জানুয়ারি ১৭, ২০২৩ ১৭:৫৯ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। সপ্তাহ ঘুরে রংধনুর আসর সাজিয়ে তোমাদের মাঝে হাজির হয়েছি যথারীতি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আক্তার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো যে, বর্তমান বিশ্বে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জীবিতরাও উৎকণ্ঠিত- কখন কী হয়! সচেতন মহল তাই এর প্রতিরোধের নানা রকম উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। যদিও পবিত্র কুরআনে এ সংক্রান্ত অপরাধের প্রতিকার নিয়ে একটি পন্থা হলো নির্ধারণ করা আছে। আর সেটি হলো কিসাস। মূলত মৃত্যুর বিনিময়ে মৃত্যু কিংবা কোনো ধরনের জখমের বিনিময়ে অনুরূপ জখমের পরিভাষা হলো কিসাস বা অনুরূপ প্রতিশোধ। ইসলামী অপরাধ আইনের গুরুত্বপূর্ণ এই পরিভাষাটি সরাসরি কুরআন ও হাদিসে ব্যবহৃত হয়েছে।

মাওলানা রুমির বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবীর তৃতীয় খণ্ডে কিসাস সম্পর্কে একটি গল্পটি আছে। আসরের আসরের শুরুতেই সেই গল্পটি শোনানো হবে। গল্পের পর থাকবে একটি গান। আর আর সবশেষে থাকবে একটি। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

হযরত দাউদ (আ.)-এর সময়কার কথা। এক অলস ব্যক্তি বিনাশ্রমে ধন পাওয়ার জন্য দোয়া করছিল আল্লাহর দরবারে। তার দোয়ার ভাষা ছিল এরকম: হে আল্লাহ! মানুস রাতদিন পরিশ্রম করে, রিযিকের সন্ধান করে আর তুমি তাদের রিযিক দাও। কিন্তু আমার মতো একজন পরিশ্রম না করলে কী হয়। আমি অলস। আমি কেবল তোমার দয়া নিয়ে বাঁচতে চাই। আমাকে নিরাশ করোনা হে মাবুদ।"

তার দোয়ার ধরন দেখে মানুষ হাসে। নানা উপদেশ দেয়। কিন্তু কারো কোনো উপদেশে কাজ হয় না। সে পরিশ্রম করবে না। আল্লাহর কাছ থেকে রিযিক পাবে এই তার বিশ্বাস।

একদিন এক লোকের গরু ছুটে গেল খোঁয়াড় থেকে। গরুটি পালিয়ে ঢুকে পড়ে অলসের ঘরে। অলস ভাবল, এটি আল্লাহর দান। দোয়া কবুল হওয়ার প্রমাণ। লোকটি তড়িঘড়ি আল্লাহর নেয়ামতকে বরণ করে নিল এবং গরুটি জবাই করে ফেলে।

কিছুক্ষণ গরুর খোঁজে গরুর মালিক তার বাড়িতে এসে হাজির। সে তার গরুর ক্ষতিপূরণ দাবি করল। শেষ পর্যন্ত ঝগড়া সেই যমানার বাদশাহ আল্লাহর নবী দাউদ (আ)-এর আদালত পর্যন্ত গড়াল।

অলসের কথাবার্তা শুনে দাউদ (আ) ভীষণ রাগ করলেন। কিন্তু আল্লাহর দরবারে তার কান্নাকাটির ধরণ দেখে আদালত মুলতবি করলেন। রাতে নামাযে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন। তিনি আল্লাহর একটি রহস্য জানতে পেরে পরদিন অলস লোকটির পক্ষে রায় দিলেন।

অলসের পক্ষে রায় দেখে গরুর মালিক ও জনগণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ন্যায় বিচারের জন্য দাউদ (আ)-এর খ্যাতি ছিল দুনিয়াজোড়া। অথচ তিনি আজ রায় দিলেন গরুর মালিকের বিরুদ্ধে এবং পরের গরু-খাওয়া অলস লোকটির পক্ষে! রায় শুনে গরুর মালিকের হৈচৈ চিৎকারে জনতাও সমর্থন দিল। 

এতে অবস্থা জটিল হয়ে গেল। পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিল। দাউদ (আ.) দেখলেন, জনগণের মাঝে যে ভুলবুঝারির সূত্রপাত হয়েছে, তা আল্লাহর নবীর প্রতি সন্দেহ জাগাবে, তাদের ঈমানকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেবে। তিনি জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন, ভাইয়েরা! একটি গোপন তথ্য আল্লাহ তাআলা লুকিয়ে রেখেছিলেন, আমি তা ফাঁস না করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এখন দেখছি গরুর মালিক তা ফাঁস না করে ছাড়বে না। চলো সবাই আমার সাথে, সে গোপন তথ্য আমি তোমাদের জানাতে চাই। অমুক প্রান্তরভূমিতে একটি গাছ আছে, রহস্যটি লুকিয়ে আছে সে গাছের কাছে মাটির নিচে। পত্রপল্লবে ঘন সন্নিবিষ্ট গাছ অথচ শিকড় থেকে রক্তের গন্ধ আসে।

