কুরআনের আলো
সূরা আয-যুমার: আয়াত ৬৪-৭০ (পর্ব-১৭)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা আয-যুমারের ৬৪ ও ৭০ নম্বর আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৬৪ থেকে ৬৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّي أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُونَ (64) وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ (65) بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِينَ (66)
“বলুন, হে মুর্খরা, তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করতে আদেশ করছ?” (৩৯:৬৪)
“আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তী (নবীদের) প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং নিঃসন্দেহে আপনি হবেন ক্ষতিগ্রস্তদের একজন।” (৩৯:৬৫)
“বরং আল্লাহরই এবাদত করুন এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকুন।” (৩৯:৬৬)
আগের আয়াতগুলোতে তৌহিদ ও শিরক নিয়ে আলোচনা করার পর এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: মক্কার মুশরিকরা নানা অজুহাতে তাদের মূর্তিগুলোর পূজা করার জন্য আল্লাহর রাসূলকে রাজি করানোর চেষ্টা করে। তারা বলে, রাসূলে খোদা তাদের মূর্তির পূজা করলে তারাও আল্লাহর সামনে সিজদায় অবনত হবে। মহান আল্লাহ এখানে কঠোর ভাষায় বলছেন: এ ধরনের বক্তব্য অজ্ঞতা ও মূর্খতার পরিচায়ক। কারণ, যে রাসূলকে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে মানুষকে দূরে রাখা তিনি কীভাবে সেই মূর্তির সামনে মাথানত করবেন?
পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: হে রাসূল আপনি তাদের বলে দিন যে আপনি এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো উপাসনা করবেন না এবং কোনো অবস্থাতেই তাদের মূর্তিদের সামনে মস্তক অবনত করবেন না। কারণ, তৌহিদ ও শিরক এমন কোনো বিষয় নয় যা নিয়ে আপোষ করা যায়। যে কেউ আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক করবে তার সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। আর তিনি যদি নবী হন তাহলে তার অপরাধ হবে অনেক গুণ বেশি কেননা তাকে দেখে আরো বহু মানুষ একই কাজ করবে।
নিঃসন্দেহে তৌহিদ হচ্ছে ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত এবং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস ছাড়া কোনো আমল তার দরবারে কবুল হবে না। শিরক হচ্ছে আগুনের মতো যা নেক আমলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা মানুষের অজ্ঞতা ও মূর্খতার পরিচয় বহন করে। পার্থিব নিয়মে সে যত বড় জ্ঞানী ও পণ্ডিতই হোক না কেন আল্লাহর দৃষ্টিতে সে মহামূর্খ।
২- তৌহিদ বা একত্ববাদ হচ্ছে ঈমানদার ব্যক্তির রেড লাইন। তিনি কোনো অবস্থাতেই এই বিষয়ে কারো সঙ্গে আপোষ করবেন না।
৩- ইসলামের শত্রুরা নবী-রাসূলদের পর্যন্ত পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করেছে। কাজেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে শত্রুদের ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধান হতে হবে।
৪- আল্লাহর ইবাদত প্রকারান্তরে তাঁর দেয়া নেয়ামতসমূহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম।
সূরা যুমারের ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ (67)
“এবং তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে সম্মান জানায়নি (এবং তাকে চিনতে পারেনি)। কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তার ক্ষমতার আয়ত্বের মধ্যে এবং আসমানসমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তার হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা (তাঁর সঙ্গে) যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক পবিত্র ও ঊর্ধ্বে।” (৩৯:৬৭)
