ইরান কেন আমেরিকাকে বিশ্বাস করে না: ইতিহাস, অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা
(last modified Sun, 04 May 2025 13:50:40 GMT )
মে ০৪, ২০২৫ ১৯:৫০ Asia/Dhaka
  • ইরান কেন আমেরিকাকে বিশ্বাস করে না: ইতিহাস, অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা

সাইফুল খান: ইরান-আমেরিকা সম্পর্কের দ্বন্দ্ব কোনো হঠাৎ সৃষ্ট রাজনৈতিক সমস্যা নয়। এটি দীর্ঘ সাত দশকের সংঘাত, ষড়যন্ত্র ও একতরফা আধিপত্যবাদের ফল। এই সম্পর্কের প্রতিটি অধ্যায় যেন ইরানিরা তাদের রক্ত ও অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখেছে।

আধুনিক ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা রয়েছে, যেগুলো ইরানিদের মনে আমেরিকার প্রতি এক গভীর অবিশ্বাস ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। এই নিবন্ধে আমরা সেই ঘটনাগুলো, তাদের প্রেক্ষাপট, ইরানি জনগণের অভিজ্ঞতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করব:

১. ১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থান: গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রথম খোঁচা

ইরানে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ১৯৫১ সালে Anglo-Iranian Oil Company জাতীয়করণ করেন। এতে ব্রিটিশ ও মার্কিন স্বার্থে আঘাত লাগে। এর পরিণতিতে সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা MI6 যৌথভাবে " Operation Ajax" নামের এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৫৩ সালে মোসাদ্দেক সরকারকে পতন করিয়ে শাহ রেজা পাহলভিকে ক্ষমতায় বসায়।

এই ঘটনার মাধ্যমে ইরানিদের মনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে এক তীব্র অনাস্থা জন্ম নেয়। ইরানিসমাজ বুঝে যায় যে, আমেরিকা কেবল গণতন্ত্রের মুখোশ পরে আছে, আসলে তাদের আসল উদ্দেশ্য ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা। ইরানের সম্পদ ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। হাজার বছরের পুরাতন সভ্যতা ও শিক্ষার দেশ ইরানকে সদ্য জন্ম নেয়া বহুজাতিক আমেরিকা পরিচালনা করবে! এটা ইরানিদের আত্মমর্যাদা, আভিজাত্য আর ইতিহাসের নির্মাণের সাথে কেবলই সাংঘর্ষিক।

২. শাহের স্বৈরতন্ত্র ও সাভাক-এর দমন-পীড়ন: মার্কিন সমর্থন

মোসাদ্দেক পতনের পর আমেরিকার সমর্থনে শাহ ইরানে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেন। তার শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয় সাভাক (SAVAK) নামের ভয়ঙ্কর গোয়েন্দা সংস্থা। মার্কিন প্রশিক্ষণে গড়ে ওঠা এই বাহিনী অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের গুম, আটক ও হত্যায় অংশ নেয়।

শাহের পশ্চিমঘেঁষা নীতিতে ইসলামি ঐতিহ্য, পোশাক ও সমাজব্যবস্থা আক্রান্ত হয়। ইরানিরা এই শাসনকে কেবল অভ্যন্তরীণ নয়, বরং মার্কিন আধিপত্যের এক ছায়া সরকার হিসেবে দেখেছিল।

৩. ইসলামি বিপ্লব (১৯৭৯): আত্মপরিচয়ের বিপ্লব

১৯৭৯ সালের বিপ্লব কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়; এটি ছিল একটি জাতির আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধারের আন্দোলন। শাহ পালিয়ে গেলে ইরানি জনতা আমেরিকার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, কারণ তারা মনে করত আমেরিকা তাদের স্বৈরশাসককে রক্ষা করেছিল।

তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস দখল ও ৫২ জন কূটনীতিককে বন্দি রাখা হয় ৪৪৪ দিন। এই ঘটনা ইরান-আমেরিকার সম্পর্ককে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইরান এই দূতাবাসকে "স্পাই হাউজ" হিসেবে ঘোষণা করে।

৪. ইরান-ইরাক যুদ্ধ ও আমেরিকার পক্ষপাত

১৯৮০ সালে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে আমেরিকা সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ইরাককে সমর্থন করে। অস্ত্র, গোয়েন্দা তথ্য, এমনকি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে চুপ থাকার অভিযোগ ওঠে।

