মার্চ ১১, ২০২২ ১৬:৩৮ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

প্রত্যেক সপ্তাহ'র মতো আজকের আসরেও আমরা একটি গল্প শোনাব। গল্পটি দুই গোলামের। আর নেওয়া হয়েছে মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ মসনবী থেকে। গল্পের পর থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তো প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

আগেরকার দিনে পশু-পাখির মতো মানুষও কেনাবেচা হতো। বিত্তবান ধনী লোকেরা দাসদাসী হিসেবে তাদের ক্রয় করতো। মনিব ইচ্ছে করলে তাদের পুনরায় বিক্রি করে দিতে পারত আবার কখনো অতিশয় সদয় হলে কোনো কোনো দাসদাসীকে মুক্ত করে দিত।

একবার এক ধনী লোক বাজার থেকে দু’জন গোলাম ক্রয়ের নির্দেশ দিলে হাটে গিয়ে তার লোকেরা দু’জন গোলাম কিনে আনল। একজনের দাম একশো দেরহাম এবং আরেকজনের দাম বিশ দেরহাম।

গোলামদের বাড়ি নিয়ে আসা হলে মনিব একজনকে ডেকে পাঠাল। গোলামটি ছিল বেশ সুদর্শন যুবক, গায়ের রঙ ফর্সা। গোলাম মনিবের ঘরে ঢুকেই সালাম জানিয়ে কুর্নিশ অবস্থায় দাঁড়াল। মনিব জিজ্ঞেস করলে গোলাম জানালো তার নাম জামাল।

এরপর মনিব তাকে আরোও অনেক প্রশ্ন করল এবং তার সাথে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারলেন যে, সে বেশ চালাক চতুর, সুন্দর কথাবার্তা বলতে পারে আর আদব-কায়দা জানে।

মনিব এরপর দ্বিতীয় গোলামকে ডেকে পাঠালেন। সে এক কৃষ্ণকায় খাটো এবং দুর্বল ও শীর্ণদেহী যুবক। দেখতে খুবই মনমরা। গোলাম ঢুকেই সালাম জানাল এবং মনিবের সামনে চৌকির উপর বসে পড়ল। মনিব নাম জিজ্ঞেস করলে সে জানাল তার নাম কামাল।

এসময় মনিব তার বৃদ্ধ গোলামকে নির্দেশ দিলেন জামালকে হাম্মামে নিয়ে গোসল করিয়ে কাপড়-চোপড় বদলিয়ে নিয়ে আসতে। জামাল চলে যাওয়ার পর মনিব দ্বিতীয় কামালের সাথে আরো কথাবার্তা বলে তার চরিত্র ও আচার ব্যবহার সম্পর্কে পরীক্ষা নেয়া শুরু করলেন। মনিব বললেন: শুনেছি তোরা দু’জন এক বাড়িতে কাজ করতি। কী হলো যে তোদের বিক্রি করে দিল?

কামাল: জানিনে কেন। তবে একদিন মনিব নির্দেশ দিলেন আমাদের যেন বিক্রি করে দেয়া হয়। হয়তো বা আমাদের চেয়ে আরো ভালো গোলাম পেয়েছেন কিংবা গোলামের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে।

মনিব: ওখানে তোদের জীবন কেমন কেটেছে? মনিবের উপর রাজি ছিলিতো?

গোলাম: আমাদের যা অবস্থা তাতে রাজি হওয়ার কী আছে! মানুষ মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত রাজি হতে পারে না। কিন্তু তবু কাজ করে গেছি, অন্যদের মতোই জীবন কেটেছে।

মনিব: এবার বল্‌ তো দেখি, জামাল তোর সম্পর্কে আমাকে যা বলেছে তা কি সত্য?

কামাল: আমার মনে হয় না আমার সহকর্মী আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলবে। কারণ, আমি কখনো তার  কোনো ক্ষতি করিনি। সে যদি কিছু বলে থাকে তাহলে হয়তো সত্য কথাই বলেছে।

মনিব: আমার কাছেতো তোকে ভালোই মনে হচ্ছে। কিন্তু জামালতো বলল তুই নাকি ঈর্ষাপরায়ণ, অবিশ্বস্ত, গোপনে খবর সংগ্রহ করিস এবং বাইরের লোকদের বলে দিস্?

