জানুয়ারি ০৭, ২০২৩ ২০:১৫ Asia/Dhaka

নতুন বছরে পা রেখেছে দেশ। কিন্তু গত বিজয়ের মাসে দেখা গেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উত্তাপ এবং অর্থনীতিতে সংকট-এসব প্রায়ই মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া ব্যাংকে নিয়মবহির্ভূত ঋণের বিষয়টিতো আছেই। এসব বিষয়ে আমরা কথা বলেছি সিনিয়র সাংবাদিক, ডেইলি স্টার পত্রিকার বাংলা বিভাগের সম্পাদক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং জনপ্রিয় উপস্থাপক গোলাম মোর্তজার সঙ্গে।

রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট এই সাংবাদিক বললেন, টাকা পাচার কিংবা দুর্নীতি তো করে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। দুর্নীতি করে টাকা আয় করে। ঋণ নেয় কিন্তু টাকা ফেরত দেয় না। আর সেই টাকা তারা পাচার করে দেয়। স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের কিংবা ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের একটা পৃষ্ঠপোষকতা  থাকে। আর সেই কারণে বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ হয় কিন্তু প্রকৃত অর্থে ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

বিশিষ্ট এই সাংবাদিক আরও বলেন, বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পান তার কারণ হচ্ছে আমাদের এখানে রাজনীতিটা স্বাভাবিকভাবে চলে না। যেহেতু একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়না। যেহেতু মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সরকার হস্তক্ষেপ করে। সেই কারণে বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পায়। কিন্তু এখানে মজার বিষয় হচ্ছে বিরোধী দল যখন বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলে তখন সরকার বিরোধী দলকে বলে যে নালিশ করে বালিশ পেয়েছে।

গোলাম মোর্তজা বলেন, সরকারের জবাবদিহিতা দেশের জনগণের কাছে নয়; সরকারের জবাবদিহিতা হয়ে গেছে বিদেশিদের কাছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক একটা বিষয়।

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা আপনি জানেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিএনপির গত ১০ ডিসেম্বরের কর্মসূচি নিয়ে নানা ঘটনা ঘটে গেছে। দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে। আর অর্থনীতিতে একটা বৈরী ভাবের কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। ১০ নভেম্বর তিনটি ইসলামি ব্যাংকে যে নিয়ম বহির্ভূত ঋণ দেয়ার খবর এসেছিল পরে ১০ ডিসেম্বরের ঘটনা দিয়ে সে বিষয়টি কিন্তু  অনেকটা হারিয়ে গেছে। ধোঁয়াশা হয়ে গেছে। তো এই যে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সময়ে সে সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?

গোলাম মোর্তজা: দেখুন, টাকা পাচার কিংবা দুর্নীতি তো করে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্টরা টাকা পাচার করে। দুর্নীতি করে টাকা আয় করে। ঋণ নেয় কিন্তু টাকা ফেরত দেয় না। আর সেই টাকা তারা পাচার করে দেয়। স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের কিংবা ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের একটা পৃষ্ঠপোষকতা  থাকে। আর সেই কারণে বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ হয় কিন্তু প্রকৃত অর্থে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। নিয়মবহির্ভূতভাবে ইসলামি ব্যাংকগুলোতে যেভাবে ঋণ দেয়া হলো সে বিষয়ে সুষ্ঠু ও জোরালোভাবে ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল কিন্তু আমরা দেখেছি ১০ ডিসেম্বরের রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে চাপা পড়ে গেছে। ক্ষমতাসীনরা সবসময় প্রত্যাশা করে একটি বিষয় সামনে আসবে; সেই বিষয়টি কয়েক দিন চললো আরেকটি বিষয় সামনে আসলে আগের বিষয়টিকে ধামাচাপা দিয়ে দেবে। সুতরাং ওইটার তদন্তও করতে হবে না, বিচারও করতে হবে না, টাকা ফেরতও দিতে হবে না। পাচারকারী, দুর্নীতিবাজ ও ঋণখেলাপীরা স্বাভাবিকভাবে যে যার মতো করে থাকতে পারবে। সেইরকম একটি ধারা বাংলাদেশে বহু বছর ধরে চলছে সেটাই আমরা বর্তমান সময়ে আরেকবার তার নজির দেখলাম।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা, বিএনপির গত ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের পর সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি মিশনগুলোতে চিঠি দিয়ে ঐদিনের ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। তো প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ তো একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় নিয়ে বিদেশি মিশনগুলোতে চিঠি দিয়ে জানানোর বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

গোলাম মোর্তজা: দেখুন, বাংলাদেশ বাংলাদেশের মতো করেই পরিচালিত হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশকে পরিচালনা করবে। বিদেশিরা কথা বলবেন কেন বা তারা কথা বলার সুযোগ পাবেন কেন? বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পান তার কারণ হচ্ছে আমাদের এখানে রাজনীতিটা স্বাভাবিকভাবে চলে না। যেহেতু একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়না। যেহেতু মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সরকার হস্তক্ষেপ করে। সেই কারণে বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পায়। কিন্তু এখানে মজার বিষয় হচ্ছে বিরোধী দল যখন বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলে তখন সরকার বিরোধী দলকে বলে যে নালিশ করে বালিশ পেয়েছে।

