কুরআনের আলো
সূরা তাহরিম: ৯-১২ (পর্ব-৩)
আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা তাহরিমের ৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ৯ থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির শুনব। প্রথমেই ৯ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“ হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের প্রতি কঠোর হোন। আর তাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম এবং তা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল!”
গত আসরে আমরা পরকালে কাফিরদের অবমাননা ও লাঞ্ছনা এবং মুমিন ব্যক্তিদের সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের কথা বলেছিলাম। এরপর এই আয়াতে আল্লাহর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: আপনি কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং প্রয়োজনে তাদের প্রতি কঠোর হোন। আর জেনে রাখুন, কুফর ও নিফাকের পরিণতি জাহান্নাম। কোনো কোনো মুফাসসিরের মতে, এই আয়াতে যে জিহাদের কথা বলা হয়েছে তা কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ নয়; কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কোনোদিন মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি। বরং এই আয়াতে আদর্শগত জিহাদের কথা বলা হয়েছে।
সূরা ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে: “হে রাসূল! আপনি কাফেরদের (পথ ও জীবনাদর্শের) আনুগত্য করবেন না এবং আপনি কুরআনের সাহায্যে তাদের সাথে বড় জিহাদ চালিয়ে যান।” আজকের এই আয়াতেও আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে এই নির্দেশ দিচ্ছেন যে, কাফির ও মুনাফিকদের সঙ্গে আদর্শগত জিহাদ করুন এবং তাদেরকে সুস্পষ্ট যুক্তি সহকারে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান জানান। তারা যদি আপনাকে মোকাবিলা করতে আসে তখন তাদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করুন।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- দ্বীনের সারমর্ম হচ্ছে অন্তরের বিশ্বাস। মুনাফিক বাইরে মুসলমান কিন্তু ভিতরে কাফির; কারণ, তার অন্তরে দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস নেই।
২- সদাচারণ ও সহিংসতা যার যার স্থানে যথাসময়ে প্রয়োগ করতে হবে। তবে সদাচারণকে সর্বদা সহিংসতা ও কঠোরতার উপর স্থান দিতে হবে।
৩- শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আলাদা আলাদা ধরন আছে। কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের আগে তাদের সামনে দ্বীনের আদর্শ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
এবারে সূরা তাহরিমের ১০ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“যারা কুফরী করে, আল্লাহ্ তাদের জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন নূহের স্ত্রী ও লুতের স্ত্রীর, তারা ছিল আমাদের বান্দাদের মধ্যে দুই সৎকর্মপরায়ণ বান্দার অধীন [ও তাদের স্ত্রী]। কিন্তু তারা তাদের [স্বামীদের] প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ফলে নূহ ও লুত তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারলেন না এবং তাদেরকে বলা হল, তোমরা উভয়ে প্ৰবেশকারীদের সাথে জাহান্নামে প্ৰবেশ কর।”
যারা কুফরি করে তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা হযরত নূহ ও হযরত লুতের স্ত্রীকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। ওই দুই নারী আল্লাহর দু’জন সৎকর্মশীল বান্দার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও স্বামীদের প্রতি তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ফলে, ওই দুই নবী তাদের স্ত্রীদেরকে আল্লাহর আজাব থেকে রক্ষা করতে পারেননি। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা প্রবেশকারীদের সঙ্গে জাহান্নামে প্রবেশ করো।
এই সূরার গোড়ার দিকের কিছু আয়াতে বিশ্বনবী (সা.) এর কিছু স্ত্রীর ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে যেখানে আল্লাহর রাসূলের মুখ নিসৃত একটি বক্তব্য তিনি এক স্ত্রীকে অন্য স্ত্রীর কাছে বলতে নিষেধ করা সত্ত্বেও যাকে নিষেধ করা হয়েছে তা তিনি অপরকে বলে দিতেন।
অতীতের নবী-রাসূলদের যুগেও এরকম নারীর সন্ধান পাওয়া যায়। হযরত নূহ ও হযরত লুতের গৃহেই তারা বসবাস করত। তবে তারা ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেছিল। তারা নবীদের পক্ষ থেকে প্রদর্শিত পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যেত।
একথা স্পষ্ট যে, নবী-রাসূলদের সঙ্গে নিছক আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলেই কেউ আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না বরং প্রত্যেকে তার নিজ কর্ম অনুযায়ী পুরস্কার বা শাস্তি ভোগ করবে। ঠিক এ কারণেই হযরত নূহ ও হযরত লুতের স্ত্রীগণ নবীর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও পরকালে জাহান্নামি হবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- নবীর স্ত্রী কিংবা সন্তান হওয়া মানেই জাহান্নামের আগুন থেকে নিস্কৃতি নয়। বরং দুনিয়া ও আখিরাতে মানুষের মুক্তি নির্ভর করে জীবনে সে কোন পথ বেছে নিয়েছে এবং কী আমল বা কর্ম নিয়ে সে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়েছে তার উপর।
২- নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ তায়ালা স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কাউকে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করা হয়নি। এ কারণে নবীর স্ত্রী হওয়া এবং তাঁর গৃহে বাস করা সত্ত্বেও তাকে নবীর পথ অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়নি।
৩- পবিত্র ও সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদেরকে তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, কুফর ও ধর্মহীনতা নবীদের গৃহেও অনুপ্রবেশ করেছিল।
