পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-৪৮)
আশাকরি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা বলেছি, অস্ত্রোপচার ও রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাগুলো অন্যান্য দেশের তুলনায় আমেরিকায় ব্যয়বহুল। ২০১৩ সালে হৃৎপিণ্ডের বাইপাস সার্জারির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে খরচ হতো ৭৫ হাজার ৩৪৫ ডলার।
অন্যদিকে, নেদারল্যান্ডস এই খরচ ছিল ১৫ হাজার ৭৪২ ডলার। আর সুইজারল্যান্ডে এই খরচ ছিলো ৩৬ হাজার ৫০৯ মার্কিন ডলার। এমআরআই করতে যুক্তরাষ্ট্রে খরচ হতো ১ হাজার ১৪৫ মার্কিন ডলার, অস্ট্রেলিয়ায় যা ৩৫০ মার্কিন ডলার। কিন্তু আমেরিকায় চিকিৎসা খাতে ব্যয় অনুযায়ী সবচেয়ে মান সম্পন্ন সেবা পায় না জনগণ। সেখানে শিশু মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। ২০১৯ সালে আমেরিকায় শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এই হার অনেক বেশি।
গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশেরও কম মানুষের বসবাস আমেরিকায়। কিন্তু বিশ্বে যে পরিমাণ ঘুমের ওষুধ এবং অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ব্যবহৃত হয় তার ২০ থেকে ২৫ শতাংশই ব্যবহার করেন মার্কিন নাগরিকেরা। যদিও গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরণের ওষুধ দীর্ঘদিন খেতে থাকলে এর প্রতি আসক্তি তৈরি হয়। তখন ঘুমের ওষুধ খাওয়া ছাড়া সাধারণত ঘুম আসতে চায় না। আর ঘুমের ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলে তৈরি হয় উদ্বেগ, বিরক্তি ভাব ইত্যাদি। অধিকাংশ ঘুমের ওষুধ সেডেটিভ হিপনোটিকস নামে পরিচিত। এই ওষুধগুলো উদ্বেগ কমায় এবং ঝিমুনি ভাব তৈরি করে মানুষকে ঘুমের দিকে নিয়ে যায়। তবে গবেষণায় বলা হয়, ঘুমের ওষুধ অযথা খাওয়া ক্ষতিকর। এটি বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, মস্তিষ্কের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া এ ক্ষেত্রে অন্যতম। ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তি কল্পনাক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। দৈনন্দিন কাজ, এমনকি শখের কাজগুলো করার প্রতিও একসময় আগ্রহ হারিয়ে যায়। ঘুমের ওষুধ খেতে খেতে একসময় দেখা যায়, স্বল্প ডোজের ওষুধ আর কাজ করছে না। তখন বড় ডোজের প্রয়োজন হয়।
ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তি অনেক সময় জীবনঘাতীও হতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যাদের মধ্যে ঘুমের ওষুধের আসক্তি আছে, তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। তবে অভিযোগ রয়েছে মার্কিন চিকিৎসকেরা অপ্রয়োজনেও রোগীদেরকে আসক্তি সৃষ্টিকারী ওষুধ খেতে দেন। এ কারণে দেশটিতে ঘুমের অথবা অস্থিরতা কমানোর ওষুধের ব্যবহার তুলনামূলক অনেক বেশি। যদিও এ ধরণের ওষুধ আমেরিকায় বেশি মাত্রায় ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ার মূল কারণ হলো মানুষের মধ্যে মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা বৃদ্ধি। এ ধরণের পরিস্থিতি থেকে সরাসরি মাদক গ্রহণের প্রবণতাও বাড়ছে। আমেরিকায় ডাক্তারেরা ব্যথানাশক ওষুধ খেতেও ব্যাপক উৎসাহিত করেন। একজন চিকিৎসকের মতে, মার্কিন জাতি হচ্ছে মাদকাসক্ত জাতি। তারা সব সময় হৃদয়ের গহীনের শূন্যতা পূরণ করতে পথ খোঁজে। ঘুমের বা ব্যথানাশক ওষুধের প্রতি আসক্তি তাদের হৃদয়ের গভীরে সুপ্ত অশান্তিরই বার্তা দেয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও এটা স্পষ্ট আমেরিকায় ক্রমেই মাদক দ্রব্য এবং অ্যালকোহল জাতীয় নেশাদ্রব্য গ্রহণ বেড়ে যাচ্ছে। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১১৫ জন আমেরিকান মাত্রাতিরিক্ত আফিম জাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণের কারণে মারা যাচ্ছে।
