আগস্ট ০২, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা দুখান নিয়ে আলোচনা শুরু করব। এই সূরায় ৫৯টি আয়াত রয়েছে। প্রথমেই এই সূরার ১ থেকে ৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১-৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

 حم ﴿١﴾ وَالْکِتَابِ الْمُبِینِ ﴿٢﴾ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِی لَیْلَةٍ مُبَارَکَةٍ إِنَّا کُنَّا مُنْذِرِینَ ﴿٣﴾ فِیهَا یُفْرَقُ کُلُّ أَمْرٍ حَکِیمٍ ﴿٤﴾

“বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম।”

হা, মিম।”(৪৪:১)

সুস্পষ্ট কিতাবের কসম!” (৪৪:২)

আমি এটি নাযিল করেছি এক বরকতময় ও কল্যাণকর রাতে; আমি সব সময় সতর্ককারী ছিলাম।”(৪৪:৩)

সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্থির ও অনুমোদন করা হয়।”(৪৪:৪)

পবিত্র কুরআনের সাতটি সূরা মুকাত্তায়াত হরফহা-মীমদিয়ে শুরু হয়েছে সূরা দুখানের আগের চারটি এবং পরে আরো দুটি সূরাহা-মীমদিয়ে শুরু হয়েছে আগেও আমরা যেমনটি বলেছি, এই হরফগুলোর পর সাধারণভাবে পবিত্র কুরআনের বিশালতা মানব জাতির হেদায়েতে এই মহাগ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আলোচিত হয়েছে

এই সূরায়ও আল্লাহ রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের শপথ করেছেন; যে কিতাবের বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট এবং যার শিক্ষাগুলো সর্বকালের সব মানুষের হেদায়েতের জন্য আলোকবর্তিকা আর বিষয়টি এই মহাগ্রন্থের সত্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ পরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালার কাছে এই কিতাবের মর্যাদা সম্পর্কে বলা হচ্ছে: বছরের সর্বোৎকৃষ্ট সময় অর্থাৎ শবে কদরের রাতে এটি নাজিল হয়েছে

এরপর শবে কদরের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে, এটি একটি বরকতময় রাত এবং রাতে কুরআন নাজিল হওয়ার ফলে মানবজাতির ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্য উদিত হয়েছে এই রাতে পরবর্তী এক বছরের জন্য সৃষ্টিজগতের সবার ভাগ্যের পাশাপাশি আগামী এক বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলিও নির্ধারিত হয়

এখানে বলা হচ্ছে, এই কিতাব মানবজাতিকে সতর্ক করার জন্য নাজিল হয়েছে যেমনটি নাজিল হয়েছিল এর পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলো মানুষ যাতে তার সৃষ্টির রহস্য চূড়ান্ত গন্তব্যের কথা ভুলে গিয়ে তার মূল্যবান জীবনকে বিপথে পরিচালিত না করে সেজন্য মহান আল্লাহ এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি যুগের জালিম পথভ্রষ্টদের জন্য এরকম আসমানি কিতাব নবী পাঠিয়েছেন এবং এই ধারার সর্বশেষ নবী রাসূল হলেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)

এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

- ইসলামি সংস্কৃতিতে কিছু কিছু দিনক্ষণ পবিত্র এবং এই সময়গুলো অত্যন্ত মর্যাদাবান শবে কদর এমনই একটি সময় যখন কুরআন নাজিল হয়েছে এবং মানুষের এক বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়

- মানুষের আত্মিক উন্নতির জন্য রাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারণে ইসলামে রাত্রিকালীন ইবাদত কান্নাকাটি করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে

- যে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ উদাসীন সেখানে জান্নাতের সুসংবাদ শোনানোর চেয়ে জাহান্নামের ব্যাপারে সতর্ক করা বেশি জরুরি

সূরা দুখানের ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 أَمْرًا مِنْ عِنْدِنَا إِنَّا کُنَّا مُرْسِلِینَ ﴿٥﴾ رَحْمَةً مِنْ رَبِّکَ إِنَّهُ هُوَ السَّمِیعُ الْعَلِیمُ ﴿٦﴾

আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে এবং আমি ছিলাম [রাসূলগণের] প্রেরণকারী।”(৪৪: ৫)

“[এসব] আপনার রবের পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”(৪৪:৬)