যুদ্ধে প্রায় তিন লাখের বেশি ইরানি শহীদ হন। তারা স্পষ্টভাবে দেখে যুদ্ধ ইরানের মাটিতে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব সাদ্দামের পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমেরিকার প্রতি ঘৃণা আরও গাঢ় হয়।

৫. ইরান এয়ার ৬৫৫ ট্রাজেডি: নিরীহ যাত্রীদের মৃত্যুও মাফ হয়নি

১৯৮৮ সালে আমেরিকার ইউএসএস ভিনসেন্স রণতরী ইরান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করে। এতে ৬৬ শিশুসহ ২৯০ জন নিহত হন। আমেরিকা এটিকে ভুল আখ্যা দিলেও কোনো দুঃখপ্রকাশ করেনি।

ইরানিদের কাছে এটি ছিল সরাসরি এক গণহত্যার দৃষ্টান্ত, যা আরও একবার প্রমাণ করে দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইরানি প্রাণের মূল্য নেই।

৬. JCPOA চুক্তি ভঙ্গ: প্রতিশ্রুতি ভাঙার রাজনীতি

২০১৫ সালে ইরান ও পাঁচ+১ গ্রুপের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় যুগান্তকারী পারমাণবিক চুক্তি JCPOA। এতে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করে, আর আমেরিকাসহ পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সম্মত হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে সরে যান এবং আবারও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

ইরানিদের কাছে এটা ছিল সরাসরি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা। তাদের মতে, আমেরিকার কথা ও চুক্তির কোনো মূল্য নেই। আমেরিকা নিজের ওয়াদাকে নিজেই সম্মান করতে জানেনা।

৭. সোলাইমানি হত্যা: জাতিগত অসম্মানের নতুন অধ্যায়

২০২০ সালে বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় শহীদ হন ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। তিনি দেশের জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডে ইরানিদের মনে প্রতিশোধ ও ঘৃণার আগুন আরো জ্বলে ওঠে।

শুধু একজন নেতাকেই নয়, এই হামলায় ইরান অনুভব করে যে তাদের সার্বভৌমত্বকেও হত্যা করা হয়েছে।

৮. অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা: নিরীহ জনগণকে শাস্তি

মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা ইরানের অর্থনীতি বিধ্বস্ত করে। ওষুধ, খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে বাধা সৃষ্টি হয়। সাধারণ নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত একাধিকবার জানায় এই নিষেধাজ্ঞা মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় ইরানের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে দশকের পর দশক ধরে।

৯. সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক আগ্রাসন

মার্কিন গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্র একতরফাভাবে ইরানকে প্রায়শ 'সন্ত্রাসী রাষ্ট্র' হিসেবে মিথ্যা-বানোয়াট উপস্থাপন করে। পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের বক্তব্যেও ইরানবিরোধিতা ঘৃণামূলক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

সেই সাথে আমেরিকা ইসরাইল ও সৌদি আরবের সাথে মিলিত হয়ে ইরানবিরোধী সামরিক জোট গঠন করে। এতে ইরান নিজেকে আরও বেশি 'ঘেরাও করা' ও কোণঠাসা মনে করে। ইরান ও আমেরিকার পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে ইরানের আচরণ ও বাকশৈলীর শালীনতা লক্ষনীয় যা আমেরিকার বক্তব্যে অনুপস্থিত।

১০. ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: পুনরায় বিশ্বাসের সেতু?

ইরান একাধিকবার প্রমাণ দিয়েছে যে, তারা সংলাপ ও সহযোগিতার পথে যেতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার কথার পেছনে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থ।

বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস, একতরফা আধিপত্য ও নৈতিক দ্বিচারিতা ইরানিদের মনে মার্কিন বিদ্বেষের বীজ বপন করেছে। শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন ন্যায়ভিত্তিক, শ্রদ্ধাপূর্ণ ও দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি।

পরিশেষ

ইরান কেন আমেরিকাকে বিশ্বাস করে না তার উত্তর ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে আছে। এটা কেবল কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং একটি জাতির সম্মান, স্মৃতি ও স্বকীয়তা রক্ষার সংগ্রাম। আমেরিকা যদি সত্যিই ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন চায়, তবে তাকে শুধু চুক্তি নয় আচরণেও দায়িত্বশীল হতে হবে।#

লেখক:  ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।