রিজার্ভ গ্লুকোজের মতো
'রিজার্ভ আলগাভাবে খরচ করলে সংকট অনিবার্য'
রিজার্ভ 'গ্লুকোজের' মতো। কম-বেশি হওয়াও দোষের। কোনো দেশের রিজার্ভ ঠিক যেটুকু প্রয়োজন সেইটুকুই থাকবে। বেশি হওয়াও দোষের, কম হওয়াও দোষের। রিজার্ভের ব্যাপারটি কিন্তু এরকম যে না কম না বেশি। রিজার্ভকে যদি আলগাভাবে খরচ করা হয় তাহলে সংকট তো হবেই! দেশের রিজার্ভের প্রকৃত অবস্থা এবং বাস্তবতা যেটা- সেটাই হচ্ছে।
রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন, অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।
- তিনি আরো বলেছেন, রিজার্ভের টাকাটা কার টাকা? এ টাকাটা জনগণের টাকা। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকা অথবা বিদেশি ঋণের টাকা। আর সেই টাকাকে যদি আমরা মনে করি যে, আমাদের অনেক টাকা আছে ফলে খরচের বিষয়ে যদি আলগা হয়ে যাই তখন তো টানাটানি পড়বেই; সংকট সৃষ্টি হবেই। আমাদের এখানেও ঠিক তাই ঘটেছে।
এক পর্যায়ে রিজার্ভ প্রচুর বেড়েছে। আর রিজার্ভ বেশি বলে অনেক ক্রেডিটও নিয়েছেন। তবে Its not your credit যে আপনার রিজার্ভ বেড়েছে মানে আপনি খুব ভালো হয়ে গেছেন, আপনার অর্থনীতি ভালো হয়ে গেছে।
- 'বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কুইক রেন্টালে গেলাম কিংবা প্রাইভেট সেক্টরকে নিলাম এবং দায়মুক্তি দিয়ে দিলাম। কি চুক্তি করলাম, কারসাথে কত টাকার চুক্তি করলাম সেই টাকা কিভাবে দেয়া হচ্ছে এসব বিষয়কে স্পস্ট না করলে এখান থেকে ভুল বোঝাবুঝিগুলো হয়। কারণ অর্থনীতি চলবে অবশ্যই আস্থার ভিত্তিতে।'
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব, ড. মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ, সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত বক্তব্য রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডলার সংকটের মুখে তিনি বলেছেন, সরকার রিজার্ভের টাকা চিবিয়ে খায়নি। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর ইঙ্গিত সরকারের দিকেই। তাদের বক্তব্য হচ্ছে সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট এবং অব্যবস্থাপনার কারণে আজকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট দেখা দিয়েছে। আপনার কী মনে হয়?
ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: দেখুন, প্রকৃত অবস্থা এবং বাস্তবতা যেটা সেটাই হচ্ছে। এরপক্ষে বা বিপক্ষে কে কি বললো তাতে রিজার্ভের কোনো উন্নতি অবনতি কিছুই ঘটে না। রিজার্ভর সাথে যেরকম আচরণ করা হয় সে তার নিজস্ব নিয়মে সেভাবেই চলে। রিজার্ভে বিভিন্ন খাতের টাকা আছে। সেখানে সরকারের টাকা আছে। প্রবাসীদের টাকা রয়েছে। ফরেন এইডের টাকা আছে। ফলে রিজার্ভে সবার টাকা আছে। তবে কোনো একটা পক্ষ যদি মনে করেন যে রিজার্ভের পুরো টাকা আমার এবং যেভাবে খুশি যা ইচ্ছে তাই খরচ করতে পারি-তাহলে একধরনের ফলাফল আসবে। অন্যদিকে রিজার্ভের টাকা যাইহোক, সেটাকে ন্যায্য,ন্যায়সঙ্গত এবং প্রয়োজনীয়তার সাথে যদি ব্যয় করা হয় তাহলে তার বিপরীতে নিশ্চয়ই একটা ব্যাকঅ্যাপও আসে। অর্থাৎ দশ টাকা খরচ করলে যেন দশ টাকার একটা জিনিষ পাওয়া যায়। যদি রিজার্ভের টাকা এমনভাবে খরচ করা হয় তাহলে এই খরচকে কেউ বাজে খরচ বলতে পারে না।
রেডিও তেহরান: আচ্ছা ড. আবদুল মজিদ, আপনি রিজার্ভের টাকা খরচের ব্যাপারে বললেন যা ইচ্ছে বা যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে রিজার্ভ খরচ করা যাবে না। রিজার্ভের টাকা এমনভাবে খরচ করতে হবে যাতে কেউ বাজে খরচ বলতে না পারে। তো রিজার্ভের টাকা খরচের কোন দিকটিকে বাজে খরচ বলা হবে।
ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: দেখুন বিষয়টি এরকম, যদি নিয়মসঙ্গতভাবে ভালো রিজার্ভ গড়ে তোলা হয় এবং খরচের ক্ষেত্রেও যদি সঠিকভাবে খরচ করা হয় তাহলে সংকটের কথা উঠবে কেন? ফলে রিজার্ভকে কে কিভাবে ব্যবহার করেছেন তার উপর নির্ভর করবে সংকটে পড়া কিংবা সুষ্ঠু ব্যবহারের দৃষ্টান্ত হওয়া। ফলে রিভার্জ যে কারণে এবং যেভাবে গড়ে ওঠে এবং সেই রিজার্ভ যেভাবে খরচ করা হয় এই দুই ক্ষেত্রে যদি স্বচ্ছতা থাকে, নিয়মতান্ত্রিকতা থাকে তাহলে রিজার্ভ বাড়া বা কমা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ অতীতে এমনও দেখা গেছে যে যথেস্ট কম ছিল। এমনকি তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো সক্ষমতাও মাঝে মাঝে ছিল না। এমন দুঃখ এবং সমস্যাও যেমন ছিল আবার একটা পর্যায় এসে রিজার্ভ এত বেড়ে গেল যে দেখা যাচ্ছে টাকা খরচই হয়নি। রিজার্ভের টাকাটা অলস হিসেবে পড়ে ছিল। আর সে কারণে রিজার্ভ বেড়ে যায়।
বিষয়টিকে আমি এভাবে দেখি, এটা হচ্ছে মানুষের শরীরের গ্লুকোজের মতো। গ্লুকোজ যদি ছয় মিলিমোল পর্যন্ত থাকে তাহলে সেটি ভালো। তার ডায়াবেটিস নেই ধরে নেয়া হবে। আর ছয় এর নিচে নেমে গেলে তার হাইপো হয়ে যেতে পারে। আবার ১৩.১৪ কিংবা ১৫তে যদি ওঠে তাহলে হাইপার গ্লাসিমিয়া হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ বেশি হওয়াও দোষ, কম হওয়াও দোষ। রিজার্ভের ব্যাপারটি কিন্তু তাই। ঠিক যেটুকু প্রয়োজন সেইটুকুই থাকবে।
শ্রোতাবন্ধুরা! রিজার্ভ নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবদুল মজিদের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি শিগগিরিই আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: মিউজিক বিরতির পর আবারও ফিরে এলাম, আচ্ছা ড. মজিদ আপনি বলছিলেন রিজার্ভ কম এবং বেশি দুটোই সমস্যার। আপনি গ্লুকোজ বাড়া কমার সাথে তুলনা করলেন। কমার সংকটটা নিয়ে তো ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে রিজার্ভ বেশি থাকলে অসুবিধাটা কি একটু বলবেন?
ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: দেখুন, রিজার্ভ যদি বেশি থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে রিজার্ভের টাকা যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়নি। অথবা রিজার্ভের টাকা আসলেও যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। এছাড়া আরো যে সমস্যাটি হতে পারে সেটি হচ্ছে যখন রিজার্ভ অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে যায় তখন এক ধরনের আত্মম্ভরিতা, অহংকার চলে আসে। তখন মনে হতে পারে আমাদের তো প্রচুর টাকা আছে। চাইলে আমরা যেখানে সেখানে যেভাবে খুশি খরচ করতে পারি। কিন্তু যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে- রিজার্ভের যে টাকাটা আছে সেটি কার টাকা? এ টাকাটা তো জনগণের টাকা। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকা অথবা বিদেশি ঋণের টাকা। আর সেই টাকাকে যদি আমরা মনে করি যে আমাদের অনেক টাকা আছে ফলে খরচের বিষয়ে যদি আলগা হয়ে যাই তখন তো টানাটানি পড়বেই; সংকট সৃষ্টি হবেই। আমাদের এখানেও ঠিক তাই ঘটেছে। এক পর্যায়ে রিজার্ভ প্রচুর বেড়েছে। আর রিজার্ভ বেশি বলে অনেক ক্রেডিটও নিয়েছেন। তবে Its not your credit যে আপনার রিজার্ভ বেড়েছে মানে আপনি খুব ভালো হয়ে গেছেন, আপনার অর্থনীতি ভালো হয়ে গেছে। খুবই সচেতনার সাথে দেখতে হবে যে রিজার্ভ যেসব উৎস থেকে এসেছে সেটি যথাযথভাবে ব্যয় হতে হবে। আমাদের টাকা আছে বলেই যদি আমরা যেভাবে খুশি খরচ করতে থাকি-যেমন করোনাকালে বলা হলো যে-রিজার্ভের টাকা জনগণের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। তো করোনাকালে জনগণের জন্য ব্যয় করার কি এমন ঘটল!
