অক্টোবর ০৬, ২০১৭ ২১:২৭ Asia/Dhaka
  • নূরনবী মোস্তফা (সা.) : পর্ব ৩১

রাসূল (সাঃ) মদীনায় তাঁর দশ বছরের জীবনে যা কিছু করেছিলেন তার উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের উচ্চতর মূল্যবোধগুলোর বাস্তবায়ন৷ মদীনায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার ছিল এরই অংশ৷

আমরা আগেও বলেছি বিশ্বনবী (সাঃ) ইসলামের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিসহ জাতীয় ঐক্যের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন৷ তিনি ভুল রীতি ও ক‚-প্রথাগুলোর পরিবর্তে মহান আল্লাহর বিধানকে সমাজের চালিকাশক্তিতে পরিণত করেন৷ তাওহীদ বা একত্বাদ সমাজের মানুষের মধ্যে অহংকার বা বিভেদ ও বিভক্তির সীমারেখাগুলো মুছে ফেলে এবং এটাই হয়ে ওঠে মুসলমানদের একতার কেন্দ্রবিন্দু৷

 মদীনার মানুষের মন থেকে জাহেলী যুগের ধারণাগুলো মুছে ফেলা ছিল সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্বনবী (সাঃ)'র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ৷ অযৌক্তিক প্রথা ও রীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে ও বিবেকের অনুসারী হতে রাসূল (সাঃ)'র আহবান ছিল তাঁর প্রবর্তিত ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কর্মসূচী৷ সেযুগে সাংস্কৃতিক অনাচার তথা ভুল ধারণাগুলো সমাজের অস্তিত্বের জন্যে হুমকী হয়ে উঠেছিল৷

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সেযুগে দয়াহীনতা বা নির্দয় আচরণকে সাহসিকতা বলে মনে করা হতো এবং রক্তপাত ও হত্যাকান্ডকে মনে করা হতো বীরত্ব! বলদর্পীতা ছিল শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড এবং গোত্রীয় বা বংশীয় গর্ব ও অহংকার ছিল মূল্যবোধ বা সম্মানজনক বিষয়! জনগণের মধ্যে আলোচনা ও মত বিনিময়ের আসর ছিল বিশ্বনবী (সাঃ)'র অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রীয় কর্মসূচী৷ এর ফলে জ্ঞান-চর্চার এক বাঁধ-ভাঙ্গা জোয়ার সৃষ্টি হয় এবং জনগণের সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে৷ রাসূলে খোদা (সাঃ) সবার মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে মদীনায় একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলেন৷ বিশ্বনবী (সাঃ) সবার মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে শিক্ষিত বা অক্ষর-জ্ঞান সম্পন্ন সবাইকে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ তিনি জ্ঞান অর্জনকে ফরজ বা অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব বলেও ঘোষণা করেন৷

গবেষকদের মতে রাসূল (সাঃ)'র রাষ্ট্র পরিচালনার রীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল নিখুঁত এবং সুসমন্বিত৷ একদল সচিব বা লেখক রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সাঃ)-কে সহায়তা করতেন৷ এঁদের মধ্যে চারজন সম্মানিত সাহাবী পবিত্র কোরানের বাণী লিপিবদ্ধ করতেন৷ এছাড়াও দুজন লেখক জনগণের মধ্যে প্রতিদিন যা ঘটতো তা লিখিত প্রতিবেদন হিসেবে রাসূল (সাঃ)'র কাছে পেশ করতেন৷ অন্য দুজন লেখক বিভিন্ন গোত্র সম্পর্কিত বিষয় নথিবদ্ধ করতেন৷ বিশ্বনবী (সাঃ) বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়েও দুজন লেখক নিয়োগ করেছিলেন৷ হযরত জায়েদ বিন সাবেত (রাঃ) সেযুগের রাষ্ট্রপতি বা নেতৃবৃন্দের কাছে রাসূলের পক্ষ হয়ে চিঠি লিখতেন৷

প্রাত্যহিক বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ থাকায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হতো এবং রাষ্ট্রে শৃংখলাও বজায় ছিল৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র প্রবর্তিত রাষ্ট্রের প্রথম দিকে এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বেশ সাদামাটা ছিল৷ পরবর্তিকালে এসব প্রতিষ্ঠান বিস্তৃত ও পরিপূর্ণ রূপ নেয়৷ রাসূল(সাঃ) শ্রম বিভাজন ও বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে যোগ্য লোক বা প্রতিনিধি নিয়োগ করতেন এবং তাদেরকে মদীনার আশপাশে পাঠাতেন৷

