অক্টোবর ১১, ২০১৮ ১৯:০৪ Asia/Dhaka

আজকের আসরের শুরুতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মসজিদে নারীর উপস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করার পাশাপাশি চীনের শিয়ান, ইয়াং জু এবং ঈদগাহ মসজিদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব।

আগের আসরগুলোতে আমরা বলেছিলাম, ইসলামের প্রাথমিক যুগে শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতায় নারীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। তখন নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে নারীর উপস্থিতি ছিল গ্রহণযোগ্য ও ইতিবাচক একটি বিষয়। ইবাদত করার জন্য মসজিদুল হারামে বিবি খাদিজা সালামুল্লাহি আলাইহার উপস্থিতি ছিল এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) সামনে, হযরত আলী (আ.) তাঁর ডানে এবং বিবি খাদিজা তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে জামায়াতে নামাজ আদায় করতেন। মুসলমানদের ক্বিবলা পরিবর্তনের মুহূর্তে আল্লাহর রাসূল যে নামাজের ইমামতি করছিলেন তাতেও নারীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, মসজিদুল আকসা থেকে মসজিদের হারামে ক্বিবলা পরিবর্তনের সময় বহু সংখ্যক নারী আল্লাহর রাসূলের পেছনে নামাজ আদায় করছিলেন। তারা যথারীতি পুরুষ মুসল্লিদের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। মদীনায় অনুষ্ঠিত ওই নামাজে সবাই মসজিদুল আকসার দিকে অর্থাৎ উত্তরদিকে মুখ করে নামাজ আদায় করছিলেন। আল্লাহ তায়ালার আদেশে নামাজের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে মক্কার মসজিদুল হারামের দিকে অর্থাৎ দক্ষিণদিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ আদায় করতে থাকেন। এ অবস্থায় জামায়াতে অংশগ্রহণকারী নারীরা পুরুষ মুসল্লিদের সামনে চলে আসেন। তখন শরীয়তের বিধান রক্ষার জন্য সমবেত নারীরা দ্রুততার সঙ্গে তাদের স্থান পরিবর্তন করে পুরুষদের পেছনে চলে যান। এই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রমাণ করে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে মসজিদে অনুষ্ঠিত জামায়াতে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ্যনীয়।

এ ছাড়া, মসজিদে নববীতে নারীদের প্রবেশের জন্য আলাদা একটি দরজা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন আল্লাহর রাসূল (সা.)। আজও সেই দরজাটি দারুন নিসা নামে সংরক্ষিত রয়েছে।

শিয়ান মসজিদ

বর্তমান যুগেও বিশ্বের বড় মসজিদগুলোতে নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অবশ্য আলাদা আলাদা দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী এই ব্যবস্থায় ভিন্নতা রয়েছে। যেসব দেশে সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয় না সেসব দেশে স্বাভাবিকভাবেই মসজিদেও নারীর নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই।  উদাহরণস্বরূপ ভারতের মসজিদগুলোতে নারীর উপস্থিতির প্রচণ্ড বিরোধিতা করা হয়। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের চেয়ে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের মসজিদগুলোতে এই বিরোধিতা বেশি লক্ষ্য করা যায়।

শিয়ান মসজিদ

আরব দেশগুলোতে এই পরিস্থিতি এতটা খারাপ না হলেও সেখানেও মসজিদে নারীর উপস্থিতি তুলনামূলক কম। কিন্তু মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে মসজিদে জামায়াতের নামাজে নারীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চীনে নারীদের জন্য আলাদা মসজিদ রয়েছে এবং সেসব মসজিদের কোনো কোনোটিতে নারীরাই জামায়াতের ইমামতি করেন। যেমন- চীনের গানসু প্রদেশের রাজধানী লানজু’র লুলান মসজিদটি শুধুমাত্র নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য নির্মিত হয়েছে। এই মসজিদে প্রায় ৩০ জন নারী পাঞ্জেগানা নামাজ আদায় করেন এবং শুক্রবার জুমার নামাজে তাদের সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়ে যায়।

শিয়ান মসজিদ

আসরের এ পর্যায়ে আমরা চীনের কয়েকটি মসজিদকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। চীনের শান শি প্রদেশের শিয়ান শহরে অবস্থিত জামে মসজিদ হচ্ছে দেশটির অন্যতম প্রাচীন মসজিদ।  তাং রাজবংশের শাসনামলে এই মসজিদ নির্মিত হয় এবং খ্রিস্টিয় ১৪ শতকে মিং রাজবংশের শাসনামলে এটি প্রথমবারের মতো পুনর্নিমিত হয়। পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকবার এই মসজিদ সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে শিয়ান মসজিদের যে কাঠামো দেখা যায় তা নির্মিত হয়েছে খ্রিস্টিয় ১৭ ও ১৮ শতকে যথাক্রমে মিং ও কুইং রাজবংশের শাসনামলে।