বন্ধুরা, অলসের পক্ষে হযরত দাউদ (আ.) কেন রায় দিয়েছিলেন এবার সেই কাহিনিটি জানা যাক।

দাউদ (আ.) লোকজনের উদ্দেশে বললেন: দাবিদার গরুর মালিক ছিল এক মনিবের চাকর। সুযোগ বুঝে সে একদিন মনিবকে হত্যা করে তার গরুর পাল আর সহায় সম্পদ আত্মসাৎ করে লাশটি মাটি চাপা দিয়েছিল। আল্লাহ তো পরম সহনশীল। এই তথ্য তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন আপন সহনশীলতার গুণে। শেষ পর্যন্ত এই লোকের নাফরমানি আর ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই তার তথ্য আমার কাছে ফাঁস করে দিয়েছেন। সে এমন নিষ্ঠুর, মনিবের লাশ গুম করার পর মনিবের পরিবারের কোনো খোঁজ খবর নেয়নি। আপনারা দেখলেন, একটি গরু ছুটে গিয়ে মালিকের নাতির ঘরে ঢুকেছে। তাই কীভাবে আকাশ পাতাল তোলপাড় করেছে। সে তো নিজেই তার পাপের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। নচেত আল্লাহ তার পাপ গোপন করে রেখেছিলেন।

দাউদ (আ.) আরও বললেন: আসলে পাপিষ্টরা তাদের পাপের কথা, অপকর্মের তথ্য নিজেরাই ফাঁস করে দেয়। কারণ তাদের জুলুমই তাদেরকে ফাঁদে ফেলে দেয়। কোনো জালিমকে যদি দেখ যে প্রকাশ্যে বলছে, দেখ আমার কপালে কেমন শিং গজিয়েছে। আমার সাথে লড়বার ক্ষমতা কার আছে। নিশ্চিত জেনে রাখ যে, এই শিং দোযখের আগ্নেয় গরুর। এই দুনিয়াতে সে নিজের অস্তিত্ব জাহির করেছে। জুলুম করে, পাপ করে প্রকাশ্যে বলে বেড়ানোর স্পর্ধা দোযখী হওয়ার লক্ষণ।

মওলানা রুমী (র) পাপিষ্ট লোকদের এই অভ্যাস ও ধৃষ্টতার বরাতে বলছেন যে, আসলে এই দুনিয়াতে থাকতেই তোমার হাত পা বা আচরণ জাহির করে দেয় তোমার ভেতরে কি আছে তার লক্ষণ। আল্লাহ পাক বলেন-

ٱلۡيَوۡمَ نَخۡتِمُ عَلَىٰٓ أَفۡوَٰهِهِمۡ وَتُكَلِّمُنَآ أَيۡدِيهِمۡ وَتَشۡهَدُ أَرۡجُلُهُم بِمَا كَانُواْ يَكۡسِبُونَ

"আজ (কিয়ামতের দিন) আমি পাপীদের মুখ সীলগালা করে দিব এবং তাদের হাতগুলো আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পাগুলো তারা কি কি অর্জন করেছে তার সাক্ষ্য দেবে। (সূরা ইয়াসীন, আয়াত, ৬৫)

মওলানা রুমীর পর্যবেক্ষণে হাত পায়ের এই কথাবলা, সাক্ষ্য দেয়া এই দুনিয়াতেও প্রকাশ পায়। এ কারণে পাপীদের কথাবার্তা আচরণে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাদের চোখে মুখে পাপের প্রতিভাস ফুটে উঠে। তিনি বলেন, সাধারণ অবস্থায় জালিমরা ভদ্র সাজলেও যখন রাগান্বিত হয় বা রাগতস্বরে কথা বলে তখন কথার ফাঁকে তার ভেদের কথা ফাঁস হয়ে পড়ে।

মওলানা বলেন, যে মহান সত্তা এ দুনিয়াতে তোমার কথা ও কাজে তোমার মনের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতে পারেন, ঐ জগতে তোমার গোপন তথ্য ফাঁস করা তো তার পক্ষে একেবারেই সহজ। তুমি চিন্তা করলে বুঝতে পারবে যে, তোমার নফস ও কুপ্রবৃত্তি তোমার মন থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ নির্গত করছে অহরহ, তার মাধ্যমে অবস্থাগত ভাষায় তুমি বলে দিচ্ছ যে, আমি হলাম দোযখী। দেখ আমার আচরণ, শুনো আমার মুখের বচন। ঠিক এ কাজটিই করেছে গরুর মালিক। সে একটি গরুর জন্য কীভাবে উথাল পাতাল করল। অথচ আসামী লোকটির দাদার এক পাল গরু সে লুট করে নিয়েছিল। মনিবকে খুন করার পর আল্লাহর কাছেও অনুশোচনা করে নি; অথবা নিহত লোকটির পরিবারের খোঁজ খবরও নেয় নি। মওলানা বলন, তোমার নফসের চরিত্রও আসলে এরূপ। তুমি তার যতই খাতির তোয়াজ কর সে তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করবে না। তার চরিত্র খুনির মতো। কাজেই খুনি নফসে আম্মারার সাথে তোমার সম্পর্ক ছিন্ন কর।

