ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২২ ১৮:৫৯ Asia/Dhaka

ওষুধ শিল্প এখন বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক শিল্পের একটি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে বিশ্বে এই শিল্পে ১১ লক্ষ কোটি ডলার লেনদেন হয়েছে।

আর ওষুধ শিল্পের প্রায় ৮০ ভাগের নিয়ন্ত্রণ উন্নত দেশগুলোর হাতে। মানুষের জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত এই শিল্পের মালিকদের মুনাফামুখীতা গোটা বিশ্বের সচেতন মানুষের মধ্যে বড় ধরণের উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মানুষ অসুস্থ হলে উৎপাদন ও বিক্রি বেশি হয় ওষুধের। ওষুধের বেশি বিক্রি মানেই কোম্পানিগুলোর মুনাফা।

অভিযোগ রয়েছে কোনো রোগের স্থায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধ খুঁজে বের করতে আগ্রহী নন ওষুধ শিল্পের মালিকেরা। কারণ তারা চান নিরবচ্ছিন্ন মুনাফা। জার্মান চিকিৎসক মাটিয়াস রাটসহ অনেকেই মনে করেন, বিশ্বের ওষুধ শিল্পের মূলেই রয়েছে রোগ ও রোগীকে নিয়ে কাজ করা। রোগের অস্তিত্ব মানেই ব্যবসায় উন্নতি। এ কারণে ওষুধ কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য রোগের মূলে যাওয়া নয়। তারা এমন ওষুধ তৈরি করে যা রোগীর বাহ্যিক লক্ষণগুলোর অবসান ঘটায় এবং ব্যথা উপশম করে। কিন্তু বেশিরভাগ ওষুধ রোগের শেকড় উপড়ে ফেলার জন্য তৈরি হয় না। এ কারণে বলা হয় ড্রাগ ট্রাস্টগুলো এভাবেই বিশ্বব্যাপী গুচ্ছ নিধনযজ্ঞের জন্য দায়ী। ওষুধ উৎপাদন খাতটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে একটা শিল্পখাতে পরিণত হয়। বড় কোম্পানিগুলো তথা পুঁজিপতিরা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতকে অর্থ উপার্জনের বড় মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। এর মাধ্যমে আরও বেশি পুঁজির মালিক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অন্যান্য শিল্পের মতো ওষুধ শিল্পও ক্রেতা ও বিক্রেতা সম্পর্কের সাধারণ নীতি ও রীতি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এখানে রোগীকে সাধারণ নিয়মে ক্রেতা হিসেবে গণ্য করা হয়।

এই খাতেও এখন মানবিকতার চেয়ে মুনাফাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এই শিল্পের কর্তাদের কাছে রোগ ও রোগী হয়ে উঠেছে কাঙ্ক্ষিত যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ওষুধ বাজারে শীর্ষে রয়েছে ফাইজার, মার্ক অ্যান্ড কোং, জনসন অ্যান্ড জনসন, নোভারটিস, সানোফি, গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন, এস্ট্রাজেনেকা এবং বায়ার এগের মতো পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানির প্রত্যেকটি গড়ে উঠেছে ইউরোপ ও আমেরিকায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব কোম্পানি আরও কিছু কোম্পানিকে নিজেদের সঙ্গে সংযুক্ত করে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। গোটা বিশ্বেই এখন তাদের প্রভাব। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতেও প্রভাব রাখছে তারা। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো এসব মোনাফালোভী কোম্পানি মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি খাতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও মানুষের দেহ-মনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত ছিল মানবসেবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা সংগঠনের হাতে। এখন অনেক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞই মনে করেন, প্রচলিত রাসায়নিক ওষুধের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে নতুন নতুন রোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

যেকোনো ওষুধের লিফলেটে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেওয়া থাকে। ওষুধ কোম্পানিগুলোও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি স্বীকার করে। মানুষ সুস্থ থাকার জন্য পরিপূরক হিসেবে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করে, কিন্তু এক পর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কিডনিতে। অনেকের কিডনিতে পাথর হয়। আমেরিকায় ওষুধের অপব্যবহার বিষয়ক জাতীয় সংস্থার পরিসংখ্যানেও বলা হয়েছে, ওষুধের অপব্যবহারের কারণে আমেরিকায় ১৯৯৯ সালে মৃত্যু হয়েছিল আট হাজার ৪৮ জনের। কিন্তু ২০১৭ সালে তা বেড়ে ৪৭ হাজার ৬০০ জনে পৌঁছেছে। কিছু দিন আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস এক নিবন্ধে মার্কিন সমাজে ওপিয়ড ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে এনেছে। ওপিয়ড হচ্ছে প্রাকৃতিক ও শিল্পজাত উপাদানে তৈরি এক ধরণের ব্যথানাশক যা অনেকটাই মরফিনের মতো। নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে পারডু ফার্মা কোম্পানির বিরুদ্ধে একটি মামলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলা হয়েছে, এই কোম্পানি অক্সিকনটিন ওষুধ প্রস্তুত করার পর তা রোগীদেরকে দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদেরকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে, এই কোম্পানি অক্সিকনটিন ওষুধের ঝুঁকি সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা না করেই তা বাজারে ছেড়েছে এবং চিকিৎসকদেরকে ঘুষ দিয়েছে যাতে তারা এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে কিছু না বলে। এ কারণে এই ওষুধটির নেশা তৈরির ব্যাপক ঝুঁকি থাকার পরও তা নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে যেতে পেরেছে প্রস্তুতকারী কোম্পানি। যদিও পারডু ফার্মা তাদের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রফেসর জেফরি সাক্স মনে করেন, এই মামলার ফলে একটি লাভ হয়েছে আর তাহলো এই কোম্পানি এমন প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছে যে, তারা ওপিয়ডের অপব্যবহার রোধে সহযোগিতা করবে এবং খাদ্য ও ওষুধ সংস্থার এ সংক্রান্ত পরামর্শের প্রতি সমর্থন জানাবে। কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে ওষুধের বিষয়ে এত বেশি প্রচার চলে যে, অনেকে অপ্রয়োজনেও ভিটামিন জাতীয় ওষুধ খেতে শুরু করেন। এছাড়া পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ওষুধ সহজলভ্য হওয়ায় এর ব্যবহারও বেশি। তাদের অনেকেই ওষুধের  পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কারণ তারা বিজ্ঞাপনে কেবল ওষুধের ভালো দিক সম্পর্কেই জেনেছে। ওষুধের ঝুঁকি সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়নি।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