নভেম্বর ১৮, ২০২৩ ২০:৪৮ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে বসে আমাদের অনুষ্ঠান শুনছো- সবাই ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই 'লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু' এবং অতি লোভে তাঁতি নষ্ট- এই প্রবাদ দুটি শুনেছো। এই প্রবাদ দুটির মধ্যে লোভের ফল ও এর পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও অনেক মানুষ লোভ-লালসার কাছে নিজেকে বন্দি করে ফেলে। একজন লোভী ব্যক্তি সমাজের জন্য দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "তোমরা লোভ থেকে বিরত থাকো, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনেকেই লোভের কারণে ধ্বংস হয়েছে।"

একই বিষয়ে আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন, "লোভ পরিহার করো। কেননা লোভী ব্যক্তি অপমানের হাতে বন্দী। তার এ বন্দীদশা কখনও শেষ হবে না।" তিনি আরো বলেন, "লোভ আত্মাকে অপবিত্র করে, ধর্মকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে এবং যৌবনকে ধ্বংস করে।"

অন্যদিকে, ইমাম বাকের (আ.) লোভী ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন, "দুনিয়ার লোভী লোকের  উদাহরণ রেশম গুটির মতো। সে যতই তার চারিদিকে রেশম সুতা জড়াতে থাকে ততই নিজে বন্দি হয়ে পড়ে এবং এভাবেই তার মৃত্যু ঘটে।"

বন্ধুরা! লোভের পরিণতি সম্পর্কে কয়েকটি মূল্যবান বাণী শুনলে। আজকের আসরে আমরা এ সম্পর্কে দুটি গল্প শোনাব। আর গল্প শেষে থাকবে একটি  গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্প শোনা যাক।

তিন লোভী বন্ধু ও হজরত ঈসা (আ.)

বন্ধুরা, আজকের প্রথম গল্পটি হজরত ঈসা (আ)-এর জামানার। একদিন তিন বন্ধু একসাথে দূরে কোথাও হেঁটে যাচ্ছিল। এরা বেশ দুষ্ট প্রকৃতির ছিল। হাঁটতে হাঁটতে তারা এক স্থানে এসে থমকে দাঁড়াল। রাস্তার ওপর পিন্ডের মতো একটা বস্তুর ওপর তাদের চোখে পড়ল। সূর্যের আলো পড়ে পিণ্ডটি চিকচিক করছিল।

পিণ্ডটি দেখে তিনজনই বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠল। তারা পিণ্ডটির কাছে আসতেই বিস্মিত হলো। এ যে স্বর্ণপিণ্ড। তাই তাদের খুশি আর কে দেখে! একেবারে চকচকে সোনার পিণ্ড হাতে পেয়ে বন্ধু তিনজন নেচে উঠল।

বন্ধু তিনজন ছিল অতিশয় লোভী। তাই স্বর্ণপিণ্ড পাবার পর তিনজনই মনে মনে দুরভিসন্ধি আঁটতে লাগল। এরা সবাই স্বর্ণপিণ্ডটি একাই আত্মসাৎ করার ফন্দি আঁটছিল। তবে কেউ কারো কাছে তার এ গোপন ইচ্ছা প্রকাশ করল না। বন্ধু তিনজন সামনে পথ চলতে লাগল। অনেক দূর পথ চলতে চলতে এক সময় তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ইতোমধ্যে তাদের প্রচন্ড খিদেও পেল।

এদের একজন তো বলেই বসল, ‘ভাই। আর হাঁটতে পারছিনে। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। একটু থাম, পেটে কিছু দানাপানি দিয়ে নিই।

এরপর দুই বন্ধু আরেকজনকে বলল, ‘ঠিকই বলেছ ভাই। খিদের চোটে আমাদেরও পেট জ্বলে যাচ্ছে। ঠিক আছে তুমি এখানে বস। সোনার পিণ্ডটা তোমার কাছে যত করে রাখ। আমরা দু’জন বরং খাবার খুঁজে দেখি। আশা করি, ধারে কাছে কোথাও হয়তো খাবার পেয়ে যাবো।

এ কথা বলেই দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়ল। অনেক দূর পথ হাঁটল তারা। হাঁটতে হাঁটতে খানিক দূরে গিয়ে এক বাজারের সন্ধান পেল তারা। ওরা সেখানে খাবার কিনছিল আর নিজেরা স্বর্ণপিণ্ড পাবার জন্য ফন্দি আঁটছিল।

