ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৩ ১৯:৫৯ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা হয়তো জানো যে, মানুষের দেহের ওপর শুধু বস্তুর প্রভাব ক্রিয়া করে না; মনের প্রভাবও ক্রিয়া করে। কোনো কারণে কেউ মনোরোগে আক্রান্ত হলে তার শরীরও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে

যারা মনকে অবাস্তব বলতে চায়, মনের ক্ষমতাকে অস্বীকার করতে চায়, তাদের চিন্তার ভ্রান্তি দূর করার জন্য মাওলানা রুমী তার বিখ্যাত গ্রুন্থ মসনবীতে একটি গল্প লিখেছেন। আজকের আসরের শুরুতেই থাকছে 'ওস্তাদের অসুখ' শিরোনামের গল্পটি। গল্পের পর থাকবে বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও গ্রন্থনা ও প্রযোজনা করেছেন সহকর্মী আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

অনেকদিন আগের কথা। তখনকার দিনে ছেলেমেয়েরা মকতবে গুস্তাদের কাছে লেখাপড়া শিখতো। ছাত্ররা সেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ওস্তাদের কাছে লেখাপড়া করতো। তারা নিজ নিজ বাড়ি থেকে খাবার-দাবার সঙ্গে করে নিয়ে আসত। কেবল শুক্রবারই ছিল তাদের ছুটি।

তারা সারাদিনের পড়াশোনা ও গুস্তাদের কড়া শাসনে ক্লান্ত হয়ে পড়ত। তাই শুক্রবার, ঈদের দিন কিংবা অন্যকোন ছুটির দিনের অপেক্ষায় তারা দিন গুণতো। আর পরপর দু'তিন দিন কোনো কারণে মকতব বন্ধ থাকলে তাদের আনন্দ উল্লাসকে দেখে কে!

ওই গ্রামে ছিল দু'টি মকতব। একটির নাম পীরের মকতব এবং দ্বিতীয়টির নাম মোল্লার মকতব। দু'টোতেই গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতো। একদিন ভোরে মোল্লার মকতবের একটি ছেলে মকতবে যাওয়ার পথে দেখল পীরের মকতবের কয়েকটি ছেলে মহল্লার রাস্তায় খেলাধুলা ও ছুটাছুটি করছে। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই তোরা মকতবে যাচ্ছিস না কেন ?

একজন জবাবে বলল: আমাদের ওস্তাদের অসুখ। তাই তিন-চার দিন মকতব বন্ধ থাকবে।

ছেলেটি এরপর চলে এলো তার মকতবে। দু'চারজন বন্ধুর দেখা পেতেই বলল, পীরের মকতব কয়দিনের জন্য বন্ধ থাকবে। ওদের ওস্তাদ নাকি অসুস্থ।

ছেলেমেয়েরা বলে উঠল: ওস্তাদের অসুখ হয়েছে আর তার মকতবের ছাত্ররা এখন মনের আনন্দে খেলাধুলা করছে। কিন্তু আমাদের ওস্তাদজ্বীর তো অসুখ-বিসুখ কিছুই হয় না। একেবারে লোহার শরীর। আরে বাবা, কয়দিন অসুখ হলে এমন কী ক্ষতি হয়ে যায়!  

ছাত্রদের মধ্যে একটি ছিল খুবই চালাক-চতুর আর দুষ্ট। তার নাম রফিক। সে বলল, তোরা যদি আমার কথা শুনিস তাহলে এমন কাজ করব যে, আমরাও কয়েকদিন ছুটি কাটাতে পারবো।

সবাই বলল, আমরা তৈরি। এখন বল্ কি করতে হবে?

