জানুয়ারি ২৮, ২০২০ ১৭:৩২ Asia/Dhaka

সুরা আল আস্‌র্‌ পবিত্র কুরআনের ১০৩তম সুরা। হিজরতের আগে পবিত্র মক্কায় নাজিল হওয়া ও সুরায় তথা মক্কি এ সুরায় রয়েছে তিন আয়াত। অনেক মুফাসসিরের মতে ছোট হলেও এ সুরায় রয়েছে পবিত্র কুরআনের সমস্ত লক্ষ্য ও জ্ঞানের সংক্ষিপ্তসার। এতে যেন রয়েছে বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর পূর্ণতা।

আস্‌র্‌ শব্দের অর্থ সময়, কাল বা যুগ কিংবা মানবজাতির ইতিহাস ও যুগের একটি অংশ। অবশ্য অনেকেই মনে করেন এখানে আস্‌র্‌ বলতে গোটা কাল-প্রবাহ ও মানবজাতির ইতিহাসকে বোঝানো হয়েছে যা মানুষের চেতনা আর বিবেক-জাগানো বহু শিক্ষণীয় ও লোমহর্ষক ঘটনা এবং উত্থান-পতন বা চড়াই-উৎরাইয়ের সাক্ষী। আবার অনেক মুফাসসিরের মতে যুগ বলতে এখানে কেবল মহানবী (সা)’র আবির্ভাবের যুগকে বোঝানো হয়েছে যে যুগে ঘটেছিল মানবজাতির জন্য মহান ইসলামের সূর্যোদয় এবং যে যুগ হল মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়ের যুগ।

 এ সুরার শুরুতেই মহান আল্লাহ শপথ নিয়েছেন সময় তথা কালের যাতে মানুষ এই মহান নেয়ামতের অশেষ গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর যথাযথ ও বরকতময় ব্যবহারের প্রতি সচেতন হয়।  মহান আল্লাহর এক অতি মহান ও কল্যাণকর সৃষ্টি হল সময়।

সুরা আল আস্‌র্‌-এর দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: নিঃসন্দেহে সব মানুষই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। -অর্থাৎ মানুষের সবচেয়ে বড় পুঁজি বা জীবন তথা আয়ু বরফের মতই ক্রমেই গলে যাচ্ছে। স্রোতের মতই দ্রুত বয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবনের মুহূর্ত, ঘণ্টা, দিন-রাত, সপ্তাহ, মাস আর বছরগুলো। যতই দিন যায় মানুষের যৌবনের অমিত-তেজ ও শক্তি ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। দম দেয়া একটি ঘড়ি বা ব্যাটারি-চালিত একটি যন্ত্রের মতই আমাদের হৃদপিণ্ড একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। সেই নির্দিষ্ট সময় শেষ হলে নিজ থেকেই থেমে যায় হৃদপিণ্ডের স্পন্দন। এমনকি এই হৃদপিণ্ড অকেজো হয়ে যাওয়ার জন্য কোনো কারণ বা অসুখেরও দরকার নেই। মানুষের সব শক্তি, ক্ষমতা আর প্রতিভার ব্যাপারটাও একই রকম। 

ইসলামী বিশ্বদৃষ্টির আলোকে এই পার্থিব জীবন ব্যবসার কেন্দ্র মাত্র। মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম হাদী (আ) বলেছেন, দুনিয়া হচ্ছে এমন এক বাজারের মত যেখানে একদল লোক লাভ করে ও অন্য দলটি ক্ষতির শিকার হয়। মানুষের উদ্ধত ও অশান্ত প্রবৃত্তি তাকে প্রতিনিয়ত ক্ষতি ও পতনের দ্বারপ্রান্তে রাখে কেবল তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে যায় এবং একে-অপরকে সত্যের ও ধৈর্য আর প্রতিরোধের উপদেশ দেয়।