একজন বলল, ‘চল, আমরা খাবারে বিষ মিশিয়ে নেই। ফিরে গিয়ে বন্ধুটিকে বলব, আমরা খাবার খেয়ে এসেছি। তুমি এ খাবার খেয়ে নাও, বন্ধু। বিষ মেশানো খাওয়ার সাথে সাথে মারা যাবে। তারপর আমরা দামি সোনার পিণ্ডটি দু’জনে সমান সমান ভাগ করে নেবো।

যেই ফন্দি সেই কাজ। বিষ মেশানো খাবার নিয়ে এরা বন্ধুর নিকট ফিরে এলো। এ দিকে তৃতীয় বন্ধুও এতক্ষণ বসে বসে একই কথা ভাবছিল। কিভাবে সোনার পিণ্ডটি হাত করা যায়- এটা নিয়ে সেও নানা বুদ্ধি আঁটছিল। বন্ধুরা ফিরে আসার ফাঁকে সে ফন্দি ঠিক করে ফেলল। সে তার বন্ধু দু’জনকেই মেরে ফেলার কৌশল ঠিক করল।

ততক্ষণে বন্ধুরা খাবার নিয়ে ফিরে এলো। এসেই তারা বলল, ‘আরে বন্ধু, খুব যে দেরি হয়ে গেল। খিদেয় খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? গরম গরম খাবার এনেছি। এই নাও হালুয়া রুটি। নাও নাও, পেট ভরে তা খেয়ে নাও।

বন্ধুদের কথা শেষ হতে না হতেই তৃতীয় বন্ধুটি পকেট থেকে একটি বিষাক্ত চাকু বের করল। কিছু একটা বোঝার আগেই সে চাকুটি একে একে বন্ধুদের পেটে বসিয়ে দিল। বিষাক্ত চাকুর আঘাতে সে বন্ধুদের কাবু করে ফেলল। দু’জনই ঝটপট মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। দেখতে দেখতে ক্ষণিকের মধ্যেই মারা গেল দুই বন্ধু।

এবার তৃতীয় বন্ধুটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আহা! কী খাঁটি সোনারে, বলতে বলতে সে সোনার পিণ্ডে চুমু খেতে লাগল। এদিকে খিদের জ্বালায় ওর পেটও যে জ্বলছিল। বন্ধুরা খাবার এনেছে। তাই বন্ধুদের আনা হালুয়া রুটি সে গপাগপ খেয়ে ফেলল।

রুটি খেতে দেরি কিন্তু খাবারের বিষের কামড় তার দেহে আক্রমণ করতে দেরি হলো না। নিমেষেই তার সারা শরীর বিষের আক্রমণে নীল হয়ে গেল। দেখতে দেখতে তার দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা গেল। তৃতীয় বন্ধুর নিথর দেহও পড়ে রইল মৃত বন্ধুদের পাশে। আর স্বর্ণপিণ্ডটিও মৃত দেহের পাশেই পড়ে রইল।

সেই পথ দিয়েই কোথাও হেঁটে যাচ্ছিলেন হজরত ঈসা (আ)। তিন তিনটে লাশ ও স্বর্ণের পিণ্ড তাঁর চোখে পড়ল। হজরত ঈসা (আ) ঘটনা দেখে অবাক হলেন। লোকগুলোর কাণ্ড দেখে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এবার তিনি তাঁর সঙ্গীদের বললেন, দেখলে তোমরা, লোভের করুণ পরিণতি? তিন তিনটে লোভী লোক মরে পড়ে আছে। খুব দুঃখ হচ্ছে এদের লোভ দেখে। অথচ স্বর্ণখণ্ড এদের কারো ভাগ্যেই জুটল না। কী হতভাগাই না এরা?

লোভী কৃষক

বন্ধুরা, লোভের পরিণতি সম্পর্কে এখন আরেকটি গল্প শোনাব। বহু আগে এক গ্রামে তিন ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে বাস করত এক গরীব কৃষক। সে যেমনি ছিল অলস তেমনি লোভী। সে ধীরে ধীরে জমি চাষ করে সবার শেষে বীজ বুনত আর ফসল লাগাত। ধানের চারা রোপনের সময় অনেক কাছা কাছি এবং প্রতি গোছে বেশি বেশি চারা রোপন করে ভাবত অন্যদের ক্ষেতের তুলনায় তার জমিতে বেশি ফসল ফলবে আর তার পরিবারে অভাব চলে যাবে।

কিন্তু ফসল লাগানোর পর সে কখনো আগাছা পরিষ্কার করতো না। অলস কৃষক প্রতি বছর শেষে ফসল লাগানোর কারনে ঝড় বন্যায় তার ফসল মাঝে মাঝে নষ্ট হয়ে যেতো। আর প্রতি গোছে বেশি চারা রোপন করার কারণে খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ফসল ঝরে যেতো। এ জন্য বছরের পর বছর গেলেও তার অবস্থার পরিবর্তন হতো না। কৃষকের স্ত্রী সর্বদা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে তার পরিবারের অবস্থা পরিবর্তনের সাহায্য চাইতো।

