পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (শেষ পর্ব-৫১)
গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যের ওষুধ শিল্প এবং সেখানে ওষুধের অপব্যবহার নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি। আজ আমরা পাশ্চাত্য বিশেষকরে আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করব। আশাকরি শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই আছেন। এখানে বলে রাখছি আজকের আসরের মধ্যদিয়েই ইতি টানবো পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনা।
শিক্ষাবিদদের মতে, গোটা বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থাতেই এখন কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। বিশ্বের সর্বত্রই নতুন প্রজন্মকে নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। কারণ আজকের শিক্ষার্থীরা হাল ধরবে আগামী দিনের। নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে জানার সুযোগ বাড়লেও নানা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ আগের চেয়ে কমছে। শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এর প্রভাব পড়ছে। অনেক দেশের সরকারই নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ ও ইতিহাসের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি অনুসরণ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। ২০১৯ সালের শেষের দিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে আমেরিকার সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতিগত বৈষম্য বিদ্যমান। আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকান বংশোদ্ভূত শিশুরা এমন সব স্কুলে পড়াশোনা করে যেখানে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সবচেয়ে কম।
২০১৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার নাগরিক অধিকার বিষয়ক একটি টিম এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ স্কুল জাতিগত বৈষম্যের দিকে এগোচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া ও টেক্সাসে বসবাসকারী লাতিন আমেরিকান বংশোদ্ভূত শিশুদের অর্ধেকই এমন স্কুলে পড়াশোনা করে যেখানে শিক্ষার্থীদের ৯০ শতাংশই স্বজাতির। ইলিনয়, নিউ ইয়র্ক, ম্যারিল্যান্ড ও মিশিগান অঙ্গরাজ্যের কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থাও একই রকম। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য অতীত থেকেই আমেরিকায় একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৫৪ সালের ১৭ মে'র আগ পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদেরকে শেতাঙ্গ শিশুদের স্কুলে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হতো না। ১৯৫৪ সালের আগে মার্কিন সরকার সব সময় কৃষ্ণাঙ্গদের স্কুলের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ভ শেতাঙ্গ শিশুদের স্কুলের মান বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়েছে। এ কারণে সে সময় থেকেই কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের স্কুলগুলোর শিক্ষার অবস্থা অনেক নিম্নমানের। আর এ কারণে এসব স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণকারীরা উচ্চশিক্ষায় ভর্তির খুব একটা সুযোগ পেত না।
ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৫৪ সালে মার্কিন ফেডারেল আদালত জাতি ও বর্ণ ভিত্তিক আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিলের নির্দেশ জারি করে। কিন্তু বাস্তবে কখনোই এই ব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে বর্ণ বিদ্বেষের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। এ কারণে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও মার্কিন শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্ণবাদ স্পষ্ট। আমেরিকার সরকারি স্কুলগুলোর কর্মকর্তারা নিজেদের স্কুলে মিশ্র জাতি-বর্ণের পরিবর্তে এক বর্ণের মানুষকে ভর্তি করানোর বিষয়ে বেশি আগ্রহী। যেসব স্কুলে বহু জাতি ও বর্ণের সন্তানেরা পড়ালেখা করে সেসব স্কুলে শেতাঙ্গ পরিবারগুলো নিজেদের সন্তানদের ভর্তি করাতে চান না। অন্যদিকে, গত তিন দশকে আমেরিকায় শিক্ষার খরচ চার গুণ বেড়েছে। স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ের শিক্ষা খরচ চালাতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী বড় অংকের ঋণ নিতে বাধ্য হয়। 'দ্য স্টুডেন্ট লোন মেস' নামক বইয়ের লেখক জুয়েল বেস্ট ও এরিক বেস্ট শিক্ষা-ঋণ সম্পর্কে বলেছেন, শিক্ষা-ঋণ অনেকটা বরফের বলের মতো এবং কিছু ভুলের কারণে এর আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে। বর্তমানে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চার কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ঋণের জালে আবদ্ধ। আর এই ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি ডলার। আমেরিকার পিবিএস চ্যানেল এক ডকুমেন্টারিতে দেশটির শিক্ষা ঋণের ইতিহাস পর্যালোচনা করেছে।
আমেরিকার নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কন্সট্যানটাইন ইয়ানলিস বলেছেন, আমেরিকার চার কোটির বেশি ঋণগ্রস্ত শিক্ষার্থীর ১০ শতাংশই ঋণ নেওয়ার দুই বছর পর কিস্তি পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অদূর ভবিষ্যতে এই সংকট আরও বাড়বে। তার মতে, এরিমধ্যে আমেরিকায় শিক্ষা লোনের অবস্থা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ও বিখ্যাত পদার্থবিদ মিচিও কাকু'র মতে আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থা মোটেও মানসম্পন্ন নয়। তার মতে, আমেরিকায় একটি নির্বোধ প্রজন্ম গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রতি বছর এর মাত্রা বাড়ছে। তিনি নিজেই একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে এর জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আপনারা হয়তো বলবেন তাহলে আমেরিকার বিজ্ঞান শিক্ষা-ব্যবস্থা টিকে আছে কীভাবে। এর উত্তর হচ্ছে, আমেরিকার একটি গোপন হাতিয়ার রয়েছে আর তাহলো এইচ-ওয়ানবি ভিসা। যদি এইচ-ওয়ানবি ভিসা না থাকতো তাহলে গুগল বা সিলিকন ভ্যালির কোনো অস্তিত্ব আমেরিকায় থাকতো না।
জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ও বিখ্যাত পদার্থবিদ মিচিও কাকু আরও বলেছেন, এইচওয়ানবি ভিসা হচ্ছে বাছাইকৃত মেধাবীদের জন্য বিশেষ ভিসা। আমেরিকায় অধ্যয়নরত ৫০ শতাংশ পিএইচডির ছাত্র বিদেশ থেকে আসেন। আমেরিকা চুম্বকের মতো কৌশলে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মেধাবীগুলোকে টেনে আনছে। তবে এখন এসব মেধাবী স্বদেশে ফিরতে শুরু করেছে। তারা চীনে ফিরে যাচ্ছেন, ভারতে ফিরে যাচ্ছেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আমেরিকার কংগ্রেসের একজন সদস্য এইচ-ওয়ানবি ভিসা বাতিলের দাবি তুলেছেন। তার মতে বিদেশিরা এসে মার্কিন নাগরিকদের চাকুরির সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। এরপর খোদ 'ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল' এর জবাবে লিখেছে, বাস্তবতা হলো এসব পদের জন্য যে ধরণের দক্ষতা জরুরি, তা কোনো মার্কিন নাগরিকের মধ্যে নেই। ফলে এই দাবিটা সঠিক নয় যে, বিদেশিরা আমেরিকায় এসে চাকরি নিয়ে নিচ্ছে বরং উল্টো ঘটনা ঘটছে। বাস্তবতা হলো, বিদেশিরা আমেরিকায় চাকরির অসংখ্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। আমেরিকায় কর্মরত বিদেশিরা উঁচুমানের প্রযুক্তিবিদ। বাস্তবে তাই ঘটছে। কিন্তু আমেরিকা বর্ণবাদীরা তা বুঝতে পারছে না।
আজকের আসরের মধ্যদিয়েই শেষ হচ্ছে পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনা। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।