শিয়ান মসজিদ

একটি আরবি শিলালিপি ছাড়া শিয়ান জামে মসজিদ ভবনের আর কোনো অংশের সঙ্গে ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর মিল নেই। খ্রিস্টিয় ১৫ শতকে বৌদ্ধ উপাসনালয়ের আদলে এই মসজিদ নির্মিত হয় এবং এখনো কোনো বিদেশি পর্যটক মসজিদটির দিকে তাকালে এটিকে প্যাগোডা হিসেবেই ধরে নেবেন। তবে মসজিদটির মূল কাঠামোকে পশ্চিমমুখী করে নির্মাণ করা হয়েছে যার সঙ্গে প্যাগোডার পার্থক্য রয়েছে।

চীনের ঈদগাহ মসজিদ

এই মসজিদে প্রবেশ করতে গেলে যেকোনো মুসল্লিকে চারটি আঙ্গিনা পেরিয়ে প্রবেশ করতে হয়। প্রথম আঙ্গিনায় রয়েছে কাঠের নির্মিত নয় মিটার উঁচু একটি মিনার। দ্বিতীয় আঙ্গিনায় দু’টি সুদৃঢ়  গোলাকৃতি স্তম্ভের ওপর স্থাপন করা হয়েছে একটি খিলান।  দু’টি স্তম্ভের একটি দাং রাজবংশের শাসনামলের একটি বিখ্যাত হস্তলিপি এবং দ্বিতীয় স্তম্ভে রয়েছে মিং রাজবংশের শাসনামলের আরেকটি মূল্যবান হস্তলিপি।  চীনের ঐতিহাসিক হস্তলিপির তালিকায় এই দু’টি শিল্পকর্মই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

শিয়ান মসজিদের প্রবেশপথে এবং তৃতীয় আঙ্গিনায় রয়েছে দু’টি ছোট লাউঞ্জ। এসব লাউঞ্জের স্তম্ভগুলি ১৩শ’ বছর আগে এই মসজিদ নির্মাণের সময় স্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মসজিদ বহুবার পুনর্নির্মিত হলেও এগুলো সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।  মসজিদের চতুর্থ আঙ্গিনার ভেতরে রয়েছে এটির মূল ভবন।  এখানে একসঙ্গে এক হাজার মানুষ জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন।

চীনের ঈদগাহ মসজিদ

চীনের ‘শিয়াং সু’ প্রদেশে রয়েছে দেশটির চতুর্থ বিখ্যাত মসজিদ- ইয়াং জু। এই মসজিদটি ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয় এবং পরবর্তীতে বহুবার এটির সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়। ইয়াং জু শহরে অবস্থিত মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে এই শহরেরই নামে। চীং রাজবংশের শাসনামলে এই ‘ইয়াং জু’ শহরে ছয়টি মসজিদ ছিল। এগুলোর মধ্যে তিনটি ছিল শহরের ভেতরে এবং তিনটি ছিল আশপাশে। ইয়াং জু মসজিদটিকে শিংখ মসজিদও বলা হয়। চীনা রূপকথার একটি সুন্দর পাখির মতো করে নির্মিত হয়েছে বলে ওই পাখির নাম অনুসারে এটির এই নামকরণ করা হয়েছে।  ইয়াং জু মসজিদে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য রয়েছে একটি মাদ্রাসা। মসজিদের আঙ্গিনায় অবস্থিত তিনটি ভবনে মাদ্রাসার ক্লাসগুলো অনুষ্ঠিত হয়। মসজিদের আঙ্গিনায় রয়েছে ১৫ মিটার উঁচু একটি প্রাচীন ‘কিং গু’ গাছ। এই গাছের বয়স ৭০০ বছর বলে ধারণা করা হয়।

চীনের ঈদগাহ মসজিদ

সবশেষে আমরা চীনের ঈদগাহ মসজিদ নিয়ে আলোচনা করব। এই মসজিদ ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে ইসলামি স্থাপত্যশৈলীতে নির্মাণ করা হয়। মসজিদ সংলগ্ন বিশাল ঈদগাহ’র নাম অনুসারে এটির নামকরণ করা হয়েছে। চীনের ঐতিহাসিক কাশগর শহরে এই মসজিদ অবস্থিত।  ১৬ হাজার ৮০০ বর্গমিটার আয়তনের মসজিদটিতে খিলানসদৃশ ৩৮টি বারান্দা রয়েছে। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে মির্জা আবুবকর নামের এক ব্যক্তি মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করে এর আয়তন অনেক বড় করে দিয়েছিলেন। তারপর আরো বহুবার ঈদগাহ মসজিদের সংস্কার করা হয়েছে। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বড় ধরনের সংস্কার করার পর মসজিদটি বর্তমান আকার ধারণ করে। এ ছাড়া, সর্বশেষ ২০০০ সালে চীন সরকার মসজিদটি মেরামত ও সংস্কার করে দেয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১১

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