এসব মিশনে প্রত্যেকের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট ছিল এবং তিনি দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে তাদের কাজের রিপোর্ট নিতেন৷ এমনকি বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁর প্রতিনিধিদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের জন্যে একদল লোক নিয়োগ করেছিলেন যারা ঐ প্রতিনিধিদের যোগ্যতা বা দূর্বলতা সম্পর্কে রিপোর্ট দিতেন৷ এসব ব্যবস্থা থেকে বোঝা যায় আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান বিশ্বনবী (সাঃ) রাষ্ট্রীয় তদারকির নিখুঁত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন৷ মহানবী (সাঃ) তাঁর ইসলামী রাষ্ট্রে বিচার বিভাগও গড়ে তুলেছিলেন৷ এই বিচার ব্যবস্থা থেকেই পরবর্তিকালে ইসলামী বিচার ব্যবস্থার সংস্কৃতি বা নীতিমালা বিকশিত হয়েছে৷ ইসলামের আবির্ভাবের আগে শুধু দাবী পেশ ও যুদ্ধ বা বলপ্রয়োগ অথবা গোত্রপ্রধানের পক্ষপাতমূলক নির্দেশই ছিল আইন বা অধিকার সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংশার পদ্ধতি৷ আর গোত্র-প্রধানও সাধারণতঃ ধনী বা শক্তিশালী লোকদের পক্ষে রায় দিতেন৷ কিন্তু বিশ্বনবী (সাঃ)'র প্রবর্তিত বিচার- ব্যবস্থায় এসব অন্যায় প্রথা নিষিদ্ধ করা হয় এবং আইনের দৃষ্টিতে সবাইকে সমান বলে ঘোষণা করা হয়৷ জাহেলী যুগে কোনো গোত্রের এক ব্যক্তি কোনো অপরাধ করলে কখনও কখনও পুরো গোত্রকে সে জন্যে দোষী সাব্যস্ত করা হত৷ কিন্তু ইসলামের নবী (সাঃ) জাহেলী যুগের ঐ নিয়ম বাতিল করে ঘোষণা করেন যে, কোনো ব্যক্তির অপরাধের জন্যে অন্য কেউই সাজা পাবে না৷

 বিশ্বনবী (সাঃ) নিজেই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ছিলেন৷ জনস্বার্থ বিষয়ক কাজে রাসূল (সাঃ)কে বিচারক হিসেবে মেনে নিতে পবিত্র কোরআনেও নির্দেশ এসেছিল৷ যেমন, সূরা নিসার ৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তোমার পালনকর্তার কসম, যারা তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে (রাসূল-সঃ)কে বিচারক হিসেবে মেনে নিবে না ও তোমার মীমাংশার ব্যাপারে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হবে না তারা ঈমানদার হবে না ৷এমনকি রাসূল (সাঃ)'র সাথে মদীনার বিভিন্ন গোত্রের যে চুক্তি হয়েছিল সেসবেও বিভিন্ন বিরোধ মীমাংশার ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সাঃ)কে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছিল৷ যেমন, চুক্তির একটি ধারায় বলা হয়েছেঃ এই চুক্তির অনুসারীদের মধ্যে যদি এমন বিরোধ ও দ্বন্দ্ব দেখা দেয় যে তার ফলে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে তাহলে ঐসব বিরোধ মীমাংশার জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে রুজু করা হবে৷ অর্থাৎ জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় শৃঙখলা বা জননিরাপত্তায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে সেক্ষেত্রে রাসূলই ছিলেন বিচারক৷ অবশ্য পরবর্তিতে ইসলামী সমাজের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকায় জনগণের বিবাদ মীমাংশার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্যে রাসূল (সাঃ) পর্যায়ক্রমে মদীনার বাইরে বিভিন্ন শহরে কয়েকজন যোগ্য ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ করেন৷ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সাঃ)'র প্রধান লক্ষ্য ছিল ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য দূর করা৷