এবারে এই সূরার ১১ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“আর যারা ঈমান আনে, আল্লাহ্ তাদের জন্য পেশ করেন ফিরআউনের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত, যখন সে এ বলে প্রার্থনা করেছিল, হে আমার রব! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করুন এবং আমাকে উদ্ধার করুন ফির’আউন ও তার দুষ্কৃতি হতে এবং আমাকে উদ্ধার করুন যালিম সম্প্রদায় হতে।”
হযরত নূহ ও হযরত লুতের স্ত্রীদেরকে কাফির নারীদের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করার পর এই আয়াত এবং তার পরবর্তী আয়াতে অপর দু’জন নারীকে ঈমানের পরিপূর্ণ আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের একজন হলেন ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া ও অপরজন হযরত মারিয়াম। আসিয়া ফিরাউনের রাজপ্রাসাদে বসবাস করতেন এবং একজন সম্রাজ্ঞী হিসেবে সব ধরনের আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতা ভোগ করার উপকরণ তার হাতের কাছে ছিল। কিন্তু তিনি যখন হযরত মূসা (আ.)-এর নবুওয়্যাত সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন তখনই তিনি তাঁর প্রতি ঈমান আনলেন। বিবি আসিয়া ফিরআউনের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন; ফলে ফিরআউনের লোকেরা তাকে চরম নির্যাতন করে শহীদ করে।
হযরত মারিয়ামও সারাজীবন বায়তুল মুকাদ্দাসের সেবা করেছেন এবং সেখানে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থেকেছেন। ফলে তিনি আল্লাহর প্রিয়ভাজন বান্দায় পরিণত হয়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর কোলজুড়ে হযরত ঈসা (আ.)কে দান করেছেন। এই দুই নারী দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ে ও ভিন্ন পরিবেশে বসবাস করলেও দু’জনই আল্লাহর আদেশ-নিষেধের সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী ছিলেন বলে তাদেরকে যুগ যুগ ধরে ঈমানদার নারী ও পুরুষের জন্য আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছেন মহান আল্লাহ। তিনি চান, মুমিন নারী-পুরুষ যে যেখানেই থাকুক না কেন আল্লাহর আদেশ সামনে এসে গেলে সবাই যেন তার আনুগত্য করে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূল ছাড়া অনেক সময় অনেক সাধারণ মানুষও আল্লাহর বান্দাদের জন্য আদর্শ হতে পারে। এমনকি নারীরাও পুরুষদের আদর্শ হতে পারেন। ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়াকে ঈমানদার নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য আদর্শ ঘোষণা করা হয়েছে।
২- পরিবার ও সমাজের ধর্মহীন পরিবেশকে কুফরি করার অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো যাবে না। ফিরআউনের স্ত্রী রাজপ্রাসাদে সম্পূর্ণ কুফরি পরিবেশে থেকেও শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় আল্লাহ তায়ালার একজন প্রিয়ভাজন বান্দায় পরিণত হতে পেরেছিলেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমরা জান্নাতে যাবো নাকি জাহান্নামে যাবো তা আমাদের সিদ্ধান্ত ও চেষ্টা প্রচেষ্টার উপরই নির্ভর করে।
৩- যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং তাঁকে রাজি-খুশি করতে চায় সে ফিরআউনের রাজপ্রাসাদের চাকচিক্যময় জীবন ত্যাগ করে জান্নাতের ঘর পেতে চায়। রাজপ্রাসাদের ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশ তাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।
৪- দ্বীনি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের কাছ থেকে স্বাধীন। কোনো নারী তার স্বামীর ধর্মবিরোধী কোনো নির্দেশ পালন করবে না।
এবারে সূরা তাহরিমের শেষ আয়াত অর্থাৎ ১২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“আর (আল্লাহ আরো দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন) ইমরান তনয়া মারিয়ামের, যে তার সতীত্ব রক্ষা করেছিল, ফলে আমি তার মধ্যে আমার রূহ হতে ফুঁকে দিয়েছিলাম [যার ফলে তার কোলজুড়ে এসেছিল ঈসা]। সে তার প্রতিপালকের বাণী ও তাঁর কিতাবসমূহ সত্য বলে গ্রহণ করেছিল; আর সে ছিল অনুগতদের একজন।”
এই আয়াতে হযরত মারিয়ামের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে যার প্রতিটি বৈশিষ্ট্য সকল মুমিন নর-নারীর জন্য আদর্শ হতে পারে। মারিয়ামের প্রথম বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর সতীত্ব যা সকলের জন্য বিশেষ করে প্রতিটি নারীর জন্য উচ্চস্তরের অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে বিবেচিত। তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং আসমানি কিতাবসমূহকে সত্য বলে গ্রহণ করা। আর তিনি এসব কিতাবকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন বলেই আল্লাহর ইবাদত করে তাঁর একজন খাঁটি বান্দায় পরিণত হতে পেরেছিলেন।
আর এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই আল্লাহ তায়ালা যখন হযরত ঈসা (আ.)কে রিসালাতের দায়িত্ব দিতে চাইলেন তখন হযরত মারিয়ামকে তাঁর মা হিসেবে বাছাই করে নিলেন। কারণ, সে সময় বনি ইসরাইলে সবচেয়ে ঈমানদার ও সতিসাধ্বী নারী ছিলেন বিবি মারিয়াম। পবিত্র কুরআনে একমাত্র যে নারীর নাম এসেছে তিনি হযরত মারিয়াম। এই মহাগ্রন্থে মারিয়ামের নাম ৩০ বারের বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হল:
১- সতীত্ব রক্ষা করা এবং যেকোনো ধরনের অবৈধ যৌনাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করার ওপর প্রতিটি ঐশী ধর্মে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
২- পুত পবিত্র চরিত্রের অধিকারী এবং সতিসাধ্বী থাকতে পারলে নিজের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রহ লাভ করা যায়।
৩- মায়ের সতীত্ব ও পুতপবিত্র চরিত্র সন্তানের চারিত্রিক গঠনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ পবিত্র চরিত্রের অধিকারী নারীদের সন্তানেরা পবিত্র চরিত্রের অধিকারীই হয়।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গে দিলেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/এমএমআই/৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।