ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৯৩): যুদ্ধে সরাসরি আমেরিকার অংশগ্রহণ
গত আসরে আমরা নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব সম্পর্কে ইরানের অবস্থান এবং তখন পর্যন্ত যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা পারস্য উপসাগরে ‘তেল ট্যাংকার যুদ্ধ’ এবং এই যুদ্ধে আমেরিকার সরাসরি অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলোচনা করব।
একদিকে ইরাকের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা এবং অন্যদিকে ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধুহীন ইরানের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য গোটা বিশ্ব যখন ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তখন এদেশের নীতি নির্ধারকরা চরম জটিল অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। ওই প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পর ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার আক্রমণাত্মক ও রুঢ় আচরণ প্রকট আকার ধারণ করে। পারস্য উপসাগরে মোতায়েন মার্কিন রণতরীগুলো সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে যায়।
ইরানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মাধ্যমের অপপ্রচার তীব্র আকার ধারণ করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনার পরিবেশ সম্পূর্ণ ইরানের বিরুদ্ধে চলে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে, যুদ্ধের যে ভারসাম্য ইরানের পক্ষে ছিল তা ইরাকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পারস্য উপসাগরে আরব দেশগুলোর তেল ট্যাংকারগুলোর নিরাপত্তা রক্ষায় আমেরিকা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মার্কিন সরকার কুয়েতের তেল ট্যাংকারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এগুলোকে স্কর্ট করা শুরু করে। পারস্য উপসাগরের জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে আমেরিকা এ অঞ্চলে ৭৩ হাজার সেনা মোতায়েন করে। ওয়াশিংটন হুমকি দেয়, ইরান আমেরিকার পতাকাবাহী কোনো তেল ট্যাংকারে হামলা চালালে তার প্রতিশোধ নেয়া হবে।
পারস্য উপসাগরের আকাশে আমেরিকার জঙ্গিবিমান ও হেলিকপ্টারের আনাগোনা বেড়ে যায়। একইসঙ্গে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের পক্ষ নিয়ে ইরানের স্বার্থে আমেরিকার সামরিক হামলা বেড়ে যায়। কিন্তু এত হুমকি ও হামলা সত্ত্বেও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর স্বার্থে এই কৌশলগত উপসাগরের নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় ইরান।
ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ইমাম খোমেনী ১৯৮৭ সালের ২৮ জুলাই পারস্য উপসাগরে আমেরিকার সামরিক তৎপরতা সম্পর্কে এক ভাষণে বলেন, “গোটা বিশ্ব একথা বুঝতে পেরেছে যে, পারস্য উপসাগরে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হলে তাতে ইরান একা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না; বরং এখানে যদি নিরাপত্তাহীনতা থাকে তাহলে বিশ্বের সকল পরাশক্তি মিলেও যদি একটিমাত্র জাহাজের নিরাপত্তায় নিয়োজিত হয় তাহলেও ওই জাহাজটি বিপদমুক্ত থাকবে না। ”
ইমাম খোমেনী আরো বলেন, “গোটা বিশ্ব যদি নিজেকে তেল সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা অচল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত করে থাকে তাহলে আমরাও প্রস্তুত রয়েছি এবং আমরাও কোমর বেঁধেছি। আমরা অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আমেরিকাকে একথা উপলব্ধি করতে হবে যে, পারস্য উপসাগরে সামরিক হস্তক্ষেপ একটি পরীক্ষা নয় বরং এটি একটি ভয়ঙ্কর খেলা। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সকল মুসলমান একথা বিশ্বাস করে যে, পরাশক্তিগুলো এ অঞ্চলে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে মুসলিম দেশগুলোর ওপর বিশেষ করে ইরানের ওপর আগ্রাসন চালানোর জন্য।”
প্রকৃতপক্ষে ইরানে নানা সমস্যা ও অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও ইরাক সরকারকে সহযোগিতা করতে আমেরিকা যে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিল সে ব্যাপারে চুপ থাকা তেহরানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইরানের তেল ট্যাংকার ও বাণিজ্যিক জাহাজসহ অন্যান্য বেসামরিক স্থাপনায় ইরাকি বাহিনীর হামলা জোরদার হলে ইরানও একই ধরনের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইরানের যেকোনো তেল ট্যাংকারে হামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরাকের সহযোগী কোনো একটি দেশের তেল ট্যাংকারে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো শুরু করে ইরান। এর ফলে ‘তেল ট্যাংকার যুদ্ধের’ ব্যাপারে ইরাকের সাদ্দাম সরকার দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। আমেরিকাও ইরাকের সহযোগী দেশগুলোর তেল ট্যাংকারগুলোকে ইরানের হামলা থেকে রক্ষা করার কাজে মনযোগী হয়।
১৯৮৭ সালের ২২ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশে দু’টি কুয়েতি তেল ট্যাংকারের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং তাতে মার্কিন পতাকা লাগিয়ে পারস্য উপসাগরে নামানো হয়। তার আগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় এবং ব্রিজটাউন ও গ্যাসপ্রিন্স নামের জাহাজ দু’টিতে বহু সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষককে যাত্রী হিসেবে উঠানো হয়। তিনটি মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ ও বহু জঙ্গিবিমান কুয়েতি তেল ট্যাংকারগুলোকে স্কর্ট করতে থাকে। আমেরিকা ভেবেছিল, এতটা সাজসজ্জার সঙ্গে পরিচালিত তেল ট্যাংকারে হামলা চালানোর সাহস ইরান করবে না এবং করলেও সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু কুয়েতের আহমাদি বন্দর থেকে বের হওয়ার চ্যানেলের ৮০ মাইল দূরে ‘ব্রিজটাউন’ তেল ট্যাংকারে একটি শক্তিশালী মাইন আঘাত হানে। মাইনটির বিস্ফোরণ এতটা শক্তিশালী ছিল যে, কয়েকজন সাংবাদিক ও নাবিক জাহাজটি থেকে সাগরে পড়ে যায় এবং জাহাজের ৩১টি রিজার্ভারের মধ্যে ৪টিতে পানি ঢুকে যায়।
এতদিন পর্যন্ত আমেরিকা ভাবত পারস্য উপসাগরে তার ক্ষতি করার সাধ্য কারো নেই। কিন্তু এই ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেন, পারস্য উপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে মাইন। ব্রিজটাউন তেল ট্যাংকারে মাইনের আঘাত রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রচারণাগত দিক দিয়ে আমেরিকার জন্য বিপর্যয়কর ফল বয়ে আনে। আমেরিকার সামরিক সক্ষমতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এভাবে কুয়েতি তেল ট্যাংকারে মার্কিন পতাকা লাগিয়ে পারস্য উপসাগরের ‘তেল ট্যাংকার যুদ্ধ’ বন্ধ করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অনেকে মনে করেন, আমেরিকা যদি সরাসরি এই যুদ্ধে ইরাকের পক্ষ অবলম্বন না করত তাহলে বহু আগে এ যুদ্ধের ভারসাম্য ইরানের পক্ষে চলে আসত।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।