জুলাই ১৬, ২০২১ ১৭:২৩ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যে মদের ব্যাপক ব্যবহার ও এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে মদ মানেই ক্ষতি।

মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। মদ পান করলে ক্ষতি হবেই। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ নামের বৈশ্বিক উদ্যোগের গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। আমেরিকার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স এই বৈশ্বিক উদ্যোগের প্রধান কার্যালয় হিসেবে কাজ করেছে। সেখানে দেখা গেছে,সামান্য পরিমাণ মদও মানুষের দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল ফ্রান্সটুয়েন্টিফোর এর প্রতিবেদক সিজরিদ দুমিসাওয়ার এক তথ্যবহুল প্রতিবেদনে জানিয়েছেন,মদপানের ক্ষেত্রে নিরাপদ মাত্রা বলে কিছু নেই। দিনে মাত্র এক গ্লাস মদপান করলেও ক্যান্সার,কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। মদপান হচ্ছে পনের থেকে উনপঞ্চাশ বছর বয়সীদের মধ্যে অকাল মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে,সাধারণ মানুষের মধ্যে মদপানের প্রচলন যত বাড়ছে ততই মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের পরিচালিত এ সংক্রান্ত গবেষণার প্রতিবেদন ২০২১ সালের ১২ মে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গবেষণার জন্য তারা ব্রিটেনের ২৫ হাজার মদ পানকারী ব্যক্তির মস্তিষ্কের মেডিক্যাল স্ক্যান পর্যালোচনা করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ক্লিনিকাল রিসার্চার আনিয়া টোপিওয়ালা জানিয়েছেন, গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে মদপান করার ফলে মস্তিষ্কের ধূসর অংশের ক্ষতি হয়। মস্তিষ্কের এই অঞ্চল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ,এখানে সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রস্তুত হয়।

গবেষক আনিয়া টোপিওয়ালা আরও জানিয়েছেন, মানুষ যত মদপান করে ততই তাদের মস্তিষ্কের ধূসর অংশের পরিমাণ কমে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের আকার আরও ছোট হয়ে আসে এবং আরো মারাত্মক অবস্থায় ব্যক্তির স্মৃতিভ্রংশ দেখা দেয়। মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে গেলে স্মৃতির পরীক্ষায় তার কর্মক্ষমতা দুর্বল হয়। গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, যেকোনো ধরনের মদপান মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। গবেষকেরা স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কোনো মদ খুঁজে পাননি। ওয়াইন, স্পিরিট বা বিয়ার,সব ধরনের সব মদই মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। গবেষকদের মতে, মদপানের নিরাপদ কোনো মাত্রা নেই,অল্প মদপানও মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। মদ শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্ষতি করে আর বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে।

কেবল ইউরোপের দেশগুলোই মদপান সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছে এমন নয়। আমেরিকার সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বা সিডিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে,মদপানের কারণে ২০১৭ সালে ৮৮ হাজার মার্কিন নাগরিক মারা গেছে এবং মদের কারণে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ২৪ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা মদপান করে তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় সব মার্কিন শিক্ষার্থীই ছাত্রাবস্থায় মদপানের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তাদের মধ্যে আবার ৮০ শতাংশের বেশি নিয়মিত মদপানে অভ্যস্ত। পার্সটুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,মার্কিন গবেষকদের এক নতুন সমীক্ষার ফলাফল দেখা যাচ্ছে,গত এক দশকে মার্কিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে মদপানের প্রবণতা চারশো'শতাংশ বেড়েছে। আমেরিকার সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় এক হাজার ৯০০ মার্কিন শিক্ষার্থী মদপানের কারণে মারা যায়।

ঐ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতি বছর ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী প্রায় সাত লাখ শিক্ষার্থী তাদের বন্ধুবান্ধব এবং সহপাঠীদের মাধ্যমে মদপান শুরু করে। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অন অ্যালকোহল অ্যাবিউজের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ৯৭ হাজারের বেশি মার্কিন শিক্ষার্থী মদপানের কারণে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়া, করোনা মহামারির সময় চিকিৎসকেরা বারবারই স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, যারা মদপান করে তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। করোনা থেকে বাঁচতে চিকিৎসকেরা মদ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। মানুষের শারীরিক সুস্থতার ওপর মদের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। চিকিৎসকেরাও বারবারই এ বিষয়ে সতর্ক করেন। কিন্তু মদের ক্ষতির এটাই শেষ সীমানা নয়। মদের বড় ধরণের প্রভাব পরিবার ও সমাজেও পড়ে। এ কারণে বিভিন্ন দেশের পুলিশ এ বিষয়ে সতর্ক। আমেরিকার অ্যালকোহল অ্যাডিকশন সেন্টারের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মদ্যপায়ীরা নিজের ক্ষতি করার পাশাপাশি অন্যদের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে সিএনএন টিভি চ্যানেলের ওয়েবসাইটে জ্যাকলিন হাওয়ার্ডের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে,আমেরিকার মদ্যপায়ীরা নিজেদের ক্ষতি করার পাশাপাশি আরও পাঁচ কোটি ৩০ লাখ মানুষের ক্ষতি করছে। এর অর্থ হলো, আমেরিকার প্রতি পাঁচজন নাগরিকের মধ্যে একজন মদ্যপায়ীদের মাধ্যমে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,মৌখিকভাবে অথবা শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অল্প বয়সীদের মদে আসক্তি শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবার ও সমাজে সহিংসতা বাড়াচ্ছে। এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনাও অনেক বেড়ে গেছে। আমেরিকায় প্রতি চারটি সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে একটি ঘটে মদপানের কারণে। ইউরোপ মহাদেশে মদপানের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্লেষণ করে সেখানকার সরকারগুলো মদপান কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে একাধিক আইন প্রণয়ন করেছে। ইউরোপের সব দেশেই এ সংক্রান্ত একাধিক আইন রয়েছে। যেমন, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো পুরোপুরি নিষেধ। এই আইন অমান্য করলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আজীবনের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিলের বিধান রয়েছে। এছাড়া কোনো কোনো দেশ মদপানের ক্ষেত্রে বয়সসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে।  

যদিও এত সব ক্ষতির পরও ইউরোপীয় দেশগুলো মদকে নিষিদ্ধ করতে রাজি নয়। এর পেছনে একটি কারণ হলো সেসব দেশে মদের প্রতি মানুষের মারাত্মক আকর্ষণ। এছাড়া সরকারগুলো অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হচ্ছে এই খাত থেকে। মদ উৎপাদন শিল্প ও ব্যবসা থেকে সরকার যে কর পায় তা বিশাল অংকের। #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