কুরআনের আলো
সূরা তাহরিম: ১-৫ (পর্ব-১)
আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা তালাকের আলোচনা শেষ করেছি। কাজেই আজ থেকে এর পরবর্তী সূরা অর্থাৎ সূরা তাহরিমের আলোচনা শুরু হবে। মদীনায় অবতীর্ণ এই সূরাটিতেও ১২টি আয়াত রয়েছে। সূরার প্রথম কয়েকটি আয়াতে একটি হালাল খাবার নিজের জন্য হারাম করার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি বর্ণিত হয়েছে। এ কারণে এই সূরার নাম হয়েছে তাহরিম।
সূরার শেষদিকের আয়াতগুলোতে একজন নেককার নারী ও একজন বদকার নারীর কথা বর্ণিত হয়েছে যাতে মানুষ নেককার নারীকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এবং বদকার মানুষদের প্রদর্শিত পথ বর্জন করে।
প্রথমেই সূরা তাহরিমের ১ ও ২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।”
“হে নবী! আল্লাহ্ আপনার জন্য যা বৈধ করেছেন আপনি তা আপনার স্ত্রীদের সস্তুষ্টির জন্য নিজের ওপর নিষিদ্ধ করছেন কেন? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য [কাফফারা আদায়ের মাধ্যমে] নিজেদের কসমের বাধ্যবাধকতা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, আল্লাহ তোমাদের মনিব-রক্ষক, আর তিনি সর্বজ্ঞাতা, মহা প্রজ্ঞার অধিকারী।”
মহানবী (সা.)-এর কোনো কোনো স্ত্রী অপর কোনো কোনো স্ত্রীকে হিংসা করতেন। ওই সব স্ত্রী হুজুরে পাকের জন্য যেসব খাবার প্রস্তুত করতেন তাতে ভুল ধরতেন তারা। উদাহরণস্বরূপ, তারা বলতেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি একটু আগে যে খাবার খেয়েছেন তা খাওয়ার ফলে আপনার মুখ দুর্গন্ধে ভরে গেছে। এ অবস্থায় মহানবী (সা.) এই সমস্যার সমাধানকল্পে এসব স্ত্রীর মন রক্ষা করার জন্য একবার শপথ করে বললেন: যে খাবারটি খাওয়ার ফলে তাঁর মুখ দুর্গন্ধযুক্ত হয়েছে সে খাবারটি তিনি আর খাবেন না। এ অবস্থায় এই আয়াতটি নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, আপনি কেন নিজেকে কষ্টের মধ্যে ফেলে যে খাবারটি হালাল করা হয়েছে তা নিজের জন্য হারাম করে নিচ্ছেন? এখন আপনি শপথ ভঙ্গের কাফফারা আদায় করে ওই খাবারটি আবার নিজের জন্য হালাল করে নিন। আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার পর হুজুরে পাক (সা.) একজন গোলাম মুক্ত করে দিয়ে খাবারটি নিজের জন্য হালাল করে নেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূলগণ সরাসরি আল্লাহ তায়ালার তত্ত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন এবং তিনি তাদেরকে সঠিকপথ প্রদর্শন করে সিরাতুল মুস্তাকিমে অটল ও অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
২- হালাল খাবার গ্রহণ বা হালাল ইন্দ্রীয়সুখ উপভোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার অনুমতি ইসলামে নেই। কারণ, মহান আল্লাহ চান তিনি তার বান্দাদের জন্য যা কিছু বৈধ করেছেন তা তারা উপভোগ করুক।
৩- স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছে যেন এমন কোনো দাবি জানাতে পারবে না যাতে হালালকে হারাম কিংবা হারামকে হালাল করতে হয়। অন্য কথায় পরিবারে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছে এমন কোনো কিছু যেন না চায় যা আল্লাহ তায়ালা হারাম করেছেন।
৪- আল্লাহর হালাল বিধান নিজের জন্য হারাম করার শপথ করলেও সেই হালালে ফিরে যেতে হলে শপথ ভঙ্গের জন্য কাফফারা আদায় করে নিতে হবে।