একদিন স্ত্রী স্বপ্নে দেখল গুপ্তধন তাকে এসে বলছে তোর স্বামীকে কাল সমস্ত জমি চাষ করে আসতে বলবি, শেষ মাটিটায় কোপ দিলে স্বর্ণ মোহর পাবে। তোর পরিবারে আর কোন অভাব থাকবে না তবে, তোর স্বামীকে আগে হতে বলতে পারবি না যে সে আজ গুপ্তধন পেতে যাচ্ছে।

ঘুম ভেঙে গেলে কৃষকের স্ত্রী তাকে বুঝিয়ে অনেক অনুরোধ করে বলল: তুমি আজ সম্পূর্ণ জমি চাষ করে ফিরবে। কৃষক রাজি হলো কিন্তু কাজ করতে করতে যখন কাজ শেষের দিকে তখন কষ্টে তার স্ত্রীকে অনেক গালিগালাজ করতে করতে কাজ শেষ না করেই বাড়ি ফিরে এলো।

স্ত্রী সবকিছু জেনে খুব দুঃখ পেল। এ ঘটনার বহুদিন পর স্ত্রী আবার স্বপ্নে দেখল যে, গুপ্তধন তাকে বলছে তোর মত একজন ভালো মানুষ এমন অলস কৃষকের ঘরে থাকে এতে আমার কষ্ট হয়। তুই তোর স্বামীকে বলিস আজ মাঠে কাজ করতে গেলে সে গুপ্তধন পাবে কিন্তু সে যেন দশটির বেশি মোহর না আনে। এভাবে প্রতিদিন কাজে যাবে আর দশটি করে মোহর আনবে, তবে সাবধান দশটির বেশি মোহর আনলে কিন্ত ভালো হবে না।

স্বপ্নের মতো সবকিছুই হলো। কিন্তু যখন কৃষক মোহরের খনি দেখল ইচ্ছা মতো লুঙ্গি-গেঙ্গির মধ্যে যতগুলো সম্ভব সব নিতে নিতে বলল: আমার বউ একজন বোকা, কোন মানুষকে যদি সৃষ্টিকর্তা এমনিভাবে মোহর উজাড় করে দেয় আর মানুষ সেগুলো ফেলে যায় তার মতো অভাগা, নির্বোধ আর অলস কেউ নাই।

এসব কথা বলতে বলতে সে ইচ্ছামতো মোহর আনলো আর বাড়িতে ঢুকতেই সবাই কে ডেকে বলল: এই দেখো কী এনেছি, আমাদের দুঃখের দিন শেষ।

এই বলে সবার সামনে ঘরের মেঝেতে মোহর ঢালতেই সব ছাই হয়ে গেল। তখন কৃষক 'হায়, হায়' করে মাথা চাপড়ে কাঁদতে লাগল। এসময় তার স্ত্রী তাকে বলল: তোমার লোভের কারণে আমাদের ভাগ্য কোনদিন পরিবর্তন হবে না।

তার পর থেকে কৃষক মোহরের লোভে নিয়মিত জমি খুড়তে যেতো। এভাবে জমির মাটি একেবারে ঝুরঝুরা হয়ে গেল। এরই মধ্যে আবার ফসল লাগানোর সময় এলে কৃষক ফসল লাগাল। কিন্তু সে মোহরের মায়া ভুলতে না পেরে ফসলের জমিতে নিয়মিত হাতড়ে যেতো। এভাবে কৃষকের অজান্তে আগাছাগুলো পরিষ্কার হয় এবং সে বছর খুব ভালো ফসল হয়। এখন কৃষক স্বপরিবারে সারা বছর জমানো ধানের খাবার খেতে পারে।

বন্ধুরা, এই গল্পের শিক্ষণীয় বিষয় হলো- অলসতা ত্যাগ করে পরিশ্রম করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। আর লোভ মানুষের ভাগ্যকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়।

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি উপদেশমূলক গান। গানের কথা লিখেছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক, সুর করেছেন, মশিউর রহমান আর গেয়েছে ঢাকার অনুপম সাংস্কৃতিক সংসদের শিশুশিল্পী সিয়াম, নাইম, মাইসুন, নাহিয়ান, ওলী, সাফওয়ানা, মাইমুনা, আফরিনা, রাইসা, তাসনিম ও ফাইজা।  

ঢাকার একঝাঁক ছোট্টবন্ধুর কণ্ঠে গানটি শুনলে, আশা করি ভালো লেগেছে। তো বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে।

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