ইরানি চিত্র শিল্পী কামালউদ্দিন বেহয'দ সুলতানির জীবন ও অবদান
আজ আমরা হিজরি নবম শতকের তথা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি চিত্র শিল্পী কামালউদ্দিন বেহয'দ সুলতানির জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
কামালউদ্দিন বেহয'দ সুলতানি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৪৫০ থেকে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৮৫৫ থেকে ৮৬৫ হিজরির কোনো এক বছরে তৎকালীন ইরানের হেরাত অঞ্চলে। বর্তমানে হেরাত আফগানিস্তানের অংশ। তৈমুরি যুগের এই চিত্রশিল্পী চিত্র শিল্পে 'হেরাত ঘরানা'র প্রতিষ্ঠাতা। হিজরি নবম ও দশম শতকে এই ধারার ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল। চিত্র-শিল্পে নতুন ধারার জনক ও সৃষ্টিশীল শিল্পী কামালউদ্দিন বেহয'দ ইরানের চিত্র-শিল্পীদের জন্যই গর্ব ছিলেন না একইসঙ্গে তিনি ভারত, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার চিত্র-শিল্পীদেরও আদর্শে পরিণত হয়েছিলেন।
কামালউদ্দিন বেহয'দ সুলতানির ওস্তাদ বা শিক্ষক ছিলেন খাজা আমির রুহুল্লাহ। তিনি মিরাক নামেও খ্যাত। খাজা মিরাক ছিলেন সুলতান হুসাইন বয়কারোর গ্রন্থাগারিক। কামালউদ্দিন বেহয'দ শৈশবেই বাবা-মাকে হারান। এরপর খাজা রুহুল্লাহ মিরাক তার অভিভাবক ও গাইড হন। সম্ভবত তিনি ছিলেন বেহয'দের আত্মীয়।
চিত্র-শিল্প ও বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কনে ও ক্যালিগ্রাফি বা সুলেখন শিল্পে এবং ভবনাদিতে খোদাই করে লেখার শিল্পে খাজা মিরাক ছিলেন অতুলনীয় শিল্পী। হেরাতের প্রাচীন ভবনের বেশিরভাগ খোদাই-লিপি মিরাকের শিল্প-কর্ম।
ইতিহাস বিষয়ক বইগুলোতে দেখা যায় রুহুল্লাহ মিরাক ও পীর সাইয়্যেদ আহমাদ তাব্রিজি ছিলেন কামালউদ্দিন বেহয'দের অন্যতম শিক্ষক।
কামালউদ্দিন বেহয'দ জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় হেরাতেই কাটিয়েছেন। অবশ্য প্রথম সাফাভি সুলতানের শাসনামলে তিনি ছিলেন ইরানের তাব্রিজে। তাব্রিজে তিনি কাটিয়েছেন জীবনের বাকি অর্ধেক সময়। কামালউদ্দিন বেহয'দ যুবক বয়সে তার শিক্ষকদের কাছ থেকে তালিম নেয়ার কিছু কালের মধ্যেই ছবি আঁকার কাজে ব্যাপক দক্ষতা ও খ্যাতি অর্জন করেন। সে সময়কার শিল্প-রসিক তৈমুরি শাসক সুলতান বয়কারো এবং তারই প্রখ্যাত মন্ত্রী ও কবি আমিরআলীশির নাওয়ায়ির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন কামালউদ্দিন বেহয'দ। চিত্র-শিল্পে তার প্রতিভা বিকাশে শিল্প-রসিক সুলতান বয়কারো ও তার মন্ত্রী আমিরআলীশির নাওয়ায়ির উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুবক বয়সেই বেহয'দ সুলতান হুসাইন বয়কারোর নির্দেশে রাজ-দরবারের সদস্য হয়েছিলেন।
তৈমুরি শাসনামলেই কামালউদ্দিন বেহয'দ মিনিয়েচার আর্ট বা ক্ষুদ্র ছবি আঁকার কাজে হেরাতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পী এবং ওস্তাদ হিসেবে খ্যাত হন। তিনি হেরাতের এ সংক্রান্ত একাডেমিতে এই শিল্পের ছাত্রদের তালিম দিতেন। এ যুগেই বিখ্যাত কিছু চিত্র-কর্ম উপহার দিয়েছিলেন কামালউদ্দিন বেহয'দ। এই একাডেমির জিনিষপত্র ও সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ করতেন আমিরআলীশির নাওয়ায়ি। হেরাতের ওই একাডেমির দেয়ালগুলো ও একটি হলরুমের ছাদ ঢেকে দেয়া হয়েছিল মিনিয়েচার শিল্পকর্মে। এ কাজে বেহয'দকে সহযোগিতা করেছিলেন তারই একদল ছাত্র। ওই হলটিকে বলা হত নেগ'র খ'নে বা গ্যালারি।