কামাল: জামাল যদি এসব বলে থাকে তাহলে হয়তোবা সত্যই বলেছে। জানি না আমি ঈর্ষাপরায়ণ কিনা। তবে উন্নতি চাই, যারা আমার চেয়ে ভালো তাদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি। এর নাম ঈ র্ষা হলে হতেও পারে। অবিশ্বস্ত কিনা বলতে পারব না, তবে কেউ যদি আমাকে ফুসলাতে আসে ও মনিবের বিরুদ্ধে খিয়ানত করতে চায় তখন আমি এর বিরোধিতা করি। এর নাম অবিশ্বস্ততা হয়তোবা বলা যেতে পারে। আমি গোপন খবর সংগ্রহকারী কিনা জানি না, তবে আমাকে কোথাও কোনো সংবাদ আনার জন্যে পাঠানো হলে ঐ বিষয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজ খবর নিয়ে থাকি। সবকিছু বুঝে শুনেই সংবাদ নিয়ে আসি। তখন নিজের মতামতও ব্যক্ত করি। এর নাম গুপ্তচরবৃত্তি বললে   কথাটা সত্যই। জামাল হয়তো মিথ্যে কিছু বলেনি।

মনিব: যাক ওসব, এখন বল দেখি জামালের দোষত্রুটি কী কী?  

কামাল: আমি তো তার ভেতর তেমন কোনো দোষত্রুটি দেখিনি। সেতো বেশ সুন্দর চেহারার যুবক। বেশ আদব-কায়দা জানে। সবখানেই আমার থেকে তার কদর ও আদর বেশী। তার দামও একশো দিরহাম আর আমার দাম মাত্র বিশ দিরহাম।

মনিব: বেশ ভালো কথা। এবার বল্‌ দেখি এখানে আসতে পেরে কি সন্তুষ্ট হয়েছিস? এই জায়গা কি আগের চেয়ে ভালো?

কামাল: আমার দায়িত্ব কেবল কাজ ও সেবা করা। যেখানেই থাকি না কেন- এতে কোনো ফারাক নেই। তবে গোলাম ও ক্রীতদাস হওয়ায় এবং মুক্ত মানুষ নই বলে আমি খুশি নই। কিন্তু আমার হাতে তো ক্ষমতা নেই। এছাড়া আজ এখানে নতুন এসেছি। তাই জানি না এখানে ভালো আছি- না সেখানে ভালো ছিলাম। কিছুদিন গেলেই আমিও যেমন আপনাকে অনেক চিনতে পারব আপনিও তেমনি আমাকে চিনতে পারবেন। এখন কিছুই বলা যাবে না। (বাজনা)

কামালের ভদ্রতা ও সত্যবাদিতায় মনিব মনে মনে বেশ খুশি হলেন ও তার প্রশংসা করলেন। এমন সময় জামাল গোসল সেরে ও জামা বদলিয়ে চলে এলো। মনিব তার বৃদ্ধ গোলামকে নির্দেশ দিলেন যাতে কামালকে এখনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। কামাল চলে গেলে মনিব জামালকে পরীক্ষা করা শুরু করলেন। কামালকে যেরূপ প্রশ্ন করেছিলেন সেরূপ তাকেও প্রশ্ন করতে লাগলেন। মনিব বললেন, শুনলাম তোরা দু’জন এক বাড়ীতে কাজ করেছিস। কিন্তু কী হলো যে মনিব তোদের বিক্রি করে দিল?

জামাল: আমার কোনো দোষ ছিল না। এই কামালটাই সব দোষের মূল। সে প্রথম থেকেই ছিল অলস। এছাড়া মুখের উপর কথা বলার বদঅভ্যাস তার আছে। মনিব তা অপছন্দ করতেন। তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের দু’জনকেই বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

মনিব: ওখানে তোদের জীবনযাত্রা কেমন ছিল? মনিবের উপর রাজি ছিলি তো?