প্রখ্যাত মুফাসসির সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ হুসাইন তাবাতাবায়ি মানুষের জীবন ও দুনিয়ার জীবনের পরীক্ষা ও বাজার সমতুল্য হওয়া সম্পর্কে বলেছেন, 'মানুষ চিরজীবন্ত সত্তা। মৃত্যু তার জীবনের অবসান ঘটায় না। মানুষের মৃত্যু মানে আসলে এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে যাওয়া। মানুষের জীবনের এই দুনিয়ার অংশটি পরীক্ষা মাত্র। এ পরীক্ষায় পাস বা ফেলের অনিবার্য পরিণতি হল চিরন্তন সৌভাগ্য কিংবা চিরন্তন দুর্ভাগ্য তথা বেহেশত অথবা দোযখ।  মানুষের জীবনের এই পরিণতির জন্য সে নিজেই দায়ি।  মানুষের আয়ু হল তার পুঁজি। কেউ যদি এই দুনিয়ার জীবনে বিশ্বাস ও কাজের মাধ্যমে সত্যের অনুসরণ করে তাহলে সে হয় সফল ব্যবসায়ী, তার আয় হবে বরকতময়। ফলে তার ভবিষ্যৎ হয় নিরাপদ। কিন্তু যে মিথ্যার অনুসারী ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আর সৎ কাজকে এড়িয়ে চলে সে হল ব্যর্থ ব্যবসায়ী। তার পুঁজি-বিনিয়োগে কোনো লাভ তো আসেইনি বরং এই বিনিয়োগ হয়েছে তার জন্য সর্বনাশের মাধ্যম। পরকালের কল্যাণ থেকে সে বঞ্চিত থাকবে। সুরা আল আস্‌র্‌ মানুষকে এ বিষয়েই সচেতন হতে বলে।'

সুরা আল আস্‌র্‌-এর তৃতীয় বাক্যে মানুষকে একটি কর্মসূচি দেয়া হয়েছে যা পালন করলে মানুষ ক্ষতিমুক্ত হবে। এ কর্মসূচির প্রথমেই ঈমান বা বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। ঈমানই হল মানুষের সব তৎপরতার ভিত্তি। মানুষের কাজেই প্রকাশ পায় তার বিশ্বাস। আর এ জন্যই সব নবী-রাসুল জনগণের বিশ্বাসের ভিত্তিগুলোর সংস্কার করাকে তাঁদের প্রথম কর্মসূচি করেছেন। তাঁরা এ জন্য নানা ধরনের শির্কের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। কাউকে আল্লাহর অংশীদার ভাবা তথা  শির্ক হচ্ছে সব ধরনের অকল্যাণ, বিভেদ ও অসৎ গুণগুলোর উৎস। 

 এরপর সুরা আস্‌রের তৃতীয় বাক্যে সৎ কাজ করাকে মানুষের মুক্তির গ্যারান্টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সৎকাজ বলতে কেবল ইবাদাত, দান-খয়রাত, জিহাদ ও জ্ঞান অর্জন করাকে বোঝায় না। সব ধরনের ভালো কাজই সৎ কাজ। যেসব কাজ মানুষের আত্মিক পূর্ণতা, নৈতিক উন্নয়ন ও সমাজের উন্নয়নে সহায়ক তার সবই হল সৎকাজ বা স'লেহ'ত।

ঈমান ও সৎকাজ কখনও গতিশীল থাকে না যদি না এর ধারক ও বাহকদের সবাই আল্লাহর পথে, সত্য ও ধর্মের জ্ঞানের পথে, প্রতিরোধ ও ধৈর্যের পথে আহ্বান জানানোর সর্বজনীন আন্দোলনে শরিক না হয়। পরস্পরকে সত্যের ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়া এই সর্বজনীন আন্দোলনের একটি অংশ যা মানুষকে ক্ষতি ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করে এবং মানুষকে মনুষ্যত্বের শিখরে ও পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়। #    

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