এই আয়াতে বলা হচ্ছে: মুশরিকরা আল্লাহ তায়ালার সুউচ্চ মর্যাদা চিনতে পারেনি বলে তারা রাসূলে খোদাকে তাদের মূর্তির প্রতি সম্মান জানাতে বলার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তারা আসলে মূর্খতার কারণে মহান আল্লাহকে তাদের মূর্তিগুলোর সমান মনে করেছে। যে আল্লাহ গোটা বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক এবং প্রতিটি প্রাণী ও বস্তু নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যার ওপর নির্ভরশীল তার ব্যাপারে শুধু মূর্খরাই এমন চিন্তা করতে পারে।
কিয়ামতের দিন আসমান ও জমিনের সবকিছু আল্লাহর করায়ত্বে থাকবে। একথা বলার অর্থ এই যে, সেদিন আল্লাহ ছাড়া আর কারো হাতে কোনো ক্ষমতা থাকবে না এবং মুক্তি ও সব সমস্যার সমাধান একমাত্র তাঁরই হাতে থাকবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি বিষয় হচ্ছে:
১- আল্লাহকে চিনতে না পারা ও তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞতার নিদর্শন হচ্ছে শিরক।
২- এই বিশাল আসমান আল্লাহ তায়ালার সামনে এতটা ক্ষুদ্র যে, কেয়ামতের দিন সেটাকে তাঁর কুদরতি হাতের মধ্যে ভাঁজ করা কিছু কাগজের মতো মনে হবে।
সূরা যুমারের ৬৮ থেকে ৭০ পর্যন্ত নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ (68) وَأَشْرَقَتِ الْأَرْضُ بِنُورِ رَبِّهَا وَوُضِعَ الْكِتَابُ وَجِيءَ بِالنَّبِيِّينَ وَالشُّهَدَاءِ وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْحَقِّ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ (69) وَوُفِّيَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَا عَمِلَتْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَا يَفْعَلُونَ (70)
“এবং শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমানসমূহ ও জমিনে যারা আছে সবাই মারা যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন (সে জীবিত থাকবে)। অতঃপর আবার শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা সকলে দণ্ডায়মান হয়ে (চারদিকে) তাকাতে থাকবে।” (৩৯:৬৮)
“এবং পৃথিবী তার পালনকর্তার নূরে উদ্ভাসিত হবে, আমলনামা স্থাপন করা হবে, পয়গম্বরগণ ও সাক্ষীগণকে আনা হবে এবং সকলের মধ্যে ন্যায়বিচার করা হবে - তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।” (৩৯:৬৯)
“এবং প্রত্যেকে যা করেছে, তার পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। তারা যা কিছু করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত।” (৩৯:৭০)
এই তিন আয়াতে পৃথিবীর সমাপ্তি ও কিয়ামত শুরুর ঘটনা বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: শিঙ্গার একটি ফুৎকারে সবাই মারা যাবে এবং কিছুদিন পর আরেকটি ফুৎকারে সবাই জীবিত হয়ে নিজেদের আমলনামার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। অবশ্য এ সময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে যে কাউকে জীবিত রাখতে পারেন। হযরত জিব্রাইল, ইসরাফিল ও মিকাইলের মতো ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য হতে পারে। সেদিন আল্লাহর নূরে জমিন এমনভাবে আলোকিত হবে যে, কোনো কিছুই আর গোপন থাকবে না। সব মানুষের ভালো-মন্দ সব আমল চোখের সামনে দেখা যাবে। প্রত্যেকের সামনে তার আমলনামা উপস্থাপন করা হবে এবং তাতে ছোট-বড় সব ভালো ও মন্দ কাজ লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেদিন নবী-রাসূল ও সাক্ষীদের উপস্থাপন করা হবে এবং ইনসাফের সঙ্গে মানুষের বিচার করা হবে এবং কারো প্রতি জুলুম করা হবে না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- মানুষসহ সব প্রাণীর জীবন-মরণ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। তিনি যেকোনো মুহূর্তে প্রাণ দিতে বা কেড়ে নিতে পারেন।
২- কিয়ামতের দিন আসবে অকস্মাৎ; এটি ধীরে ও পর্যায়ক্রমিক কোনো বিষয় নয়।
৩- আমলনামা ও সাক্ষীদের উপস্থিতিতে কিয়ামত দিবসের বিচার সংঘটিত হবে এবং বিচারের ক্ষেত্রে পূর্ণ ন্যায় ও ইনসাফ করা হবে।
৪- পার্থিব জীবনে কিছু মানুষ আমাদের কাজ ও আচরণের সাক্ষী হয়ে থাকছেন। ফেরেশতারা আমাদের আমলনামা রেকর্ড করছেন এবং নবী-রাসূলগণ তাদের নিজ নিজ উম্মতের সাক্ষী হিসেবে তাদের কর্ম সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।