বাংলাদেশে বেড়েছে যৌন সহিংসতা, রেহাই পাচ্ছেন না মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকরাও
বাংলাদেশে সম্প্রতিক সময়ে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তারা ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টা ও নানাধরনের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া, বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা নিয়মিত যৌন অপরাধের শিকার হচ্ছেন সৌদি আরবসহ বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যের দেশে।
চলতি বছর প্রথম ১০ মাসে বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২৫৩ নারী, ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ২০০ নারী, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২২১ নারী, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২৫১, ধর্ষণের পর হত্যা ৬২ জন, ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছেন ৩ নারী ও ২ পুরুষ, ধর্ষণের শিকার ৭৬৭ শিশু, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৩৫ শিশুকে এবং যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে ৮০ মেয়ে শিশু এবং ২৬ ছেলে শিশু।
ন’টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সন্বিবেশিত করে দেশের কয়েকটি নারী অধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে, গতকাল সোমবার রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘ধর্ষণ ও সকল যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা’ ব্যানারে প্রতীকী অনশন করেছেন বিভিন্ন মানবাধিকার, নারী অধিকার, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েক শ’ সদস্য।
অনশনে অংশ নেন ‘আমরাই পারি’ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশি কবির, নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা শিরীন হক।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নির্যাতনের শিকার নারী, সড়ক পরিবহনে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার সিরাজগঞ্জের রূপার ভাই, ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে মৃত পিংকির পরিবার, আশুলিয়ার শ্বশুরবাড়িতে নিহত সাতক্ষীরার মুক্তির ভাই, দিনাজপুরে মৃত আঁখি মনির বাবাসহ বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের শিকার নারী ও তার পরিবারের সদস্যরা।
অনশন কর্মসূচিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমাদের মানসিক অবস্থা এমন হয়েছে যে, বিচার চাইলেও পাব না। আমরা বিভিন্ন সময় এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, বিভিন্ন জায়গায় কথা বলেছি, কিন্তু নির্যাতন বেড়েই চলেছে। এর প্রধান কারণ, আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি। ঘটনা ঘটার পর দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী বললে বিচার হবে, না বললে হবে না। এজন্য অনেক সময় বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে বলতে হয়- ‘বিচার চাই।’
প্রতীকী অনশন শেষে উপস্থিত সকলের স্বাক্ষর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর একটি স্মারকলিপি পাঠানো হয়। স্মারকলিপিতে নারী ও শিশু ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা বন্ধ করা, দ্রুত ও ন্যায্য বিচারের জন্য বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়।
এ প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ড. নুর মোহাম্মদ জানান, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ দমনে দেশে কার্যকর রয়েছে 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন' এবং প্রতি জেলায় স্থাপন করা হয়েছে বিশেষ ট্রাইবুনাল।
তবে নারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের আর একই ভয়ঙ্কর দিক তুলে ধরেছেন ভুক্তভোগী নারীরা। তারা জানিয়েছেন, কর্মসংস্থানের নামে বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে নারী শ্রমিকদের যৌন নির্যাতনের শিকার বানানো হয়। অনেকে সেখানে মারাও যান। পরে লাশ হয়ে দেশে ফিরে আসেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি তাদের দালালদের মাধ্যমে তরুণীদের বেশি বেতনে চাকরীর লোভ দেখিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে এমন অপরাধ করছে। গতকালই আইন শৃংখলাবাহিনী নারায়ণগঞ্জে থেকে এরকম একটি পাচারকারী দল আটক করেছে।
নারী শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার, ‘নারী শ্রমিক কণ্ঠ’ নামক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন ২৬ হাজার ৭৫২ জন নারী কর্মী। এ বছর গত ৯ মাসেই দেশে ফিরেছে প্রায় ৩ হাজার নারী কর্মীর লাশ। এর কারণ হিসেবে সরকারের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন যথাযথভাবে না মানাকেই দায়ী করছেন সংগঠনটির নেতারা।
লিখিত বক্তব্যে কর্মজীবী নারীর পরিচালক রাহেলা রব্বানী বলেন, উন্নত জীবনের আশায় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়া নারী অভিবাসী শ্রমিকরা প্রতিদিনই মারাত্মকভাবে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের পক্ষে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকারের কোনো পর্যায় থেকে কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। ফলে নারী শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশে ফিরছে অভিবাসী শ্রমিক নারীর মৃতদেহ। রাহেলা রব্বানী নারী অভিবাসী শ্রমিকদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় ১৩টি দাবি তুলে ধরেন।#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।