জামাল: না বাবা, কিসের জীবন? ওখানে কুকুরের মতো শুধু খেটে মরতাম। এরপরও মনিব শুধু দোষ ধরতেন। কামালতো কয়েকবার বলেই ফেলল, চল মনিবের অর্থকড়ি নিয়ে কেটে পড়ি। কিন্তু আমি বলেছি, না, তা অন্যায়। অবশ্য শেষতক মনিবই কিনা বেইনসাফি করলেন। আমাদের বিক্রি করে দিলেন। যাক, আমরা তার অনিষ্টতা থেকেই উদ্ধার পেলাম।

মনিব: এই যে তোর সহকর্মী কামাল তোর সম্পর্কে এতোসব বলল তা কি সত্য?

জামাল: না, মোটেও না। আল্লাহর কসম সে মিথ্যা বলেছে। আসলে সে একটা কমজাত বদমাশ। সব সময়ই আমার মন্দ খোঁজে বেড়ায়। তার চেহারা থেকেই বোঝা যায় যে, সে একটা অসৎ মানুষ। এই কুৎসিত লোকটির কথা কখনো বিশ্বাস করবেন না।

মনিব: আমার তো মনে হয়, তুই একজন সদাচারী সৎস্বভাবের যুবক। কিন্তু কামাল বলল যে, তুই নাকি ঈর্ষাপরায়ণ, অবিশ্বস্ত, খবরাখবর গোপনে সংগ্রহ করে বলে দিস, আরো কত কী!

জামাল: আমি নই বরং কামালই ঈর্ষাপরায়ণ। সে নিজেকে আমার চেয়ে ভালো মনে করে। ঈর্ষার কারণেই তার গায়ের রং কালো হয়েছে। অবিশ্বস্ত ও বেঈমান তো এই কামালই। সব সময়ই আমার বদনাম করে বেড়ায়।

মনিব: যাক ওসব কথা। এবার বল্ এখানে এসে খুশি হয়েছিস কিনা? এই জায়গাটা ভালো না মন্দ?

জামাল: কী যে বলেন মালিক! আমি অতিশয় খুশি হয়েছি এখানে এসে। কোথায় আপনি আর কোথায় আগের মনিব! আপনি তো সোনার মানুষ, দুনিয়ার সবার সেরা। আমিতো সব সময় স্বপ্নে আপনার চেহারাই দেখতাম। আজ এখানে আসতে পেরে নিজের কামনা-বাসনাকেই পূরণ করতে পারলাম।

মনিব: ঠিক আছে, আমার যা জানার ছিল, জেনে গেলাম। এখন বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর্‌। কামাল ফিরে এলে কাজের নির্দেশ দেবো।

কামাল ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে এলে মনিব জামাল ও কামাল উভয়কে ডেকে পাঠালেন। তাদের দু’জনকে লক্ষ করে বললেন, আমি তোদের দু’জনকেই পরীক্ষা করেছি। হে কামাল, তোর কোনো দোষত্রুটি পাইনি। কিন্তু হে জামাল, তুই তোর বাহ্যিক চেহারা সুরতের কারণে খুব অহংকারী হয়ে গেছিস। সবাইকেই তোর নিজের মত বাহ্যদর্শী বলে মনে করিস। দেখ্ কামালের নিয়ত কতো ভালো। তার সহকর্মীর অবর্তমানেও সে কোনো বেঈমানি করেনি, কোনো বদনামও রটায়নি। আমি তাকে বিশ্বাস করছি। এখন থেকে তুই কামালের অধীনে কাজ করবি। তোষামোদে ও অযথা প্রশংসা না করে কী করে সঠিক কাজ করতে হয় এবং ভেতর ও বাহিরকে এক রাখতে হয় তার শিক্ষা কামালের কাছ থেকে গ্রহণ করবি। এরপর দেখা যাবে কী করা যায়।