মওলানা রুমী গরুর মালিকের দায়ের করা মামলার ধারাভাষ্যে ফিরে এসে বলছেন, হযরত দাউদ (আ) লোকজন সাথে নিয়ে যখন প্রান্তর ভূমির সেই বৃক্ষের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, বলে দিলেন যে পেছন থেকে তোমরা বাদীর হাত বেঁধে নাও। তার অপরাধের সাক্ষ্য প্রমাণ আমি উপস্থিত করব। এখানেই তার প্রাপ্য শাস্তি কার্যকর করব।

দাউদ (আ) লোকটিকে বললেন, হে কুকুর স্বভাবের অভিশপ্ত! তুমি যে এত আস্ফালন কর, তোমার আসল পরিচয় হল, তুমি আসামীর দাদার গোলাম। তার দাদাকে হত্যা করে তুমি বড় লোক হয়েছ। সেই তথ্য আল্লাহ ফাঁস করে দিয়েছেন তোমার চরিত্রের কারণে। তোমার বউও ছিল এই জমিদারের কৃতদাসী। কাজেই এই কৃতদাসীর ঘরে জন্ম নেয়া ছেলেমেয়ে সব প্রকৃত মালিক নিহত মনিব এবং তার অবর্তমানে তার বংশধর। তুমিও ছিলে তার গোলাম। গোলামের উপার্জন তো মনিবই ভোগ করবে। তোমার সব সম্পদ তাকে দিয়ে দিতে হবে, এটিই ফায়সালা। শুরুতে শরীয়তের বিচারের জন্য হৈচৈ করেছ। এই নাও শরীয়তের ফায়সালা। মনিবকে যখন হত্যা করছিলে তখন তিনি তোমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল। তোমার নিষ্ঠুরতা সেদিকে কর্ণপাত করেনি। প্রমাণ চাও তো মাটি খনন কর, দেখবে সেখানে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছোরা পুঁতে রাখা হয়েছে। ভয়ের চোটে তুমিই এ কাজ করেছ। পাশে সেই মজলুমের কঙ্কালও পাবে। ঘটনাক্রমে তোমার নামও লেখা আছে সেই ছোরার গায়ে।

লোকেরা মাটি খনন করে দেখল আল্লাহর নবীর কথাই সত্য। উভয় প্রমাণ সেখানে উপস্থিত। তারা দাউদ (আ) এর প্রতি তাদের অন্যায়ের জন্য মাফ চাইল। তার অলৌকিকত্বের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত আলোচনায় আনল। দাউদ (আ) হুকুম দিলেন, এই জালেমকে, গরুর মালিাকানার দাবিদারকে আল্লাহর বিধানে কিসাস কর। হত্যার বদলে তার প্রাণদণ্ড কার্যকর কর।

বন্ধুরা, এই গল্প থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, অন্যায়ভাবে নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীর সন্ধানের স্পৃহা স্বয়ং আল্লাহই মানুষের মনে জাগিয়ে দেন। তাই তারা অনুসন্ধানে নামে এবং কোনো অবস্থাতেই খুন করে লুকানো যায় না, খুনি কখনো নিস্তার পায় না। কোনো না কোনোভাবে তার তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। জালিম গরুর মালিকের প্রাণদণ্ড কার্যকর করাতে একটি প্রাণের অবসান হল, তবে শত হাজারো প্রাণ বেঁচে গেল। সবাই জানল যে, খুনের তথ্য একদিন না একদিন ফাঁস হবেই। খুন করলে কারো নিস্তার নাই। তাতে পুরো দেশ শান্ত হয়ে গেল।

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি গান। গানের কথাগুলোর সাথে আজকের গল্পের দারুণ মিল রয়েছে। গানের কথা লিখেছেন কে এম মুনির হোসাইন, সুর করেছেন গোলাম মাওলা আর গেয়েছে শিশুশিল্পী হুমায়রা আফরিন ইরা। (গান)

হুমায়রা আফরিন ইরার চমৎকার কণ্ঠে শিক্ষণীয় গানটি শুনলে। তো বন্ধুরা, তোমরা ইচ্ছে করলে এ অনুষ্ঠানে গান, কবিতা, সুরা এমনকি গল্পও শোনাতে পারো। আগ্রহী হলে আমাদের কাছে তোমাদের ফোন নাম্বার পাঠিয়ে দাও। আমরাই তোমাদের কাছে ফোন করে তোমাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থা করব।

তো তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে। খোদা হাফেজ।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