আগস্ট ০২, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা দুখান নিয়ে আলোচনা করব। এই সূরায় ৫৯টি আয়াত রয়েছে। এবার এই সূরার ১৯ থেকে ২৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১৯-২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَأَنْ لا تَعْلُوا عَلَى اللَّهِ إِنِّی آتِیکُمْ بِسُلْطَانٍ مُبِینٍ ﴿١٩﴾ وَإِنِّی عُذْتُ بِرَبِّی وَرَبِّکُمْ أَنْ تَرْجُمُونِ ﴿٢٠﴾ وَإِنْ لَمْ تُؤْمِنُوا لِی فَاعْتَزِلُونِ ﴿٢١﴾

“আর তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করো না, নিশ্চয় আমি তোমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছি।”(৪৪:১৯)

“তোমরা যাতে আমাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করতে না পার, সেজন্য আমি আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালকের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” (৪৪:২০)

“‘আর তোমরা যদি আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন না করো, তবে আমাকে ছেড়ে চলে যাও এবং আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।”(৪৪:২১)

গত আসরে আমরা বলেছিলাম, আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আ.)কে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ফেরাউনের দরবারে গিয়ে তাকে বনি ইসরাইল জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে দেয়ার আহ্বান জানান। এর পরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আজকের এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে: হে ফেরাউন সম্প্রদায়! আমি নবুওয়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছি এবং তোমাদের সামনে প্রয়োজনীয় মুজিযাও পেশ করেছি। কাজেই এখন তোমরা আল্লাহর আদেশ মেনে নাও। তাঁর আদেশের সামনে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন বা তাঁর নির্দেশ অমান্য করো না।

হে ফেরাউন সম্প্রদায়! তোমরা একথা ভেবো না যে, তোমরা যদি আমাকে হত্যা করার হুমকি দাও তাহলে আমি যে পথ বেছে নিয়েছি তা থেকে ফিরে যাব। আমি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। কাজেই আমি তোমাদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। তিনি চাইলে আমাকে সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত রাখবেন। আর যদি তোমরা তারপরও ঈমান না আনো তাহলে আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:

১- নবী-রাসূলগণ মানুষকে সত্যের দাওয়াত দেয়ার সময় এমন সব নিদর্শন নিয়ে আসতেন যা সবার বোধগম্য ছিল। এরপরও যারা সত্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করত তারা ছিল উদ্ধত ও অহংকারী। বিষয়টি এমন ছিল না যে, নবীগণকে চিনতে না পারার কারণে তারা ঈমান আনেনি।

২- সত্যের দাওয়াত দিতে গিয়ে শত্রুদের চাপপ্রয়োগ, হুমকি কিংবা নির্যাতন যেন আমাদেরকে সংকল্প থেকে দূরে রাখতে বা দাওয়াতের পথ থেকে বিরত রাখতে না পারে।

৩- দ্বীনি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো কখনো আত্মম্ভরী লোকদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া প্রয়োজন যাতে অন্য মানুষের কাছে দাওয়াতের বাণী পৌঁছে দেয়ার পথ খোলা থাকে।

সূরা দুখানের ২২ থেকে ২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

فَدَعَا رَبَّهُ أَنَّ هَؤُلاءِ قَوْمٌ مُجْرِمُونَ ﴿٢٢﴾ فَأَسْرِ بِعِبَادِی لَیْلا إِنَّکُمْ مُتَّبَعُونَ ﴿٢٣﴾ وَاتْرُکِ الْبَحْرَ رَهْوًا إِنَّهُمْ جُنْدٌ مُغْرَقُونَ ﴿٢٤﴾

“[ফেরাউন সম্প্রদায় মূসার কথা মেনে নেয়নি] অতঃপর সে তার রবকে ডেকে বলল, নিশ্চয় এরা এক অপরাধী সম্প্রদায়।”(৪৪:২২)

“অতঃপর [আল্লাহ বলেন:] তুমি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতের বেলায় বের হয়ে পড়, কারণ, তোমাদের পশ্চাদ্ধাবন করা হবে।”(৪৪:২৩)

“সমুদ্রকে শান্ত অবস্থায় পেছনে ফেলে এসো, ওরা এমন এক বাহিনী যা ডুবে মরবে।”(৪৪:২৪)

