'পাকিস্তানে নির্বাচন: এভাবেই হয়তো এক দু বছর চলবে'
'ইমরান খানকে ছাড়া কোনো সরকারই ভালোভাবে দেশ চালাতে পারবে না'
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে কথা বলব। পাকিস্তানে গতমাসে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিকে ইনসাফ পাকিস্তান বা পিটিআই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ বা পিএমএল-এন ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপি এক সমঝোতার মাধ্যমে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপি’র উপ প্রধান আসিফ আলী জারদারি দ্বিতীয় মেয়াদে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ৪১১ ভোট পেয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশন।
তো পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামস'র সঙ্গে।
জনাব,অব.ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামস, রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
রেডিও তেহরান: জনাব, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামস, পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। অনেক ঘটনার পরেও নির্বাচনে ইমরান খানের পিটিআই দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। কীভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামস: দেখুন, পাকিস্তানের এবারের নির্বাচনটা আমি মনিটর করেছি। বিভিন্নভাবে দেখেছি এবং শুনেছি। সেনাবাহিনীর যে উদ্দেশ্য এবং আধিপত্য সেটি ইমরান খান মেনে নিতে চায় না বলেই তো ইমরান খানের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব। ফলে ইমরান খান বা তার দল বেশি সংখ্যক আসন পেয়েও ক্ষমতায় যেতে পারল না। তো এভাবেই হয়তো এক দু বছর চলবে। কিন্তু ইমরানকে ছাড়া বা তার দলকে ছাড়া যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা ভালোমতো দেশ চালাতে পারবে না।
রেডিও তেহরান: অভিযোগ আছে- এই নির্বাচনে ইমরান খান সমর্থিত প্রার্থীরা যাতে সরকার গঠন করতে না পারেন সেজন্য বিশেষ কৌশল করা হয়েছে। আর এর পেছনে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর হাত রয়েছে, বাইরের বিশেষ শক্তিরও হাত আছে বলে অভিযোগ। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামস: আমি শতভাগ বিশ্বাস করি একথা। শুরু থেকেই ইমরান খান এবং তার দলের বিরুদ্ধে বহুভাবে অন্যায় অত্যাচার করা হয়েছে। আমি যতটা পড়াশুনা করেছি বা দেখেছি তাতে ইমরানের বিরুদ্ধে বা তার দলের বিরুদ্ধে যা হয়েছে বা হচ্ছে এমনটি আমি অন্তত দেখিনি। যে মানুষটির দেশের প্রতি এত ভালোবাসা কেবলমাত্র ব্যক্তি স্বার্থের কারণে সেই মানুষটিকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে এমনটি পৃথিবীর আর কোথায় হবে কি না সন্দেহ রয়েছে!
যা বলছিলাম সবাই এ কথা বিশ্বাস করে ইমরান খান যাতে ক্ষমতায় না আসতে পারে সে চেষ্টা চালানো হয়েছে। তার দলের প্রতীক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তার নামে বহু মামলা করা হয়েছে। এসবই করা হয়েছে অনৈতিকভাবে।ফলে আমি শতভাগ বিশ্বাস করি ইমরান খান ক্ষমতায় আসুক সেটা দেশটির সেনাবাহিনী চায় না। আর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এতে অন্যান্য দেশ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত থাকার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত।
রেডিও তেহরান: অনেকেই বলে থাকেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর দিন ইমরান খান মস্কোতে অবস্থান করছিলেন। এজন্য আমেরিকা বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত হয়েছে এবং ইমরান খানকে রাজনৈতিকভাবে তার খেসারত দিতে হচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