হেরাতে সুলতান হুসাইন বয়কারোর রাজ-দরবার ছিল জ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কেন্দ্র। এইসব ব্যক্তির মধ্যে আমিরআলীশির নাওয়ায়ি, কবি জামি ও ঐতিহাসিক খন্দমির ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। সাফাভি ও তৈমুরি সুলতান ছাড়াও উজবেক নেতা মোহাম্মাদ খানি শাইব'নির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন বেহয'দ।
সুলতান হুসাইন বয়কারো কামালউদ্দিন বেহয'দকে 'দ্বিতীয় ম'নি' শীর্ষক খেতাব বা উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি বেহয'দকে ৮৯৮ হিজরিতে বিখ্যাত হুমায়ুনি লাইব্রেরির পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ফলে দরবারের সব শিল্পীদের পরিচালনার কাজ করতে হয়েছে তাকে। তিনি দরবারের হুমায়ুনি গ্রন্থ-কেন্দ্রে ছবি আঁকা ও বইয়ের সাজ-সজ্জার কাজে মশগুল হন। বইয়ের সাজ-সজ্জার শিল্পে ও প্রচ্ছদ আঁকার শিল্পেও তিনি ওস্তাদে পরিণত হন। সুলতান বয়কারোর মৃত্যু পর্যন্ত বিশ বছর ধরে ওই লাইব্রেরির পরিচালক ছিলেন বেহয'দ। এ সময়ে তিনি ছাত্রদের নিয়ে অনেক বড় বড় শিল্প-প্রকল্প সম্পন্ন করেন এবং অনেক সুদক্ষ ও সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী ছাত্র গড়ে তুলে চিত্র-শিল্পে হেরাত ঘরানার ভিত্তি স্থাপন করেন। ৯১২ হিজরিতে মুহাম্মাদ খান শাইবানির হামলায় শেষ হয়ে যায় তৈমুরি সুলতানদের শাসন। এরপরও বেহয'দ হেরাতে ছিলেন। হিজরি ৯১৬ সনে সাফাভি সুলতান শাহ ইসমাইল সাফাভি হেরাত দখল করেন। শাহ ইসমাইল সাফাভিও ছিলেন শিল্পমোদী। তিনি বেহয'দের সুখ্যাতি শুনেছিলেন। হেরাত দখলের পর তিনি বেহয'দসহ অনেক বড় বড় শিল্পীকে নিজের সঙ্গে তাব্রিজে নিয়ে আসেন। তিনি সাফাভি সম্রাটের দরবারে ২৬ বছর ছিলেন।
তাব্রিজে বেহয'দের উপস্থিতি চিত্র শিল্পে তাব্রিজি ঘরানা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় প্রভাব রেখেছিল। সম্রাট শাহ ইসমাইল ৯২৮ হিজরিতে বেহয'দকে আবারও হুমায়ুনি লাইব্রেরির পরিচালক করেন। বই লেখা বা কপি করা, বইয়ের প্রচ্ছদ-শিল্প, ক্যালিগ্রাফি বা সুলেখন শিল্প, বইয়ের সাজ-সজ্জা ও চার্ট-তৈরির মত নানা কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। বেহয'দ সুলতান তাহমাসবের যুগেও এই পদে আসীন ছিলেন। সাফাভি সম্রাটদের এই যুগে বেহয'দ বৃদ্ধ হয়ে পড়েন। ফলে এ সময় তিনি অনেক কাজ তার ছাত্রদের ওপর ন্যস্ত করতেন এবং তাদের কাজগুলো কেবল শুধরে দিতেন ও পরিমার্জন করতেন।
কামালউদ্দিন বেহয'দ ৯৪২ হিজরিতে বা ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। কেউ কেউ মনে করেন তিনি তাব্রিজে সাফাভি সম্রাটের দরবারেই ছিলেন মৃত্যুর সময় এবং তার কবরও রয়েছে তাব্রিজে। অন্য একদল মনে করেন সাফাভি সম্রাট তাহমাসবের শাসনামলে রাজ দরবারে হিংসুকদের জ্বালায় অস্থির হয়ে বেহয'দ হেরাতে ফিরে আসেন এবং সেখানেই মারা যান।
হেরাতে মুখতার পাহাড়ের কাছে সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ মুখতারের কবরের পাশে কামালউদ্দিন বেহয'দের কবর রয়েছে বলে মনে করা হয়। এই কবরের পাথরে খোদিত লিপি থেকে এটাই বেশি মনে হয় যে এখানেই তার প্রকৃত কবর রয়েছে। এই কবরের ওপরে রয়েছে কিছুটা কালো রংয়ের মর্মর পাথর ও সেখানে রয়েছে সুদৃশ্য খোদিত লিপি। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।