রফিক বলল: আমরা সবাই মিলে আমাদের ওস্তাদজ্বীকে অসুস্থ বানাবো। কাল সকালে একে একে ওস্তাদের ঘরের পাশ দিয়ে মকতবে ঢোকার সময় ওস্তাদকে সালাম জানিয়ে বলবি: ওস্তাদের অসুখ মনে হচ্ছে? কি হয়েছে? চেহারা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে? রাতে ঘুম হয়নি নাকি? এমন কৌশলে এসব বলতে হবে যাতে ওস্তাদ কিছুই টের না পায়।

পরদিন কথামতো ছাত্ররা খুব ভোরেই রওয়ানা হয়ে গেলো মকতবের পথে। রফিক সবার আগেই পৌঁছে গেল মকতবে। ওস্তাদের ঘরের পাস দিয়ে যাওয়ার সময় ওস্তাদকে দেখে সালাম জানিয়ে বলল, ওস্তাদজ্বী, আপনার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে মনে হয়। আল্লাহ না করুন, অসুখ-টসুখ করেনিতো?

ওস্তাদ বললেন, নাতো, কিছুই হয়নি। যা পড়তে বস গিয়ে। পণ্ডিতি করতে এসেছিস, না"?

রফিক আবারো সালাম জানিয়ে চলে গেল। এবার ওস্তাদ মনে মনে ভাবতে লাগলেন, রাতে কোনো অসুবিধা হয়েছে নাকি। অসুখ-বিসুখের তো কোনো কিছু ঘটেনি। এরই ভেতর দ্বিতীয় ছেলেটি এগিয়ে এসে সালাম জানালো। এরপর ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, ওস্তাদ, আপনার চেহারা এমন ফ্যাকাশে কেন? শরীরে রক্ত নেই মনে হচ্ছে।

ওস্তাদ বললেন: না না ভালো আছি। যা, ক্লাসে বস গিয়ে।

এবার ওস্তাদ সত্যিই চিন্তা পড়লেন। কিছুই বুঝতে পারলেন না। এসময় তৃতীয় ছেলেটি এসে একই ধরনের প্রশ্ন করলে ওস্তাদ সত্যি সত্যিই ভাবনায় পড়ে গেলেন। সেই সাথে ক্রমশঃ টের পেতে লাগলেন যে তার মাথা ব্যথা মনে হচ্ছে, গা-টাও গরম। এই ভাবনার ভেতর থাকলেও প্রকৃতপক্ষে যেহেতু অসুস্থ নন- সেহেতু ঘরের ভেতর টুকটাক কাজগুলো গুছাতে লাগলেন। এমন সময় প্রবেশ করল চতুর্থ ছাত্র।

'আসসালামু আলাইকুম' বলতেই ওস্তাদ তার দিকে তাকিয়ে 'ওয়া আলাইকুম সালাম' বলে জবাব দিলেন। ছেলেটি দারুণ উৎকণ্ঠার সাথে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, হুযুর, আপনার শরীর এতো খারাপ দেখাচ্ছে কেন? চেহারা যে সাদা হয়ে গেছে। আপনি দয়া করে এতো পরিশ্রম করবেন না। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।

একথা বলেই সে বিদায় নিল। ওস্তাদ এবার সত্যি অসুস্থ বোধ করলেন। মনে হলো- হাওয়া বদলের ফলে তার ঠাণ্ডা লেগেছে। মাথাটা বেশ ব্যথা করছে। শ্বাস- প্রশ্বাসও যেন গরম হচ্ছে। ওস্তাদ ভাবলেন, ছাত্ররা তাকে কতো ভালোবাসে। ওদের কচি চোখে ধরা পড়ল যে, আমার অসুখ। অথচ আমার স্ত্রী মোটেও টের পেল না। আসলে সে বেখেয়াল। স্বামীর প্রতি তার দৃষ্টি নেই।

স্ত্রীকে ডেকে ওস্তাদ বললেন, আমার প্রতি তোমার কোনো খেয়াল আছে? ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা যেখানে চেহারা দেখেই বলে দিচ্ছে আমি অসুস্থ, সেখানে তোমার চোখ কোথায় থাকে শুনি?

স্তাদের কথা শুনে তার স্ত্রী বললেন, 'আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। কই, সেই সাতসকালে তো তুমি ভালোই ছিলে। এরি মাঝে আবার কী ঘটে গেল ?"