অব.ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামস: যে প্রশ্নটি করলেন সেটি সত্য। ইমরান তো আসলে দেশপ্রেমিক সাহসি নেতা। আফগানিস্তানের সাথে আমেরিকার যুদ্ধে পাকিস্তানকে যেভাবে সাহায্য সহযোগিতার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল বা প্রত্যাশা করেছিল ইমরান খান সেটি পাকিস্তানের জনগণের কথা ভেবে করেনি এবং পছন্দ করত না। ড্রোন হামলাসহ নানা ধরনের হামলা যাতে না হয় সেজন্য ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে।তারপর আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর তারা চেয়েছিল অস্থায়ীভাবে পাকিস্তানে রাখার জন্য। সেটিও ইমরান খান প্রত্যাখান করে। সুতরাং আমেরিকার রোষানালে ছিল ইমরান খান। এখনও আছে। পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থ নিয়ে আমেরিকার সেভাবে কোনো মাথা ব্যথা নেই। যে কারণেই তারা ইমরান খানের ওপর ক্ষিপ্ত এবং ছলে বলে কৌশলে ইমরান খান যাতে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে না পারে সে ব্যবস্থাই তারা সবসময় করে গেছে।
রেডিও তেহরান: সাধারণত সামরিক বাহিনী দুর্নীতি-বিরোধী অবস্থানে থাকে কিন্তু পাকিস্তানে দুর্নীতির বরপুত্র হিসেবে খ্যাত আসিফ আলী জারদারি আর নওয়াজ শরীফকে কেন দেশটির সামরিক বাহিনী এখন সমর্থন দিচ্ছে- সেই প্রশ্ন সব জায়গায়। কী বলবেন আপনি?
অব.ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামস: দেখুন, এ ব্যাপারে সবাই একটা মজার কথা বলে।সেটি হচ্ছে-প্রত্যেক দেশের একটি সেনাবাহিনী থাকে। আর পাকিস্তান সম্পর্কে বলে পাকিস্তান নামে সেনাবাহিনীর একটি দেশ আছে। এরকম একটা কথা শোনা যায়। মানে সেখানকার সেনাবাহিনী ধরেই নেয় যে তারা যা বলবে সেভাবেই দেশ চলবে। অর্থাৎ তারাই কলকাঠি নাড়বে। আর আসিফ আলী জারদারি, নওয়াজ শরীফ তারা মূলত দুর্নীতিগ্রস্ত। আর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও একটা বড় ইকোনমি মেইনটেইন করে আর এই দুর্নীতিগ্রস্ত দুজন আছে। এই রাজনৈতিক পার্টির সাথে সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যগুলো মিলে যায় বলে আমার মনে হয়। ফলে সেনাবাহিনী তো তাদেরকেই পছন্দ করবে।
আর পাকিস্তানের জনগণের কি হলো না হলো তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা সেভাবে নেই। দেশের অর্থনীতির কি হবে তাতেও কোনো আগ্রহ নেই শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থটাই তারা বেশি দেখে। ফলে তিনটা পার্টির মধ্যে একটা অটোমেটিক আতাঁত হয়ে যায়। কারণ তাদের উদ্দেশ্য একইরকম। এর বিপরীতে ইমরান খানের চাওয়া ছিল জনগণের উন্নয়ন, পুরো দেশের উন্নয়ন। দুর্নীতি যেন না হয়, টাকা পয়সা যেন লিকেজ না হয়, অর্থনীতি যেন ভালো হয়, গরীবের টাকা যেন গরীবের পেছনেই খরচ করা হয়-এসবই ছিল ইমরান খানের চাওয়া। অন্যদিকে সেনাবাহিনীসহ বাকি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য যেসব অনৈতিক কাজগুলো করেছে, করছে বা করবে-এটি তাদের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এটি থেকে বেরিয়ে আসাও তাদের পক্ষে কঠিন। আর এ কারণেই মূলত ইমরান খানকে তারা পছন্দ করছে না। সে যেন কোনোভাবেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্লাটফর্মে লিড করতে না পারে সেটাই তাদের উদ্দেশ্য।
রেডিও তেহরান: তো অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামস আলাপনকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
অব.ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামস: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম। উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৫