পবিত্র কুরআন নাজিল সম্পর্কে আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: কুরআন নাজিল ও রাসূলগণের নবুওয়াতপ্রাপ্তি- এ দুটি বিষয়ই আল্লাহর নির্দেশে সংঘটিত হয় এবং বান্দাদের প্রতি করুণা ও দয়াপরবশ হয়েই তিনি তাদের কাছে হেদায়েতের এসব মাধ্যম পাঠান

এটা সুস্পষ্ট যে, পার্থিব জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা যেসব নেয়ামত দান করেছেন সেগুলো তখনই পূর্ণতা পায় যখন এর সঙ্গে মানুষের চিরকালীন সুখের আবাসে থাকার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও তাকে জানানো হয় আর সে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্যই যুগে যুগে নবী-রাসূল ও আসমানি কিতাব পাঠানো হয়েছে আল্লাহ নবী-রাসূলও পাঠিয়েছেন মানুষের মধ্য হতেই যাতে তাঁরা মানুষের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ হতে পারেন 

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

- পবিত্র কুরআনের আদ্যোপান্ত প্রতিটি অক্ষর আল্লাহর বাণী; এখানে রাসূলের নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই

- শুধু কিতাব নাজিল হওয়া যথেষ্ট নয় এটির যেমন ব্যাখ্যাকারী প্রয়োজন তেমনি নিজেদের জীবনে এই কিতাবের দিকনির্দেশনা বাস্তবায়ন করে দেখানোর মতো আদর্শ মানবও প্রয়োজন যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ এই মহামানবের ভূমিকাই পালন করেছেন

- মানবজাতিকে সৎপথ প্রদর্শন আল্লাহ তায়ালার রহমতের নিদর্শন কিন্তু দুঃখজনভাবে বেশিরভাগ মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার এই রহমত থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করে রেখেছে

সূরা দুখানের ৭ও৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَمَا بَیْنَهُمَا إِنْ کُنْتُمْ مُوقِنِینَ ﴿٧﴾ لا إِلَهَ إِلا هُوَ یُحْیِی وَیُمِیتُ رَبُّکُمْ وَرَبُّ آبَائِکُمُ الأوَّلِینَ ﴿٨﴾

যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর রব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও।”(৪৪:৭)

তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান; তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃপুরুষদেরও রব।”(৪৪:৮)

মক্কার মুশরিকরা আসমান জমিনের পাশাপাশি বাতাস বৃষ্টির মতো বিষয়গুলোর জন্য আলাদা আলাদা সৃষ্টিকর্তা স্থির করত এবং এগুলোর জন্য আলাদা আলাদা মূর্তি তৈরি করে সেগুলোর পূজা করত কিন্তু এই আয়াতের তাদের সেই ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনে বলা হয়েছে, আসমানসমূহ যমিন এবং এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ এবং তিনি একক সত্ত্বা   কারণে তিনি ছাড়া আর কেউ ইবাদত পাওয়ার যোগ্য হতে পারেন না

যদি কেউ আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে সুনিশ্চিত হতে চায় তাহলে তার জন্য আল্লাহর একক সত্ত্বা একক সিদ্ধান্তকারী ক্ষমতাই যথেষ্ট আমাদের দৃষ্টিতে যা কিছু দেখা যায় তার সবকিছুতেই আল্লাহর একক সত্ত্বার নিদর্শন ধরা পড়বে কাজেই আমাদেরকে শুধুমাত্র তাঁর কাছে ধর্না দিতে এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে হবে  

তিনি শুধু যে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক তা নয় বরং তিনি তোমাদের তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও প্রতিপালক তিনি ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই এবং জীবন মৃত্যু তাঁরই হাতে মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জটিল বিষয় হচ্ছে এই জীবন মৃত্যু এবং এটি আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

- বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা, মালিক পালনকর্তা একই সত্ত্বা এবং সেই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে সৃষ্টিজগত পরিচালিত হচ্ছে

- আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন আসমান যমিনের সেই একক স্রষ্টা আল্লাহ এবং তাঁর দেয়া বিধাবিধান প্রকৃতির বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ

- পূর্বপুরুষদের ভ্রান্ত বিশ্বাস রীতির অনুসরণ না করে মানুষের উচিত সেই আল্লাহর ইবাদত করা যিনি তাদের পাশাপাশি তাদের পূর্বপুরুষদেরও সৃষ্টি করেছেন#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