ওস্তাদ: হয়েছে, হয়েছে, আর বুঝতে হবে না। যাও, জলদি আমার বিছানা ঠিক করো আর আলমিরা থেকে কম্বল বের করে দাও। ব্যথায় মরে গেলাম।

রোগ যাতনা ও মাথা ব্যথার ব্যাপারে কল্পনা এখন পাকাপোক্ত বিশ্বাসে রূপ নিয়েছে। তাই ওস্তাদ ধীরে ধীরে আহ্ উহ্ শব্দে কাতরানীও শুরু করলেন। ওস্তাদ সত্যি সত্যিই শয্যাশায়ী হলেন।

মকতবের ছেলেরা সতর্কতার সাথে সব খবরই রাখছিল। ওস্তাদ বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছেন- এমন খবর পেয়ে ক্লাসের সেরা দুষ্টু ছেলে রফিক ওস্তাদের ঘরের দরজায় এসে বলল: হুযুর, আসতে পারি?

ওস্তাদের ইশারায় সে ঘরে প্রবেশ করল এবং বিছানার কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে বলল: হুযুর, আপনি তো অসুস্থ। আমরা কি তাহলে এখানে এসেই পড়াশোনা করব?

ওস্তাদ বললেন: ঠিক আছে, এখানেই পাটি বিছিয়ে পড়াশোনা কর্‌।

ওস্তাদের অনুমতি পেয়ে সবাই যার যার বইপত্র নিয়ে বসে গেল আর গুন গুন করে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পর রফিকের ইশারায় সবাই জোরে জোরে পড়া শুরু করল।

কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই রফিক ওস্তাদের কানে পৌঁছে এমন শব্দে ছেলেদের লক্ষ্য করে বলল: এই ছেলেরা, তোরা আস্তে আস্তে পড়। বরং কয়েক ঘন্টা একেবারে চুপ থাক। এসব আওয়াজ হুযুরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মাথা ব্যথা এতে আরো বেড়ে যায়। রোগীর জন্য নীরব স্থান দরকার।

ওস্তাদ রফিকের কথা খুব পছন্দ করলেন এবং বললেন, সে ঠিকই বলেছে। তোরা বরং আজ চলে যা। আমার অবস্থা ভালো নয়। দেখি কাল কী করা যায়।

ছেলেরা ওঠে দাঁড়িয়ে বলল: জ্বী হুযুর! আমরা যাই, আল্লাহ আপনাকে তাড়াতাড়ি ভাল করে দিন। আপনার এখন অনেক বিশ্রাম দরকার। খোদা হাফেজ।

সবাই ওস্তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো এবং কিছুদূর গিয়েই দে ছুট। ওদের আনন্দ উল্লাস আর কে দেখে। ছুটাছুটি দৌড়াদৌড়ি করে ছেলেরা বইপত্র নিয়ে যার যার ঘরে ফিরতেই মায়েরা জিজ্ঞেস করল- কি হয়েছে তোদের? এতো তাড়াতাড়ি যে ফিরে এলি?

ছেলেরা জবাব দিল: হুযুরের অসুখ। মকতব বন্ধ করে দিয়েছেন। কোনো কোনো মা ছেলেদের কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না। তারা আশঙ্কা করলেন: ছেলেরা নিশ্চয় মকতব থেকে পালিয়েছে।

ছেলেরা মাদের মনোভাব বুঝে বলল: আমাদের কথা বিশ্বাস না হয় গিয়ে দেখুন হুযুর অসুস্থ কিনা।