সারা বিশ্ব ঐ সময় ভ্যাকসিনের কথা বলেছে। চারদিকে অনুদান পাওয়া যাচ্ছে ভ্যাকসিন। একইসময় মনে করা হলো যে এটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। এটি আমাদের কিনতে হবে। তারপর কেনার জন্য একেক সময় একেক দরের কথা বলা হলো। জনগণের কাছে ধারনা হলো যে আমাদেরকে ভ্যাকসিন ফ্রি দেয়া হয়েছে। পরে দেখা গেল যে ভ্যাকসিনটি চড়া দামে না বুঝে শুনে কেনা হয়েছে। আমি সুনির্দিষ্টিভাবে কোনো কেনাকাটার ক্ষেত্রে কোনো মন্তব্য করব না কারণ এগুলো সবই দেখার বিষয়। কিন্তু সাধারণভাবে আমি বলব রিজার্ভ গড়ে তোলা দরকার ততটুকুই যতটুকু প্রয়োজন।
রেডিও তেহরান: ড. আবদুল মজিদ আপনি রিজার্ভ গড়ে ওঠার বিষয় এবং ব্যবহারের স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন, তো রিজার্ভ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার বিষয়টি কি আছে?
ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: রিজার্ভের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার বিষয়টিকে আমি এভাবে বলব, ধরুন আপনি ১০ টাকার মালিক। তো এই টাকাটা খরচের সময় আপনাকে তো বুঝে শুনে খরচ করতে হবে। খরচের সময় সতর্কভাবে খরচ করতে হবে। কিন্তু আপনার মনে যদি এমন হয় যে –আমার লাগে ৮ টাকা অথচ আছে তো ১০ টাকা। অসুবিধা নেই। আমাকে হয়তো খরচের নানা পথ দেখাল। এভাবে, সেভাবে নানা পথ দেখাল কেউ। আর আমি সেভাবে খরচ করে একটা কমিটমেন্টের মধ্যে পড়ে গেলাম। তারপর দেখা গেল সেই লোক আগের দেখানো পথ ঘুরিয়ে অন্যভাবে নিয়ে গেল এবং আমার কাছে টাকা বের করে নেয়ার ব্যবস্থা করল। স্বচ্ছতা বা অস্বচ্ছতার বিষয়টি এখানে।
স্বচ্ছতা হচ্ছে ন্যায়সঙ্গতভাবে যেটা যতটুকু প্রয়োজন সেই খরচটি আপনি করবেন সচেতনতা ও সতর্কতার সাথে। ধরুন আপনার কাছে টাকা আছে বলেই বাজারে গিয়ে ৮০০ টাকার ইলিশ মাছকে ১২০০ টাকা হাকিয়ে সেই মাছ আপনি নিয়ে আসবেন-এটা কোনোভাবেই সুস্থ অর্থনীতি ব্যবস্থা হতে পারে না। যেকারণে আমি স্বচ্ছতার কথা সরাসরি বলছি না- আমি বলছি আপনার জমা টাকা খরচের সময় অবশ্যই আপনি চিন্তাভাবনা করে খরচ করবেন যথেচ্ছারভাবে নয়। একজন মানুষ যখন তার গাঁটের টাকা করচ করে তখন যে সতর্কতা অবলম্বন করে সেভাবেই করতে হবে। এটি জিএফআর রুল নম্বর ১০।
আমি আবারও বলছি কারও টাকা আছে তো ঠিক আছে তিনি দরাদরি করলেন না, কিংবা কারও অন্যভাবে পয়সা পাওয়ানোর জন্য অন্যধরনের একটা দর ঠিক করে দিলাম।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কুইক রেন্টালে গেলাম কিংবা প্রাইভেট সেক্টরকে নিলাম এবং দায়মুক্তি দিয়ে দিলাম। কি চুক্তি করলাম, কারসাথে কতটাকার চুক্তি করলাম সেই টাকা কিভাবে দেয়া হচ্ছে এসব বিষয়কে স্পস্ট না করলে এখান থেকে ভুল বোঝাবুঝিগুলো হয়। কারণ অর্থনীতি চলবে অবশ্যই আস্থার ভিত্তিতে। আস্থা থাকতে হবে। বুঝতে পারা যাবে যে হিসেব নিকেষ করে খরচ করা হচ্ছে এবং খরচের বিপরীতে সম্পদ পাওয়া যাচ্ছে ফলে বিষয়টি ঠিক আছে। অন্যদিকে দেখা গেল খরচ করলাম ২৫ টাকা পেলাম ১ টাকার জিনিষ তাহলে তো সেটি স্বচ্ছতা হলো না।
রেডিও তেহরান: ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বাংলাদেশের রিজার্ভ নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৭