আবার বিদেশিরা যখন একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে তখন সরকার ক্ষুব্ধ হয় বিদেশিদের ওপর। কিন্তু সরকারের স্ববিরোধীতা এবং দ্বিচারিতা হচ্ছে- সেই সরকারই আবার কেন সে পুলিশি অভিযান চালাল, কেন সে রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করল এসবের কারণ ব্যাখ্যা করে বিদেশিদেরকে চিঠি দিয়ে জানাতে হয়।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা আমরা বলছিলাম দেশের রাজনীতির বিষয়ে বিদেশি মিশনগুলোতে চিঠি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার মানেটা কী?

গোলাম মোর্তজা: তার মানে হচ্ছে, সরকারের জবাবদিহিতা দেশের জনগণের কাছে নয়; সরকারের জবাবদিহিতা হয়ে গেছে বিদেশিদের কাছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক একটা বিষয়। এখানে মূল কথা হচ্ছে- বিদেশিদের জানানো বা বিদেশিদের কথাবলার সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা চাই না। কিন্তু এটা আমরা শুধু চাইলে হবে না। সরকারকে এটা বুঝতে হবে এবং একেবারে উপলব্ধিতে আনতে হবে যে বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে এমন কর্মকাণ্ড থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সভা-সমাবেশ করার অধিকার দিতে হবে। অহেতুক মামলা দিয়ে হয়রানি করা যাবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিপীড়নমূলক আইন দেশে করা যাবে না। আর এইসব কাজ যদি সরকার করে তখন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পায়। যেহেতু আমাদের এখানে সেটা করা হয় না, যেহেতু একটা দমন-পীড়ন চলে সর্বত্র সেই কারণেই বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পায়।

রেডিও তেহরান: গোলাম মোর্তজা, সবশেষে জানতে চাইব  বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ এবং তার আগের বিভাগীয় পর্যায়ের আরও কিছু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আমরা দেখেছি যে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিএনপিকে প্রতিহত করার কথা বলেছিল, প্রতিহত করেও ছিল নানাভাবে। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে বেশ  অস্থিরতা এবং অসহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর কারণ কি? আওয়ামী লীগ তো এখন রাজনৈতিকভাবে যথেস্ট শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।

গোলাম মোর্তজা: দেখুন, বাংলাদেশের সবকিছুই আওয়ামী লীগই নেতৃত্ব দিচ্ছে, আওয়ামী লীগই পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ যেটা পরিচালনা করে সেটি দল আওয়ামী লীগ নয় আওয়ামী লীগ সরকারই পরিচালনা করছে। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ করছে না। গত চৌদ্দ পনের বছরে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ একধরনের স্থবির সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কীভাবে মোকাবেলা করবে সেই জায়গা থেকে তাদের ভেতরে একধরণের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আরেকটি বিষয় গত ১৪/১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ বলে আসছিল বিএনপি নেই, বিএনপি মরে গেছে, বিএনপির নেতা নেই-অমুক নেই-সুমুক নেই ইত্যাদি। আমার ধারণা আওয়ামী লীগের নেতাদের একটা অংশ এই কথা বিশ্বাস করতেও শুরু করেছিল। তারা ভেবেছিল বিএনপির ডাকে মানুষ আসবে না। বিএনপি সম্ভবত নেই। তাদের ডাকে মানুষ সাড়া দেবে না। বিএনপি একটা বড় সমাবেশ করতে পারবে না। ধর্মঘাট ডাকলে ভয়ে আসবে না; গ্রেপ্তার করলে ভয়ে আসবে না। মির্জা ফখরুলকে গ্রেপ্তার করলে কেউ ভয়ে সমাবেশে আসবে না। তারা মির্জা ফখরুলকে গ্রেপ্তার করেছে। সবরকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তারপরও বিএনপিকে দমানো যায়নি। অর্থাৎ নেতারা বিএনপি সম্পর্কে একটা ভুল ধারনা নিয়েছিল। কোনো কিছুতেই বিএনপিকে ঠেকানো গেল না তারসঙ্গে বিদেশিদের একটা চাপ যোগ হলো। সবকিছু মিলিয়ে ক্ষমতায় থাকার পরও আওয়ামী লীগের ভেতরে একধরণের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তবে আমি মনে করিনা যে এই অস্থিরতা বিএনপির জন্য খুব বড় কোনো বেনিফিট বয়ে আনবে না-অন্তত এখন পর্যন্ত। এটা বলার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।

রেডিও তেহরান: তো জনাব গোলাম মোর্তজা বর্তমান সময়ে দেশের একটা চিত্র নিয়ে আলাপনে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ।

গোলাম মোর্তজা: আপনাকেও ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৭

ট্যাগ