জুন ০৩, ২০২৩ ১৯:৪৩ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা সূরা ওয়াকিয়ার ৫৬ নম্বর পর্যন্ত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ৫৭ থেকে ৭৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব।  প্রথমেই সূরা ওয়াকিয়ার ৫৭ থেকে ৬২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

نَحْنُ خَلَقْنَاكُمْ فَلَوْلَا تُصَدِّقُونَ (57) أَفَرَأَيْتُمْ مَا تُمْنُونَ (58) أَأَنْتُمْ تَخْلُقُونَهُ أَمْ نَحْنُ الْخَالِقُونَ (59) نَحْنُ قَدَّرْنَا بَيْنَكُمُ الْمَوْتَ وَمَا نَحْنُ بِمَسْبُوقِينَ (60) عَلَى أَنْ نُبَدِّلَ أَمْثَالَكُمْ وَنُنْشِئَكُمْ فِي مَا لَا تَعْلَمُونَ (61) وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ النَّشْأَةَ الْأُولَى فَلَوْلَا تَذَكَّرُونَ (62)

“আমিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি: তাহলে কেন তোমরা তা বিশ্বাস করছ না?” (৫৬:৫৭)

“তোমরা [বীর্য আকারে] যা নিক্ষেপ করো সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছো কি?”৫৬:৫৮)

“তোমরা [তাকে মানুষরূপে] সৃষ্টি করো? নাকি তার সৃষ্টিকর্তা আমিই?”৫৬:৫৯)

“আমি তোমাদের মধ্যে মৃত্যু নির্ধারণ করেছি এবং কখনও কেউ আমার [ক্ষমতাকে] অতিক্রম করতে পারেনি।”৫৬:৬০)

“তোমাদের স্থানে তোমাদের সদৃশ আনয়ন করতে এবং তোমাদেরকে এমন জগতে আবির্ভূত করতে যা তোমরা জান না।”৫৬:৬১)

“তোমরা তোমাদের প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে অবশ্যই জানো তাহলে (আল্লাহ যে তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম এ কথা) কেন অনুধাবন কর না?”৫৬:৬২)

আগের আয়াতগুলোতে কিয়ামত অস্বীকারকারীদের কথা বলা হয়েছিল। এরপর এই আয়াতগুলোতে কিয়ামত সংগঠিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে: তোমরা কি তোমাদের সৃষ্টিতে আল্লাহর ক্ষমতা দেখতে পাওনি? যে আল্লাহ তোমাদেরকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে আবার সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি কেন আরেকবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করতে পারবেন না? তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে তোমরা কী চিন্তাভাবনা করেছো? তাদেরকে কি তোমরা সৃষ্টি করেছো? তোমরা তো শুধু তোমাদের স্ত্রীদের গর্ভের শুক্র স্থাপন করো। কিন্তু এরপর নয় মাসে গর্ভের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন হয় তা তোমাদের জানা নেই। এক বিন্দু শুক্রাণু দিয়ে একজন পরিপূর্ণ মানুষ বানানোর ঘটনায় তোমাদের কি কোনো হাত আছে? অন্যদিকে তোমাদের কেউ কি এখন পর্যন্ত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পেরেছে? তাহলে পৃথিবীতে আগমন যখন তোমাদের হাতে নেই এবং চলে যাওয়াও যখন তোমাদের ইচ্ছাতে ঘটবে না তখন কীভাবে তোমরা মৃত্যুর পর আরেকবার জীবিত হওয়ার ঘটনায় সন্দেহ করো?

এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- আল্লাহ ও পরকালে অস্বীকারকারীদের সামনে যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরলে সেগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে এসব মানুষ সত্যকে খুঁজে পাবে।

২- জীবন-মৃত্যুর ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। আল্লাহ তায়ালাই মানুষকে জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। আর এতে তাঁর অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

৩- কারো পক্ষে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণে মৃত্যুর ফেরেশতা এসে হাজির হবে।

এবারে সূরা ওয়াকিয়াহর ৬৩ থেকে ৬৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَحْرُثُونَ (63) أَأَنْتُمْ تَزْرَعُونَهُ أَمْ نَحْنُ الزَّارِعُونَ (64) لَوْ نَشَاءُ لَجَعَلْنَاهُ حُطَامًا فَظَلْتُمْ تَفَكَّهُونَ (65) إِنَّا لَمُغْرَمُونَ (66) بَلْ نَحْنُ مَحْرُومُونَ (67)

“তোমরা [কৃষিজমিতে] যে বীজ বপন করো সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছো কি?” ৫৬:৬৩)

“তোমরা কি সেটাকে অংকুরিত কর, না আমিই অংকুরণকারী?”(৫৬:৬৪)

“আমি ইচ্ছা করলে একে খড়-কুটায় পরিণত করতে পারি, তখন তোমরা হতবুদ্ধি হয়ে বলবে:”(৫৬:৬৫)

“আমাদের তো সর্বনাশ হয়ে গেছে।”(৫৬:৬৬)

“বরং আমরা হৃত-সর্বস্ব হয়ে পড়েছি।”(৫৬:৬৭)

প্রকৃতিতে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার আরেকটি উদাহরণ পেশ করে এখানে বলা হয়েছে: মাটি থেকে যেকোনো গাছ ও ফসলের চারা গজানোতে কি তোমাদের কোনো হাত আছে? তোমরা আল্লাহর সৃষ্ট মাটিতে তারই সৃষ্ট বীজ বপন করে তাতে আল্লাহরই দেওয়া পানি ঢেলে দাও। এরপর এই বীজতলার ওপর আল্লাহর দেওয়া সূর্যালোক নিক্ষিপ্ত হয় এবং তারই দেওয়া বাতাস সেখানে প্রবাহিত হয়। এতকিছুর সমন্বয় ঘটার পর বীজ থেকে চারা গজায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষ শুধু সামান্য পরিশ্রমই করতে পারে কিন্তু বীজ থেকে চারা গজানোর গোটা প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায় আল্লাহর দয়ার ওপর নির্ভরশীল। পরিশ্রমও তো আল্লাহর দেওয়া দৈহিক শক্তি। আল্লাহ তায়ালা যদি এতসব উপাদানের যেকোনো একটি কেড়ে নেন তাহলে বীজতলা মরে শুকিয়ে যাবে। তখন কি তোমরা সেটাকে আবার জীবিত করতে পারবে?