সমাজের স্থায়ীত্ব ও বিকাশের জন্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য৷ মহান আল্লাহ নিজে ন্যায় বিচারক এবং তাঁর ন্যায় বিচার বিশ্বের সব ক্ষেত্রেই বিস্তৃত৷ প্রত্যেক মানুষ তার সৎ কাজ ও মন্দ কাজের পরিমাণ অনুযায়ী প্রতিফল পাবে৷ রাসূলে খোদা (সাঃ) ন্যায়বিচারকে তাঁর রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রধান মূলনীতি হিসেবে গণ্য করতেন এবং নিজের আচরণ ও তৎপরতার মাধ্যমে ন্যায়বিচারকে সমাজদেহের মূল প্রাণশক্তি হিসেবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ রাসূলে খোদা (সাঃ)'র রাষ্ট্রে অভিজাত শ্রেণীর জন্যে কোনো বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা ছিল না৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র রাষ্ট্রে প্রত্যেক ব্যক্তি ছিল নিজের গন্তব্য ও পেশা নির্ধারণে স্বাধীন৷ বিবাহ-বন্ধন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অধিকারের ক্ষেত্রে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে সমান সুযোগ ছিল৷

এমনকি দাস-দাসীরাও এক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করতো৷ এভাবে নিপীড়িত ও মজলুম মানুষের ধ্যানের ছবি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রত্যাশিত ন্যায়বিচারের সুফলকে সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং মুক্তিকামী মানবতা তাঁর ন্যায় বিচারের ছোঁয়ায় সুন্দর ও সুখময় ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হয়েছিল৷ মানবাতার মূক্তিদূত বিশ্বনবী (সাঃ) এমন সময় ইসলামের প্রগতিশীল বিধিবিধান আরব সমাজে তুলে ধরেন যখন বিশ্বের অন্যান্য স্থান ছিল অবিচার ও জঙ্গলী আইনের আঁধারে কলুষিত৷

ঐসব সমাজের আইন ও বিচার ছিল অত্যাচারীর পক্ষে ও নিপীড়িত বা মজলুমের বিপক্ষে৷ সমাজের অধিকাংশ সুযোগ সুবিধা ছিল শুধু অভিজাত ও উঁচু শ্রেণীর করায়ত্ত৷ কিন্তু অমানিষার আঁধারে আকীর্ণ এই পৃথিবীর এক অংশে মহানবী (সাঃ) এমন এক আলোকিত আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন যেখানে ছিল না অন্যায়-অবিচার ও অজ্ঞতার অন্ধকার, ছিল শুধুই আলোর বণ্যা এবং অধিকারহারা মানুষ পেয়েছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধিকার৷ পৃথিবীর নিকষ অন্ধকারে মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র ছিল যেন এক অত্যুজ্জ্বল হীরকখন্ড, যার বিস্ময়কর দ্যুতি ও আলোকপ্রভা কয়েক শতকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল সুদুর ইন্দোনেশিয়া থেকে মরোক্কো এবং মক্কা থেকে ইউরোপের গ্রানাডা পর্যন্ত৷ ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম আদর্শ বিশ্বনবী (সাঃ) ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এতই সচেতন ছিলেন যে জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি মদীনার মসজিদে ঘোষণা করেছিলেন, আমার কাছে যদি কারো কোনো প্রাপ্য অধিকার কিংবা আমার বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগ থেকে থাকে তাহলে সে যেন তা পেশ করে৷ এক ব্যক্তি বলে উঠলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি একদিন অসচেতনতাবশতঃ আপনার হাতের লাঠি বা চাবুক দিয়ে আপনার বাহনে আঘাত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা আমার গায়ে লেগেছিল এবং আমি এখন তার প্রতিশোধ নিতে চাই৷" রাসূল (সাঃ) তখনই ঐ লাঠি বা চাবুক আনার নির্দেশ দিলেন৷ এরপর তিনি তাঁর ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে সেই চাবুক বা লাঠি ঐ ব্যক্তির হাতে দিলেন৷ কিন্তু ঐ ব্যক্তি নত হয়ে রাসূলের পবিত্র দেহে চুমো খেয়ে বললো, আসলে আমি দেখতে চেয়েছিলাম ন্যায় বিচার কায়েমের জন্যে আপনি কতটা নিষ্ঠাবান৷#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/৬

ট্যাগ