মার্কিন নাগরিক নোরা মানগান 'হেলদিলিভিং' ওয়েবসাইটে মার্কিন চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে আসক্তি সৃষ্টিকারী ওষুধ দেওয়ার প্রবণতা সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। 'মাই লাইফ রুইনড' শিরোনামের একই নিবন্ধে তিনি বলেছেন, আমি একজন শিক্ষিত ও বিবাহিত নারী। আমি গৃহিনী। আমার চার সন্তান আছে। সুখেই জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু হঠাতই সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল এক হাড়ের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার পর। আমি বললাম আমার পায়ের আঙুলে সামান্য ব্যথা। সে আমাকে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিল। এই এক ব্যবস্থাপত্রই জন্ম দিল আরও অসংখ্য ব্যবস্থাপত্রের। তার কাছে প্রতি মাসে গিয়ে অক্সিকোডন ট্যাবলেট লিখে আনতাম। এভাবেই আমার জীবনটা জাহান্নামে পরিণত হয়। আমি ছয় মাসের মধ্যে মারাত্মকভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ি। কিছু দিন পর অক্সিকোডন ট্যাবলেট আমার আর কোনো কাজেই আসছিল না। আমার ব্যথা উপশমে কোনো ভূমিকাই রাখছিল না। এই ওষুধ পুরোপুরি আমাকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলেছিল। অক্সিকোডন অন্যভাবে সংগ্রহ করতে গেলে প্রতি গ্রামের জন্য এক ডলার দিতে হয়। এ কারণে আমি আমার সঞ্চয়ের পুরোটাই এভাবে খরচ করে ফেলেছিলাম। আমার মাথা অন্যদিকে আর কাজই করছিল না।
আমেরিকার চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগও রয়েছে যে, তারা প্রয়োজনের তুলনায় রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা বেশি করতে দেন। অনেক সময় রোগ নিশ্চিত জেনেও চিকিৎসকরা তা দিয়ে থাকেন। কারণ তাদের সবসময়ই রোগীদের মামলায় পড়ার চাপ থাকে। তাই আদালতে যেন লিখিত তথ্য উপস্থাপন করতে পারেন, সে কারণে এটি করে থাকেন বলে মনে করা হয়। এতে রোগীদেরই খরচ বাড়ে। বর্তমানে আমেরিকায় ডাক্তারেরা প্রায় প্রতিটি ব্যবস্থাপত্রেই ঘুমের বা অস্থিরতার ওষুধ লিখে দেন। সেখানে এ ধরণের ওষুধের কারণে যে পরিমাণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা হেরোইন বা কোকেইনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি। ওষুধের ব্যবহারটাই সেখানে মাত্রাতিরিক্ত। এর পেছনে রয়েছে সারাদিনের ওষুধের বিজ্ঞাপনমালা। এর ফলে মানুষ খুব সামান্য সমস্যার জন্যও ওষুধ খেতে উৎসাহবোধ করে। নানা পরিসংখ্যান বলছে, আমেরিকায় গত কয়েক বছরে ব্লাড প্রেশার, রক্তের চর্বি, হতাশা এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগের ওষুধ বিক্রি বেড়েছে। ওষুধের ব্যবহার মানেই ওষুধ কোম্পানিগুলোর রমরমা ব্যবসা। যেকোনো রোগের চিকিৎসার জন্যই ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র নেওয়া জরুরি। কিন্তু চিকিৎসকদের মধ্যে যদি অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখার প্রবণতা থাকে তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে রোগীর জন্য অমঙ্গলই বয়ে আনে। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।