জুন ১২, ২০২১ ১৯:৩৫ Asia/Dhaka
  • কোমে নবীবংশের সন্তান হযরত মাসুমা (সালা.)'র পবিত্র মাজার

প্রাপ্ত তথ্যপঞ্জি অনুযায়ী কোম শহরের গোড়াপত্তন হয় পিশদাদিয়ন রাজবংশীয়দের শাসনামলে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে। ইতিহাসে পাওয়া যায় হিজরি ২৩ সালে কোম শহর মুসলমানদের অধীনে আসে। কোমের জনগণের অন্তরের একেবারে গহীনে ইসলামের প্রভাব পড়েছে ভীষণভাবে। উমাইয়া খলিফা এবং আব্বাসিয় খলিফাদের শাসনের সময় তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নবীবংশ বা আহলে বাইতের অনুসারীরা কোমে হিজরত করতেন। এভাবে নবীবংশের অনুসারীদের আগমনে কোম শহরের আয়তন বেড়ে যায়, সেইসাথে নবীপ্রেমিকদের বসতিও বেড়ে যায়।  

বনি উমাইয়া এবং বনি আব্বাসদের শাসনামলে কোমসহ মুসলিম ভূখণ্ডগুলোর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্য বিস্তৃতি লাভ করে। ১৮৯ হিজরিতে অর্থাৎ বাদশা হারুনুর রশিদের শাসনকালে কোম শহরটি ইস্পাহান থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং একটি স্বাধীন শহরের মর্যাদা পায়। সেই থেকে স্বাধীন কোমের নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়। এর ফলে আহলে বায়তের আদর্শ ও চিন্তাধারার ভিত্তি আরও দৃঢ়তা লাভ করে। বিশেষ করে এখানে নবীবংশের সন্তান হযরত মাসুমা (সা) এর পবিত্র মাজার অবস্থিত হবার কারণে কোম শহরের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে।

ইতিহাসের সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায় ফাতেমা মাসুমা (সা) এর মৃত্যুর পর তাঁকে এই কোমে দাফন করার পর থেকে কোম শহরের উন্নতি ও অগ্রগতির ধারার সূচনা হয়। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ইয়াকুবি তাঁর বইতে লিখেছেন তৃতীয় শতকের শেষ দিকে এবং চতুর্থ শতকের শুরুর দিকে কোম শহর মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শহরের মধ্যে পরিগণিত হতো।

আলে বুইয়ে’র শাসনামলে রোকনুদ্দৌলার একজন মন্ত্রী ছিলেন সাহেব বিন আব্বাদ নামে। কোম শহরের ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়েছিল। এ সময় এমনিতেই আব্বাসিয় খলিফাদের সাম্রাজ্য ছোটো হয়ে আসছিল। বিশেষ করে ইরানের ওপর থেকে তাদের সম্প্রসারিত হাত ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছিল। কিন্তু সাহেব বিন আব্বাদের দৃষ্টিতে কোম শহরের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ার কারণে এই শহরের অন্যরকম একটা মর্যাদা ছিল। কিন্তু সালজুকিরা ক্ষমতার মসনদে আসীন হবার পর কোম শহরের ওপর থেকে তাদের সদয় দৃষ্টি কিছুটা হলেও সরে গিয়েছিল।

পঞ্চম শতকের শুরু থেকে কোম শহরের উন্নতি ও অগ্রগতির ধারা পুনরায় শুরু হয় এবং ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝিতে এই অগ্রগতির ধারা ব্যাপকতা লাভ করে। এই উন্নতির  ঊর্ধ্বগতি হঠাৎ থমকে যায় সপ্তম শতকে মোঙ্গলদের নির্বিচার হামলার কারণে। তারা এতো নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছিল যে ছোটো বড়ো কিছুই দেখে নি তারা। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, নির্যাতন আর লুণ্ঠন চালিয়ে ৬২১ হিজরিতে কোম শহরকে একেবারে বিরান করে দিয়ে যায়।

তৈমুরিদের শাসনকালে কোম তার হারানো ঐতিহ্য আবারও ফিরে পেতে শুরু করে। একটা সময় পর্যন্ত ‘দারুস সুলতানাহ’ হিসেবেও কোম মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মির্জা সুলতান মুহাম্মাদ ৮৪৬ হিজরিতে শাহরুখ ওয়ালির পক্ষ থেকে ইরাকের হুকুমতের দায়িত্বে আসীন হবার পর কোম শহরকে তিনি তাঁর শাসনকার্য পরিচালনার মূল কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। মির্জা সুলতান মুহাম্মাদের পরেও আরও অনেক শাহজাদা কোমকে তাঁদের শীতকালীন অবকাশ যাপন কেন্দ্র হিসেবে মনোনীত করেছিলেন।

সাফাভি শাসনামলে কোম শহর আরও বেশি উন্নতি লাভ করে। কারণ এই সময় শিয়া মাজহাবকে ইরানে রাষ্ট্রীয় মাজহাব হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে যিয়ারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের তালিকায় কোম অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে ইরান আফগানদের হামলার শিকার হওয়ায় কোম আবারও আক্রান্ত হয় এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই হামলায় বহু মানুষ মারা যায়। এতা চড়াই উৎরাইয়ের পরও কোম আজও তার অস্তিত্বের স্বাক্ষর সগর্বে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

নবী করিম (সা) এর মহান আহলে বাইতের সন্তান হজরত মাসুমা (সা) এর পবিত্র মাজার এখানে থাকার বরকতে কোম শহরের সুখ্যাতি বেড়ে যাবার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই মাজারের পাশেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য দ্বীনি মাদ্রাসা ও ইসলাম ও ধর্মতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র। গড়ে উঠেছে বিশাল মসজিদসহ আরও অনেক ধর্মীয় স্থাপনা। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এইসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে ব্যাপক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষকগণ এই কোমের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে এসে গবেষণা করছেন আজও।

হিজরি সৌর বর্ষের তের শতকের শুরুর দিকে অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় বিশ শতকের প্রাথমিক পর্বে আয়াতুল্লাহ মিরজায়ি কোমি এই ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তাঁর পর আয়াতুল্লাহ শেখ আব্দুল করিম হায়েরি ইয়াজদি (রহ) ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে কোমে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রের কাজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় অর্থাৎ একেবারে সুসংগঠিত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ ইমাম খোমেনি (রহ) নিজেও আয়াতুল্লাহ শেখ আব্দুল করিম হায়েরির ছাত্র ছিলেন। তিনি আয়াতুল্লাহ হায়েরির মহত্ব সম্পর্কে বলেছেন:

রেজা শাহ পাহলভি যখন ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্র এবং আধ্যাত্মিকতাকেই নির্মূল করার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিল, আয়াতুল্লাহ শেখ আব্দুল করিম হায়েরি তখন এই সেসব অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সুরক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি আমাদের জন্য ওই আমানত রেখে গেছেন যেন আমরাও তা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দিয়ে যেতে পারি’।#

পার্সটুডে/মো. আবুসাঈদ/১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