এদিকে, ওস্তাদের পাড়া পড়শীদের কয়েকজন মহিলা ওস্তাদের অসুস্থ হওয়ার খবর জেনে তাকে দেখতে গেলেন। কেউ কেউ গেলেন ছেলেদের কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। গিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যি ওস্তাদ অসুস্থ। একেবারে বিছানা নিয়েছেন এবং ব্যথা বেদনায় কারাচ্ছেন। মায়েরা ওস্তাদের হাল অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। তাদের ভেতর দুষ্ট ছেলে রফিকের মাও ছিলেন। তিনি ওস্তাদকে বললেন, আমার স্বামী তো চিকিৎসক। তিনি এখন বাড়িতেই আছেন। তাকে বলবো আপনাকে দেখে যেন ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করেন।

চিকিৎসক এসে ওস্তাদের অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। হাতের শিরা, জিহবা, গলা ও হৃদ স্পন্দন পরীক্ষা করে রোগের কোনো লক্ষণই খুঁজে পেলেন না। তিনি ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনার হয়েছেটা কি?

ওস্তাদ বলেন: মাথা খুব ব্যথা করছে। শরীরটা অবশ হয়ে গেছে। আমার অবস্থা মোটেও ভালো না। কিছু একটা করুন। অন্ততঃ মাথা ব্যথাটা যেন চলে যায়।

চিকিৎসক তো আর মানুষের ভেতরের কথা বুঝতে পারে না। তাকে রোগী যা বলে তাই বিশ্বাস করতে হয়। রোগী নিজে যদি চিকিৎসকের কাছে মিথ্যা বলে চিকিৎসক তা ধরবে কেমন করে! ওস্তাদের কথা শুনেও চিকিৎসক বিশ্বাস করলেন। ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন। মাথা ব্যথার ক্যাপসুল দিতে ভুল করলেন না।

বাজার থেকে ওষুধ আসার পর ওস্তাদ নিয়ম মতো খাওয়া শুরু করলেন। কিন্তু তিনি যেহেতু অসুস্থ ছিলেন না ঐ ওষুধ তার জন্যে ক্ষতিকারক ছিল। ওষুধ তো রোগীর জন্য, সুস্থ লোকের জন্য নয়। সুস্থ লোক ওষুধ খেলে তার ক্ষতি হবেই। এছাড়া চিকিৎসকের কথা মতো অনেক খাবার-দাবারও ওস্তাদের জন্য নিষেধ হয়ে গেল। এতে করে ওস্তাদ সত্যি সত্যিই অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়লেন। কয়েকদিন তাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হলো। অবশেষে বিশ্রাম গ্রহণ ও ভালো চিকিৎসার পর তিনি আরোগ্য হলেন। এদিকে ছেলেরাও কয়েকদিন এক নাগাড়ে খেলাধুলা ও ছুটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ওস্তাদও মকতব খুলে ছেলেদের ডেকে পাঠালেন।

এদিকে গত কয়দিন যাবত ছেলেরা তাদের গ্রামের পীরের মকতবের ছেলেদের কাছে নিজেদের বুদ্ধি ও কায়দা-কৌশল জাহির করার জন্য কথায় কথায় জানিয়ে দিল যে, তাদের ওস্তাদ অসুস্থ ছিলেন না, তারাই তাকে অসুস্থ বানিয়েছে ইত্যাদি। বিষয়টি কানাঘুষা হয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেল ওস্তাদের ঘরে তার স্ত্রীর কানে। স্ত্রী বেচারী স্বামীকে জানালেন বিষয়টি। এবার ওস্তাদের টনক নড়ল। তিনিও বুঝতে পারলেন তার অসুস্থ হওয়ার আসল রহস্য। কিন্তু বিষয়টি ওস্তাদ একেবারেই চেপে গেলেন। এরপর কোনোদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেও মকতব বন্ধ করতেন না। মকতব খোলা থাকতো। বেশি অসুবিধা হলে আরেকজন ওস্তাদ ডেকে এনে ক্লাস চালু রাখতেন। ছেলেদের দুষ্ট বুদ্ধি তাদের ক্ষতিই ডেকে আনল। ওস্তাদকে ফাঁকি দেয়ার মজা তারা হাড়ে হাড়ে টের পেল।

 বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুকে।

আদিবা রিজওয়ানা

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৮

ট্যাগ