁকে থাকার নির্দেশ দেয়। এখানে থাকত ভিক্ষুকরা। মোতাওয়াক্কিল পরের দিন এখানে ইমামের জন্য একটি আলাদা ঘর বরাদ্দ করে। সালেহ ইবনে সাইদ নামের এক ব্যক্তি ইমামের সেবা করার জন্য সেখানে আসেন। তিনি ইমামকে বলেন যে, জালিম মোতাওয়াক্কিল সব ক্ষেত্রে আপনার নুর নিভিয়ে দিতে চায় এবং অগ্রাহ্য করতে চায় আপনার মর্যাদাকে। আর এ জন্যই আপনাকে নিম্নমানের এই সরাইখানায় উঠিয়েছে (যেখানে ফকিররা থাকে)। ইমাম একদিকে ইশারা করে বললেন: হে সাইদ! ওই দিকে দেখ। সাইদ বর্ণনা করেন: আমি চেয়ে দেখলাম একটি সুসজ্জিত বাগান যা ছিল নানা রকম ফলে ভরা, ছিল প্রবাহিত ঝর্ণাধারা, বেহেশতি হুর ও গিলমান। এ দৃশ্য দেখে আমি বিস্ময়ে দিশেহারা হয়ে যাই। ইমাম হাদী (আ.) বললেন: আমরা যেখানেই থাকি এগুলো আমাদের খেদমতে নিয়োজিত থাকে। হে ইবনে সাইদ, আমরা খানুস সায়ালিকে থাকি না।
* * * সুন্নি আলেম শেখ সুলাইমান কানদুজি 'ইয়া নাবী আল মুয়াদ্দা' শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন: "(ঐতিহাসিক) মাসউদি বর্ণনা করেছেন, একদিন আব্বাসিয় শাসক মোতাওয়াক্কিল তার প্রাসাদের আঙ্গিনায় তিনটি হিংস্র পশু আনে এবং এরপর ইমাম হাদী (আ.)-কে দাওয়াত করে। যখনই ইমাম প্রাসাদের অঙ্গনে প্রবেশ করলেন তখনই মোতাওয়াক্কিল প্রাসাদের দরজা বন্ধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল হিংস্র পশুগুলো ইমামের চারপাশে পায়চারি করছিল এবং ইমামের প্রতি বিনয় প্রকাশ করল। আর ইমাম(আ.) জামার আস্তিন দিয়ে তাদের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। এরপর ইমাম উপরে মোতাওয়াক্কিলের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে আবার নীচে নেমে আসেন। ইমাম প্রাসাদ অঙ্গন থেকে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত হিংস্র পশুগুলো আবারও বিনয় প্রকাশ করছিল। পরবর্তীতে মোতাওয়াক্কিল ইমামের জন্য এক বিশাল উপহার পাঠায়। দরবারিরা মোতাওয়াক্কিলকে বলল: ইমাম হাদী (আ.) পশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন তাতো দেখলে। এবার তুমিও ওই একই কাজ কর। মোতাওয়াক্কিল বলল: তোমরা কি আমাকে মারতে চাও! আর বলল, এ ঘটনা কাউকে বলো না।" #
পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/