এবারে এই সূরার ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“আর স্মরণ করুন—যখন নবী তার স্ত্রীদের একজনকে গোপনে একটি কথা বলেছিলেন। অতঃপর যখন সে তা অন্যকে জানিয়ে দিয়েছিল এবং আল্লাহ নবীর কাছে তা প্ৰকাশ করে দিলেন, তখন নবী এ বিষয়ে ওই স্ত্রীকে কিছু ব্যক্ত করলেন এবং কিছু এড়িয়ে গেলেন। অতঃপর যখন নবী তা তার সে স্ত্রীকে জানালেন তখন সে বলল, কে আপনাকে এটা জানাল? নবী বললেন, আমাকে জানিয়েছেন তিনি, যিনি সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।”
“যদি তোমরা দুই স্ত্রী উভয়ে আল্লাহর কাছে তাওবা কর [তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর], কারণ তোমাদের অন্তর [অন্যায়ের দিকে] ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু তোমরা যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অন্যের পৃষ্ঠপোষকতা কর [তাহলে তোমরা কিছুই করতে পারবে না।] কারণ, নিশ্চয় আল্লাহ্ ও জিবরীল এবং সৎকর্মশীল মুমিনরাও তার সাহায্যকারী । তাছাড়া অন্যান্য ফেরেশতাগণও তার পৃষ্ঠপোষক।”
আগের দুই আয়াতে রাসূলে খোদার কোনো কোনো স্ত্রীর অন্যায় আচরণ বর্ণনা করার পর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, রাসূলের কোনো কোনো স্ত্রীর আরেকটি অপছন্দনীয় কাজ ছিল পরস্পরের কাছে গোপন কথা বলে দেয়া। অথচ এই গোপন কথা বলে দিতে আল্লাহর রাসূল তাদেরকে নিষেধ করেছিলেন।
ইতিহাসে এসেছে, একবার হুজুরে পাক (সা.) তাঁর একজন স্ত্রীকে একটি গোপন কথা জানিয়ে তা অন্য কাউকে না বলার নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই স্ত্রী সে নির্দেশ অমান্য করে আরেকজন স্ত্রীকে তা বলে দেন। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বিষয়টি জানিয়ে দেন। রাসূলে খোদা একথা শোনার পর ওই স্ত্রীর কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা জানতে চান। অবশ্য ওই স্ত্রী যাতে বেশি লজ্জা না পায় সেজন্য তিনি পুরো ঘটনাটি উল্লেখ করেননি।
পরের আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উল্লেখিত দুই স্ত্রীকে অর্থাৎ গোপন কথা প্রকাশকারী ও তা শ্রবণকারী উভয়কে তওবা করার আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে: এই কাজ করার মাধ্যমে তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। যদি তওবা করে এ ধরনের কাজের পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত না থাকো তাহলে বোঝা যাবে, তোমরা সম্মিলিতভাবে রাসূলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছো। অবশ্য তোমরা ষড়যন্ত্র করে রাসূলের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না কারণ, আল্লাহ, ফেরেশতাগণ ও মুমিন ব্যক্তিরা রাসূলের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- নেক ও সৎ স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের গোপনীয় বিষয় রক্ষা করবে। কিন্তু তা যদি কেউ প্রকাশ করে দেয় তাহলে তাকে অপরের প্রতি ষড়যন্ত্র হিসেবে গণ্য করতে হবে।
২- রাসূলুল্লাহ (সা.)ও পারিবারিক পরিবেশে বড় বড় সমস্যার সম্মুখীন হতেন এবং এর কারণ ছিল কোনো কোনো স্ত্রী তার মনোপীড়ার কারণ হতেন। কিন্তু তারপরও আল্লাহর রাসূল নম্র ব্যবহারের মাধ্যমে তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন।
৩- পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য ধৈর্য একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কোনো ভুল দেখলে যেন সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাড়ি মাথায় করে না নেয় বরং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করে।
