প্রখ্যাত ইরানি মনীষী শেখ কুলাইনির (র) কিতাব আলকাফি
আজ আমরা হিজরি তৃতীয় ও চতূর্থ শতকের তথা খ্রিস্টিয় নবম ও দশম শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী শেখ কুলাইনির (র) জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
'কিতাব আলকাফি' নামক বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থের লেখক হিসেবে খ্যাত ইরানি মনীষী শেখ কুলাইনির পুরো নাম শাইখ আবু জা'ফার মুহাম্মাদ বিন ইয়াক্বুব বিন ইসহাক রাজি। তিনি ছিলেন একজন বড় মুহাদ্দিস বা হাদিস বিশেষজ্ঞ, ফক্বিহ বা ইসলামী আইনবিদ ও চিন্তাবিদ। শেখ কুলাইনি ছিলেন ইমাম হাসান আসকারি (আ)'র যুগ ও ইমাম মাহদি (আ)'র অদৃশ্য থাকার প্রাথমিক যুগ তথা গেইবাতে সোগরার সমসাময়িক যুগের মনীষী।
শেখ কুলাইনির জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ২৫৮ হিজরিতে ইরানের আধুনিক তেহরান-সংলগ্ন রেই শহরের কাছে কুলাইন নামক গ্রাম বা মহল্লায় একটি সভ্রান্ত, ধার্মিক ও আলেম পরিবারে। তার বাবা ও মামা ছিলেন সে যুগের আলেম ও হাদিস বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত। বাবা শেখ ইয়াকুব কুলাইনি ও মামার কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন শেখ কুলাইনি। এরপর তিনি পড়াশুনা করতে রেই শহরে যান। রেই শহরেই রয়েছে তার বাবা শেখ ইয়াকুব কুলাইনির কবর।
সে যুগের রেই ছিল অনেক বড় শহর। নানা ধর্ম ও মতের অনুরাগী বিপুল সংখ্যক মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল এই শহরে। তবে এই শান্তিপূর্ণ অবস্থা অনেক রাজনৈতিক তৎপরতারও টার্গেট হয়েছিল। অন্য সব মাজহাব বা মতবাদের চেয়ে এই শহরে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের তৎপরতা ও প্রচার ছিল সবচেয়ে বেশি জোরালো। শাফিয়ি, হানাফি ও ১২ ইমামি শিয়া মাজহাবের চিন্তাধারার সঙ্গে ইসমাইলিদের চিন্তাধারার সংঘাতের স্থলে পরিণত হয়েছিল রেই। তাই রেই শহরে থেকে শেখ কুলাইনি নানা মাজহাবের চিন্তাধারা ও বিশ্বাস সম্পর্কেও অবহিত হন এবং এমনকি শিয়া মুসলিম মাজহাবকে তার প্রকৃত পথ থেকে বিচ্যুত করতে সচেষ্ট ফের্কাগুলোর পরিচিতিও বুঝতে সক্ষম হন। রেই শহরে বড় বড় শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে থেকে যুবক কুলাইনি হাদিস বিষয়ে ব্যাপক পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং এ বিষয়ে বড় ধরনের বক্তা ও তার্কিক হয়ে ওঠেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য কুলাইনি কোম শহরে যান। এখানে তিনি এমন অনেক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসেন যারা মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম হাসান আসকারি (আ) কিংবা ইমাম হাদি (আ)'র কাছ থেকে সরাসরি হাদিস শুনেছেন।

শেখ কুলাইনি কোম শহরে বড় বড় শিক্ষকদের সান্নিধ্যে থেকে নিজেকে অনেক উন্নত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ্বনবীর (সা) আহলে বাইতের ধারায় জন্ম-নেয়া মহান ইমামদের বক্তব্য বা হাদিস সংগ্রহের জন্য শেখ কুলাইনি বহু শহর ও গ্রাম ভ্রমণ করেন। তিনি যেখানেই কোনো মুহাদ্দিসের সাক্ষাৎ পেতেন তাঁর কাছ থেকে হাদিস শিখতেন। জ্ঞান অর্জন ও হাদিস শেখার নেশায় শেখ কুলাইনি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ ইরাকের কুফা শহরেও যান। এসব সফরে তাঁকে অনেক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারের পাশাপাশি ধৈর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিতে হয়েছে। এভাবে বহু শহর ও গ্রামের মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে হাদিস শিখে ও জ্ঞান অর্জন করে কুলাইনি বাগদাদে আসেন। তিনি যেখানেই গেছেন সেখানেই মহানবীর (সা) আহলে বাইতের প্রকৃত অনুসারী তথা শিয়া মুসলমানের উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন নিজ আচরণের মাধ্যমে। ফলে তিনি যখন বাগদাদে যান তখন একজন শীর্ষস্থানীয় শিয়া আলেম ও নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস হিসেবে কেবল শিয়া মুসলমানরাই তাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করতেন তা নয়, তিনি সুন্নি মাজহাবের অনুসারীদের কাছেও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।
শেখ কুলাইনি বহু পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বড় মুহাদ্দিস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন। সততা ও নির্ভরযোগ্যতার জন্য খ্যাত কুলাইনি শিয়া ও সুন্নি নির্বিশেষে সবার কাছে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে অনেক উপাধি পেয়েছিলেন। এসব উপাধির মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উপাধিটি হল সাকাতুল ইসলাম তথা ইসলামের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তার আগে মুসলিম বিশ্বের অন্য কোনো আলেম এই উপাধি লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেননি।
৭০ বছরের বরকতপূর্ণ ও সাধনা-সমৃদ্ধ জীবনে শেখ কুলাইনি বহু বই লিখে ইসলামের ব্যাপক সেবা করেছেন। তার এসব বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইটি হল ' কিতাব আলকাফি'। তার বক্তব্য ও বইগুলোকে শিয়া ও সুন্নি নির্বিশেষে সব মাজহাবের গবেষকরা নির্ভরযোগ্য গবেষণার বান্ধব বলে মনে করেন। ফলে পরবর্তীকালে অনেক লেখকের গবেষণায় কাজে লেগেছে কুলাইনির লেখা বইগুলো।
অনেক যোগ্য আলেম ও ছাত্র গড়ে তুলেছিলেন শেখ কুলাইনি।
শেখ কুলাইনির জন্মের তারিখের মত মৃত্যুর তারিখ নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী শেখ কুলাইনি ৩২৮ অথবা ৩২৯ হিজরির শাবান মাসে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছিল সব মাজহাবের অনুসারী মুসলমানরা। শোকের ছায়া নেমে এসেছিল গোটা বাগদাদে। বাগদাদের সম্মানিত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবু ক্বিইরাত বিন জা'ফার হাসানি কুলাইনির জানাজার নামাজ পড়ান। বাগদাদের বাবুল কুফা নামক স্থানে দাফন করা হয়েছিল শেখ কুলাইনিকে।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।