হযরত মূসা (আ.) সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়েও যখন ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গকে ঈমানের পথে আনতে পারলেন না তখন তিনি আল্লাহর কাছে এই অপরাধী সম্প্রদায়কে শাস্তি দেয়ার আবেদন জানান। তখন আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আ.)কে ফেরাউনের দাসত্বে বন্দি থাকা বনি ইসরাইল জাতিকে প্রস্তুত করে রাতের অন্ধকারে মিশর থেকে ফিলিস্তিনে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এরকম অবস্থায় ফেরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বনি ইসরাইল জাতির পশ্চাদ্ধাবন করবে- এটাই স্বাভাবিক।

আল্লাহ তায়ালা বনি-ইসরাইল জাতিকে এই প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, তাদের জন্য প্রবল খরস্রোতা নীল নদ এমনভাবে শান্ত হয়ে যাবে যে, তারা নদীর ভেতর তৈরি হওয়া রাস্তা দিয়ে ওপারে চলে যেতে পারবে। তবে তারা যেন ফেরাউন ও তার বাহিনীর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হয়।  কারণ, ওই বাহিনী নীল নদে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করতে পারবে ঠিকই কিন্তু তারপর আল্লাহর আদাশে এই নদীতে তাদের সলিল সমাধি হবে।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মানুষ যখন অতিমাত্রায় গুনাহ ও পাপকাজে নিমজ্জিত হয়ে যায় তখন তার ওপর নবী-রাসূলগণের বক্তব্য কোনো প্রভাব ফেলে না এবং তারা সত্যের বাণী গ্রহণ করে না।

২- দোয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে চেষ্টাও চালাতে হবে। আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব পালন করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে সাফল্য চাইতে হবে যাতে তিনি আমাদের কাজকে সহজ করে দেন।

সূরা দুখানের ২৫ও ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

کَمْ تَرَکُوا مِنْ جَنَّاتٍ وَعُیُونٍ ﴿٢٥﴾ وَزُرُوعٍ وَمَقَامٍ کَرِیمٍ ﴿٢٦﴾ وَنَعْمَةٍ کَانُوا فِیهَا فَاکِهِینَ ﴿٢٧﴾ 

“ওরা পশ্চাতে রেখে গিয়েছিল কত বাগান ও ঝরনা।”(৪৪:২৫)

“শ্যামল শস্যক্ষেত ও সুরম্য বাসস্থান ও প্রাসাদ।” (৪৪:২৬)

“আর নানা বিলাস-সামগ্রী, যাতে তারা আনন্দ উপভোগ করত।” (৪৪:২৭)

আগের আয়াতে ফেরাউন ও তার বাহিনীর নীল নদে ডুবে মারা যাওয়ার কথা জানানোর পর এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: যে ফেরাউন নিজেকে সৃষ্টিকর্তা বলে দাবি করত সে ও তার বাহিনী বিপুল পরিমাণ পার্থিব সম্পদ ও ভোগের সামগ্রী রেখে হতভাগ্যের মতো মৃত্যুবরণ করেছিল। এসব সুরম্য প্রাসাদ, বাগ-বাগিচা ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি সব বনি ইসরাইল জাতির হস্তগত হয়।  বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কয়েক ঘণ্টা আগেও যে মানুষগুলো ছিল ক্রীতদাস তারা কয়েক ঘণ্টা পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, সিংহাসন, সবুজ ফসলের খেত ও ফলের বাগানসহ নানারকম পার্থিব সম্পদের অধিকারী হয়ে যায়।

এসবই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার মুজিযা বা অলৌকিক নিদর্শন। হযরত মূসা (আ.) তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে নীল নদের পানিতে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর দিয়ে চলাচলের বিশাল রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। বনি ইসরাইল জাতির লোকেরা ওই পথ অতিক্রম করার পর ফেরাউন ও তার বাহিনী যখন একই রাস্তা ধরে নদীর মাঝখানে চলে আসে তখন নদীর পানি আবার প্রবাহমান হয় এবং সেই পানিতে সবাই ডুবে মারা যায়।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার কাছে অন্য সব ইচ্ছার পরাজয় ঘটে। প্রবল পরাক্রমশালী ফেরাউনের সশস্ত্র ও ঘোরসওয়ার বাহিনী ভুখা-নাঙা ও পায়ে হেঁটে চলা একদল মানুষকে পাকড়াও করতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় উল্টো সশস্ত্র বাহিনী ধরাশায়ী হয় ও ভবলীলা সাঙ্গ করে।

২- পার্থিব সম্পদ ও ভোগবিলাসের সামগ্রী মানুষকে নিরাপত্তা বা মুক্তি দিতে পারে না। মানুষ যত বড় শক্তিশালী প্রাসাদেই বসবাস করুক না কেন আল্লাহ পাকড়াও করতে চাইলে তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