করোনাভাইরাস: বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে
(last modified Sat, 26 Sep 2020 12:52:28 GMT )
সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২০ ১৮:৫২ Asia/Dhaka
  • করোনাভাইরাস:  বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে

পাবনার সুজানগর উপজেলার ফুলালদুলিয়া গ্রামের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী পনের বছরের কিশোরী সুমা খাতুনের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী উপজেলার এক যুবকের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল বুধবার সন্ধ্যায়। বাল্য বিবাহের এ বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রওশন আলী পুলিশ ফোর্স নিয়ে হাজির হলে কনে ও তার মা-বাবা এবং বরসহ বরযাত্রীরা পালিয়ে যায়। তবে বিয়ের কাজী পালাতে না পারায় পুলিশ তাকে আটক করে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরে তাকে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়।

সম্প্রতি গাইবান্ধা জেলার ধর্মপুর এলাকার এরকম একটি ঘটনায় ১৪ বছর বয়সী স্কুলপড়ুয়া এক কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হয়। চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ নম্বরে প্রতিবেশীদের ফোন পেয়ে স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বাল্যবিবাহটি বন্ধ করতে সক্ষম হয়।  

করোনাকালের অভাবী পরিবারে বাল্যবিবাহের এরকম দু’একটি ঘটনা প্রশাসন অবহিত হয়ে বন্ধ করতে পারলেও এমন অসংখ্য ঘটনা প্রশাসনের আগোচরেই ঘটে যাচ্ছে।  

সমাজ বিশ্লেষকগণ বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সময়ে দেশে বাল্যবিবাহ প্রায় দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেশীরা বিষয়গুলো জেনে-বুঝেও অনেক সময় পরিবারের আর্থিক অনটনের কথা ভেবে তা বন্ধ করতে পারছে না।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে করোনার কারণে উপার্জন কমে যাওয়া দরিদ্য পরিবারটি অনেকটা গোপনে, কোনো রকম আয়োজন ছাড়াই কিশোরী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ঘরে আহারের মুখ কমাতে চাইছে। স্কুলে লেখাপড়া বন্ধ থাকায় বাড়ন্ত মেয়েটির নিরাপত্তা ও বখাটেদের উৎপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে দরিদ্র পরিবারটি মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে ঝামেলামুক্ত হতে চাইছেন। এসব কারণে বাড়ছে বাল্যবিবাহ।

তাছাড়া, করোনা মহামারি কালে কম খরচে ও স্বল্প যৌতুকে বিয়ে দেওয়ার সুযোগও  বাল্যবিবাহর অন্যতম কারণ বলে জানান বিশেষজ্ঞজনরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বন্যা এবং কোভিড-১৯ মহামারি বাল্যবিবাহের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকা ও চরাঞ্চলে এবং দেশের উপকূলীয় এবং প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে।

এ প্রসংগে বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভানেত্রী সীমা দত্ত রেডিও তেহরানকে বলেন, করোনাকালে অভাবে পড়া পরিবারের বাবা-মা  তাদের কন্যা সন্তানকে বাল্যাবস্থায় বিয়ে দিচ্ছে এটা যেমন সত্য তেমনি এরকম অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে যে,  ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারাও দরিদ্রও পরিবারের কন্যাকে বাল্য বিবাহ দিতে  বাধ্য করছে। সম্প্রতি রাজধানীর কুড়িল বস্তিতে  এমন ঘটনার অভিযোগ করেছে  কয়েকটি  ভুক্তভোগী পরিবার ।

সীমা দত্ত আরো জানান,  আজ গোটা দেশে নারী, কিশোরী ও কন্যা সন্তান যেভাবে ক্রমবর্ধমান হত্যা, ধর্ষণ , গণধর্ষণ ও যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছে এবং তার সাথে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের সম্পৃক্ততার যে সব ভয়ানক খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে তাতে দেশবাসী আতংকিত। এ অবস্থায় দরিদ্র ও আতংকগ্রস্ত পরিবারটি কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিয়ে নিরাপদ বোধ করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক।

তাছাড়া মাদকের ছড়াছড়ি ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যৌনতা, অশ্লীলতা ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণেও সমাজে নারীদের নিরাপত্তা আরো ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সীমা দত্ত বলেন, এরকম পরিস্থিতিতে দরিদ্র পরিবারগুলিকে খাদ্যসাহায্য দেওয়া এবং তাদের নারী ও কন্যা সন্তানদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।তাছাড়া, জনগণকেও ভয়ভীতি কাটিয়ে নারী ও কন্যাদের রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে।

বাল্যবিবাহর ক্ষেত্রে বিশ্বের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম দিকে। ইউনিসেফের তথ্য মতে, দেশের ৫৯ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগেই। আর ২২ শতাংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগে। বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ ৫৭ হাজার নারী-শিশুকে ফোন দিয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে বলা হয়, চলতি বছরের জুনে ৫৩টি জেলায় ৪৬২টি বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।

প্রসঙ্গত, সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় এবং সারা দেশে বিপদে পড়া শিশুদের সাহায্য করে থাকে। প্রতিটি উপজেলায় চাইল্ড হেল্পলাইনের মোবাইল টিম কাজ করছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও সংস্থাটির কর্মীরা কাজ করছেন।

ইউনিসেফের সহযোগিতায় পরিচালিত চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর ব্যবস্থাপক চৌধুরী মো. মোহাইমেন বলেছেন, করোনা সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।

তিনি জানান, ‘চলতি বছরের এপ্রিলে চাইল্ড হেল্পলাইনে বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত ৪৫০টি ফোনকল আসে। অথচ মার্চে এ সংখ্যা ছিল ৩২২। মহামারির আগে যেখানে আমরা বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত ১০০টি কল পেতাম, এখন সেখানে কমবেশি ১৮০টি ফোনকল পাচ্ছি।’

চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর তথ্য থেকে জানা যায়, এ সময়ে বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত ফোনকলের সংখ্যা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। অনেক পরিবারই করোনার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্রামে ফিরে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের অভিভাবকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মেয়েদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আবার করোনাকালে অনেক প্রবাসী অবিবাহিত যুবক দেশে ফিরে এসেছেন। বাবা-মাও তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাকে এরকম যুবকদের নিকট বিয়ে দিতে নিরাপদ বোধ করছেন।#

 

পার্সটুডে/আব্দুর রহমান খান/ বাবুল আখতার/ ২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

 

ট্যাগ