৪- রাসূলে খোদার বিরুদ্ধে যদি কোনো ষড়যন্ত্র হয় অথবা তিনি অপমানজনক কোনো পরিস্থিতিতে পড়েন তখন মুমিন ব্যক্তিদের কর্তব্য যথাসম্ভব তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করা যাতে শত্রুরা হুজুরে পাকের কোনো ক্ষতি করতে বা তাঁর অবস্থান দুর্বল করতে না পারে।
এবারে সূরা তাহরিমের ৫ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“যদি [নবী] তোমাদের সকলকে তালাক দেয় তবে তার রব সম্ভবত তোমাদের স্থলে তাকে দেবেন তোমাদের চেয়ে উৎকৃষ্টতর স্ত্রী—যারা হবে মুসলিম, মুমিন, অনুগত, তওবাকারী, ইবাদতকারী, সিয়াম পালনকারী, অকুমারী এবং কুমারী।”
রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কোনো কোনো স্ত্রী তার জন্য পীড়াদায়ক পরিস্থিতি তৈরি করা সত্ত্বেও তিনি কখনও কাউকে তালাক দেননি বরং শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। এই আয়াতে রাসূলের স্ত্রীদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হচ্ছে, তোমরা হুজুরে পাকের দয়ার্দ্র আচরণের অপব্যবহার করো না। তোমরা একথা ভেবো না যে, তোমরা যত অসদাচরণই করো না কেন তিনি কখনওই তোমাদেরকে তালাক দেবেন না। বরং তালাক দেয়ার অধিকার তিনি সংরক্ষণ করেন। সেইসঙ্গে তোমরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ নারী ভেবো না কারণ, তিনি যদি তোমাদেরকে তালাক দেন তাহলে তোমাদের চেয়ে ভালো নারীদের তিনি স্ত্রী হিসেবে পাবেন।
এই আয়াতে যোগ্য ও উৎকৃষ্ট নারীদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। বিবাহ করার সময় মুমিন পুরুষদের উচিত এসব বৈশিষ্ট্য দেখে পাত্রী বাছাই করা। বিয়ে করার প্রথম শর্ত হচ্ছে মুসলিম ও মুমিন হওয়া। একজন মুসলমান একজন অমুসলিমকে বিয়ে করতে পারে না। এছাড়া, স্বামীর সামনে বিনয়ী ও অনুগত হওয়া মুমিন নারীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ভুল বা গুনাহের কাজ করে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে ফেলা তাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। আর নামাজি ও রোজাদার হওয়া একজন মুসলিম নারীর অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। মজার ব্যাপারে হচ্ছে, এই আয়াত অনুসারে, বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রী কুমারী নাকি অকুমারী সেটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যদি আগে বর্ণনা করা বৈশিষ্ট্যগুলো কোনো নারীর মধ্যে পাওয়া যায় তাহলে সেই নারী তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা হয়ে থাকলেও তার মর্যাদা এতটুকু কমে যায় না।এই আয়াতের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- তালাক হচ্ছে পারিবারিক মতবিরোধ নিরসনের সর্বশেষ উপায়। ঝগড়ার শুরুতেই তালাক দিয়ে দেওয়া যাবে না। যদি স্ত্রী তার অপরাধে অটল থাকার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে, কোনোভাবেই কথা শুনতে না চায় এবং সারাক্ষণ সংসারে উত্তেজনা সৃষ্টি করে পরিবারের শান্তি কেড়ে নিতে থাকে, তখন হয়তো তালাককে একটি সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
২- বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা নারীদের পুনরায় বিবাহ করার অধিকার রয়েছে। তাদেরকে সারাটা জীবন একাকীত্বে ভুগতে দেওয়া উচিত নয়।
৩- নারীর মর্যাদা তার চারিত্রিক, মানবীয় ও আধ্যাত্মিক গুণাবলীতে নিহিত; তার বয়স, সৌন্দর্য কিংবা কৌমারিত্বে নয়।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গে দিলেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/২৭