এই আয়াতগুলো থেকে আমরা যেসব শিক্ষা পাই সেগুলো হচ্ছে:

১- পৃথিবীতে যেমন ছোট একটি মৃত বীজ দিয়ে একটি জীবিত চারাগাছ জন্ম নেয় তেমনি কিয়ামতের দিনও মানুষের এক টুকরো দেহাবশেষ দিয়ে তাকে আবার জীবিত করা সম্ভব হবে এবং এ কাজ করবেন মহাশক্তিধর আল্লাহ।

২- মানুষ কখনও মাটিতে বীজ বপন করে আবার কখনও গর্ভাশয়ে শুক্রাণু স্থাপন করে। কিন্তু মাটি থেকে চারাগাছ উৎপাদন কিংবা মায়ের গর্ভে শিশুর জন্ম শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালাই দিতে পারেন। এখানে মানুষের বিন্দুমাত্র হাত নেই।

এবারে সূরা ওয়াকিয়াহর ৬৮ থেকে ৭৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

أَفَرَأَيْتُمُ الْمَاءَ الَّذِي تَشْرَبُونَ (68) أَأَنْتُمْ أَنْزَلْتُمُوهُ مِنَ الْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُونَ (69) لَوْ نَشَاءُ جَعَلْنَاهُ أُجَاجًا فَلَوْلَا تَشْكُرُونَ (70) أَفَرَأَيْتُمُ النَّارَ الَّتِي تُورُونَ (71) أَأَنْتُمْ أَنْشَأْتُمْ شَجَرَتَهَا أَمْ نَحْنُ الْمُنْشِئُونَ (72) نَحْنُ جَعَلْنَاهَا تَذْكِرَةً وَمَتَاعًا لِلْمُقْوِينَ (73) فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيمِ (74)

“তোমরা যে পানি পান কর, সে সম্পর্কে তোমরা চিন্তা করেছ কি?” ”(৫৬:৬৮)

“তোমরা কি সেটা বৃষ্টিভরা মেঘ হতে নামিয়ে আনো, না আমিই সেটা বর্ষণ করি?””(৫৬:৬৯)

“আমি ইচ্ছে করলে তা লবণাক্ত করে দিতে পারি। তবুও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর না?””(৫৬:৭০)

“তোমরা যে আগুন জ্বালাও, তা লক্ষ্য করে দেখেছ কি?””(৫৬:৭১)

“তোমরাই কি ওর বৃক্ষ সৃষ্টি কর, না আমিই সৃষ্টিকর্তা?””(৫৬:৭২)

“আমি তাকে করেছি স্মারক (যা জাহান্নামের আগুনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়) আর পথচারীদের জন্য দরকারী ও আরামের বস্তু।””(৫৬:৭৩)

“কাজেই আপনি আপনার মহান রবের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন।””(৫৬:৭৪)

এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে: সাগর-মহাসাগর থেকে মেঘের উৎপাদন এবং তা ভূপৃষ্ঠের দিকে বয়ে এনে বৃষ্টিবর্ষণ করার কাজে মানুষের কি কোনো হাত আছে? যদি কোনো অঞ্চলে কয়েক বছর বৃষ্টি না হয় তাহলে কী ঘটবে? তোমরা নিজেরা যেমন তৃষ্ণায় মারা যাবে তেমনি গাছপালা ও গবাদি পশু সবকিছুর মৃত্যু ঘটবে। অথবা যদি বৃষ্টির পানি সাগরের পানির মতো লবণাক্ত হয় তখন তোমরা কী করবে? যদি গাছপালা না থাকে তাহলে তোমরা আগুন জ্বালানোর প্রয়োজনীয় জ্বালানী পাবে না এবং আগুন দ্বারা যত প্রকার উপকার পেয়ে থাকো তার সবগুলো থেকে বঞ্চিত হবে। আর এই আগুন দেখে তোমরা জাহান্নামের আগুনের কথা স্মরণ করবে।

এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- মাটি, পানি, বাতাস ও আগুন এই চারটি উপাদান আল্লাহর ইচ্ছাধীন এবং এগুলো আল্লাহকে চেনা ও তাঁর ক্ষমতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।

২- সাগর থেকে মেঘের উৎপাদন ও তা থেকে বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে সকল প্রাণীর বেঁচে থাকার মধ্যে মানুষের জন্য রয়েছে শিক্ষা এবং এ কারণে মানুষের আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।

৩- মাটি ও পানি থেকে তৈরি গাছের কাঠ আগুন তৈরিতে কাজে লাগে। এই আগুন মানুষকে উষ্ণতা প্রদান করে। আর এতে ফুটে ওঠে আল্লাহর নিদর্শন।

৪- আমরা তসবিহ পাঠ বা আল্লাহ মহীমা ঘোষণা করার মাধ্যমে তাঁকে সব ধরনের অক্ষমতার ঊর্ধ্বে বলে মনে করি। সেইসঙ্গে কিয়ামত সংঘটিত করার ঐশী ক্ষমতার ব্যাপারে সব সংশয়-সন্দেহ মন থেকে ঝেড়ে ফেলি।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  #

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

ট্যাগ