মনিবের বাড়ির পেছন দিকেই ছিল একটি বাগান। কামাল ও জামাল এ বাগানে নালা কাটার ও সেখানে পানি সরবরাহের কাজে নিয়োজিত হলো। সেই প্রথম দিনই ঘণ্টাখানেক কাজ করার পর জামাল বসে পড়ল নালার পাশে এবং বলল: আর পারিনে, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এ কাজ আমার দ্বারা অসম্ভব। এক খারাপ মনিবের হাতে এসে পড়লাম। চল্ দু’জনে মিলে এতো খারাপ কাজ করি যাতে মনিব অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের বিকিয়ে দেন। হয়তো এরপর ভালো কোনো মনিবের হাতে গিয়ে পড়ব।

কামাল বলল: জামাল! ও রকম চিন্তে করবিনে। মন খারাপ করিসনে ভাই। আমিই না হয় বেশীর ভাগ কাজ করব, তোর কাজও করে দেবো। মনিবের বদনাম করার দরকার নেই। ধৈর্য্য ধর, সব ঠিক হয়ে যাবে। কোথা থেকে জানবো যে, পরবর্তী মনিব আরো খারাপ হবে না?

জামাল বলল: এখন যে ভালো মানুষ হয়ে গেছিস! কিন্তু মনিবের সাথে যখন একা ছিলি তখনতো আমার সম্পর্কে এতো মন্দ বলেছিলি যে, শেষ পর্যন্ত মনিব তোকে সর্দার বানিয়ে দিলেন।

কামাল বলল: না বন্ধু, মোটেও তা নয়। এ ধরনের খারাপ ধারণা করবিনে। যদি জানতে চাস মনিবের সাথে কী কথাবার্তা হয়েছে আমি তার সবকিছু তোকে হুবহু খুলে বলব।

এরপর কামাল তার সাথে মনিবের যা সওয়াল জওয়াব হয়েছে সবই খুলে বলল। পরে জামালকে জিজ্ঞেস করল, এবার বল্ তোর সাথে মনিবের কি আলাপ-সালাপ হয়েছিল?

জামাল যখন বুঝতে পারল যে, উভয়ের সাথে মনিবের প্রশ্ন একই ধরনের ছিল এবং কামাল তার সম্পর্কে মনিবের কাছে খারাপ কিছু বলেনি তখন লজ্জায় তার চেহারাই লাল হয়ে গেল। সে মুখ নীচু করে বলল: মনিবের সাথে আমার যা কথাবার্তা হয়েছে তা আমি বলতে পারব না। মনিব যখন আমাকে বললেন যে, তুই তার কাছে আমার বদনাম করেছিস তখন আমি মনিবের কথা বিশ্বাস করে ফেলি। তাই নিজেকে ভালো ও তোকে খারাপ বলে প্রমাণের চেষ্টা চালাই। এখন বুঝতে পারছি যে, মনিব আসলে আমাদের পরীক্ষা করে দেখেছেন আর আমি সে পরীক্ষা খুব খারাপভাবেই দিলাম। অথচ তুই এখনো আমার হয়ে পরিশ্রম করতে চাচ্ছিস। আমি মেনে নিচ্ছি যে তুই-ই বড়, তুই-ই মহৎ।

এরপর দু’জন মিলেমিশে কাজ করতে লাগল। কিছুকাল পর মনিব অন্যত্র চলে যেতে চাইলে গোলাম দু’জনকেও বিক্রি করতে পাঠালেন। জামালকে দু’শো দিরহামে বিক্রি করা গেলেও কামালের জন্য ভালো দামে কোনো গ্রাহক পাওয়া গেল না। মনিব আসলে কামালকে বিক্রি করতেও চাননি। তিনি তাকে আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত করে দিয়ে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করলেন। এরপর পিতা-পুত্র এক সাথেই চলে গেলেন অন্যত্র।

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি গান। 'ঐ নীল নোয়ানো আকাশ' শিরোনামের গানটি লিখেছেন মতিউর রহমান খালেদ, সুর করেছেন হেলাল আহমেদ। আর গেয়েছে সিলেটের দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীর শিশু শিল্পীরা। 

তো বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদাই নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে। কথা হবে আবারো আগামী আসরে।

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